ভাবতে পারেন, আপনি যে বাড়িটিতে বাস করছেন, সেটি সারা জীবন বৈচিত্র্যহীনভাবে এক দিকে মুখ করে থাকার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত নিজ অক্ষের উপর ঘুরে চলছে? একই জানালা দিয়ে আপনি সকাল বেলা পূর্বদিকের সূর্যোদয় দেখছেন, দুপুর বেলা দখিনা হাওয়া খাচ্ছেন, আর সন্ধ্যাবেলা সেই জানালা দিয়েই পশ্চিমের সূর্যাস্ত উপভোগ করছেন? কাল্পনিক মনে হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সংখ্যায় অল্প হলেও বিশ্বের বেশ কিছু স্থানে সত্যি সত্যিই এমন কিছু বাড়ি আছে, যেগুলো নিজ অক্ষর উপর আবর্তন করতে সক্ষম।
ঘূর্ণায়মান বাড়ি কী?
পৃথিবীতে শত শত ভিলা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং সুউচ্চ নান্দনিক ভবন আছে যেগুলোর কোনো নির্দিষ্ট একটি অংশ ঘোরাতে সক্ষম। সেটি হতে পারে এক কোণে অবস্থিত একটি ছোট কক্ষ, অথবা ছাদের উপরে অবস্থিত দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ওয়াচ টাওয়ার। কিন্তু এগুলোকে ঘূর্ণায়মান বাড়ি বলা যায় না। ঘূর্ণায়মান বাড়ি বলতে সাধারণত সে ধরনের বাড়িকেই বোঝানো হয়, যেখানে সম্পূর্ণ বাড়ি একসাথে আবর্তন করতে সক্ষম।
আর্কিটেকচারাল এবং মেকানিক্যাল ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে বাড়িগুলোর আবর্তন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- পুরো ভবনের সবগুলো তলা একত্রে ঘুরতে সক্ষম- এরকম হতে পারে, আবার প্রতিটি তলা পৃথকভাবে ঘড়ির কাঁটার দিকে বা বিপরীত দিকে ঘুরতে সক্ষম- এমনও হতে পারে। দুই দিকে সর্বোচ্চ ১৮০ ডিগ্রী করে মোট এক পাক বা ৩৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত ঘুরতে সক্ষম- এরকম হতে পারে, আবার যেকোনো দিকে যত খুশি তত বার ঘুরতে সক্ষম- এরকমও হতে পারে।
বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘূর্ণায়মান বাড়ি
১। রোটেটিং হোম (Rotating Home)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোর মাউন্ট হেলিক্সে আল এবং জ্যানেট জনস্টোন দম্পতির এক টুকরো জমি ছিল। সেখানে বাড়ি বানাতে গিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, বাড়িটা কোন দিকে মুখ করে তৈরি করলে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। কারণ তাদের জমিটা এমন এক জায়গায়, যার একদিকে মেক্সিকো সীমান্ত, আরেকদিকে পর্বত এবং অন্য একদিকে সমুদ্র। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন এমন একটি বাড়ি তৈরি করবেন, যেটা ঘুরতে সক্ষম। তাহলেই যেকোনো রুম থেকেই যেকোনো দিকের দৃশ্য উপভোগ করা সম্ভব হবে।
২০০৪ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া তাদের এই বৃত্তাকার দোতলা বাড়িটি একটি সেন্ট্রাল কোরের চারপাশে যত খুশি তত বার ঘুরতে পারে। এটি সর্বনিম্ন ৩০ মিনিটে একবার এবং সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টায় একবার আবর্তন করতে সক্ষম। শুধুমাত্র সেন্ট্রাল কোরটি বাদে সম্পূর্ণ বাড়িটি তার মেঝে, ছাদ এবং দেয়াল সহ ঘুরতে সক্ষম। আবর্তনের জন্য এটি সুইভেল টেকনোলজি ব্যবহার করে।
২। ভিলা গিরাসোল (Villa Girasole)
ঘূর্ণায়মান বাড়িগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে পুরাতন। ইতালিয়ান আর্কিটেক্ট Angelo Invernizzi-র ডিজাইনে ভবনটি তৈরি হয়েছিল ইতালির ভেরোনাতে, ১৯৩৫ সালে। অন্যান্য ঘূর্ণায়মান ভবনের মতো এটি বৃত্তাকার না, এর আকৃতি অনেকটা ইংরেজি এল অক্ষরের মতো, যদিও ভবনটি আবর্তিত হয় ৪৪ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি বৃত্তাকার ভিত্তির উপর।
উপর থেকে দেখতে অনেকটা ঘড়ির মতো এই ভবনটির কেন্দ্রে আছে একটি সর্পিল সিঁড়ি বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় টাওয়ার, যার উচ্চতা ভূ-গর্ভ থেকে চূড়া পর্যন্ত ৪২ মিটার। এই টাওয়ারকে কেন্দ্র করে ইংরেজি ‘এল’ (L) আকৃতির ভবনটি ঘড়ির দুটি কাঁটার মতো বৃত্তাকার পথ ধরে আবর্তন করে। ভবনটির আবর্তনের জন্য তিনটি বৃত্তাকার রেলপথে ১৫টি রোলার স্কেট ব্যবহার করা হয়। সূর্যকে অনুসরণ করে একবার আবর্তন করতে এর সময় লাগে প্রায় ৯ ঘণ্টা ২০ মিনিট।
৩। হেলিওট্রোপ (সূর্যমুখী) রোটেটিং বিল্ডিং (Heliotrope Rotating Building)
জার্মানীতে অবস্থিত এবং জার্মান আর্কিটেক্ট Rolf Disch এর ডিজাইন করা এই ভবনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমনভাবে ঘুরতে পারে যে, গরমকালে দিনের বেলা এর সামনের জানালাগুলো সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, অন্যদিকে শীতকালে এর পেছন দিকের ইনস্যুলেটেড অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টায় এটি ১৮০ ডিগ্রী পরিমাণ আবর্তন করে।
এই ঘূর্ণনপদ্ধতি ভবনটিকে নিম্ন বিদ্যুতের চাহিদা সম্পন্ন ভবনে পরিণত করেছে। তাছাড়া ভবনটি ছাদের উপর স্থাপিত সোলার প্যানেলের মাধ্যমে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতশক্তির পাঁচ গুণ শক্তি নিজেই উৎপন্ন করতে পারে। ভবনটি কেন্দ্রে অবস্থিত একটি পোলকে কেন্দ্র করে অবিরত ঘুরতে পারে। ১৯৯৪ প্রথম হেলিওট্রোপ ভবনটি নির্মিত হলেও এরপরই একই জাতীয় আরও বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হয়।
৪। অ্যারাউন্ড দ্য সী রোটেটিং হাউজ (Around the Sea Rotating House)
সমুদ্রের পাড়ে যদি কোনো হোটেল, রেস্ট হাউজ বা কটেজ তৈরি করা হয়, কিন্তু তার পেছনের দিকে অবস্থিত কক্ষগুলো থেকে সমুদ্র দেখাই না যায়, তাহলে সেটার আর মূল্য কী? এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যেই কানাডার প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে অ্যারাউন্ড দ্য সী নামে একটি দোতলা হোটেল তৈরি করা হয়েছে। এটাই হচ্ছে বিশ্বের প্রথম আবর্তনশীল রেন্টাল হাউজ।
৫,০০০ বর্গ ফুটের এই দোতলা রেন্টাল হাউজটির পুরোটা যেকোনো একদিকে সর্বোচ্চ এক পাক ঘুরে আবার বিপরীত দিকে এক পাক ঘুরতে পারে। একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে এর প্রায় ৪৫ মিনিট সময় লাগে। সার্বক্ষণিক আবর্তনের কারণে সব স্যুইটে অবস্থান করা অতিথিই পর্যায়ক্রমে পার্শ্ববর্তী সমুদ্রের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে পারে।
৫। স্যুইট ভোলার্দ টাওয়ার (Suite Vollard Tower)
ঘূর্ণায়মান ভবনের সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ হলো ব্রাজিলে অবস্থিত স্যুইট ভোলার্দ টাওয়ার। একতলা বা দোতলা না, এটি সম্পূর্ণ ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন, যার ১১টি আবাসিক তলা পৃথকভাবে যেকোনো দিকে যত খুশি তত বার আবর্তন করতে পারে। এটিই বিশ্বের প্রথম কনক্রিট স্ট্রাকচারে তৈরি বহুতল ভবন, যেটা ঘুরতে সক্ষম।
আর্কিটেক্ট Bruno de Franco-র ডিজাইনে তৈরি এই ভবনটি নির্মিত হয় ২০০১ সালে। সেন্ট্রাল কোর, একপাশে অবস্থিত আয়তাকার অংশ এবং বাইরের বারান্দার অংশটুকু বাদে পুরো ভবনটি ঘণ্টায় একবার করে ঘুরতে সক্ষম। ভবনটির প্রতিটি তলায় একটি করে অ্যাপার্টমেন্ট আছে, যেখানে রুমগুলো বৃত্তাকার ভাবে সাজানো। কিচেন, বাথরুম এবং লিফটের অবস্থান ভবনটির কেন্দ্রে এবং অঘূর্ণায়মান আয়তাকার অংশে।
ভবনটির বিভিন্ন তলার চারপাশের কাঁচের জানালাগুলোর রং বিভিন্ন। ফলে প্রতিটি তলা যখন বিপরীত দিকে আবর্তন করতে থাকে, তখন বাইরে থেকে নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃষ্টিনন্দন আবহের সৃষ্টি হয়।
ঘূর্ণায়ন বাড়ির সমস্যা, সমাধান এবং ভবিষ্যত
আপনি হয়তো ভাবছেন প্রযুক্তির এই যুগে মোটর এবং বিয়ারিং ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ভবনের প্রতিটি তলাকে ঘোরানো খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা না। কিন্তু তাহলে পৃথিবীতে ঘূর্ণায়মান ভবনের সংখ্যা এত কম কেন? উত্তরটা হচ্ছে, ঘুর্ণায়মান ভবন বাস্তবায়নের পথে মেকানিক্যাল সমস্যার চেয়েও বড় বাধা হচ্ছে স্যানিটারি সমস্যা। কারণ একটা ভবন ভূমি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তৈরি করা সম্ভব না। বিভিন্ন সার্ভিসের জন্য তাকে স্থির ভূমির সাথে সংযুক্ত থাকতেই হবে।
প্রাণীদেহের মাথার সাথে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন স্নায়ু, পেশী, ধমনী, শিরা প্রভৃতি দ্বারা সংযুক্ত, তেমনি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাড়িও পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, বর্জ্য নিষ্কাশন লাইন প্রভৃতি দ্বারা স্থির ভূমির সাথে যুক্ত। আর তাই কোনো প্রাণীই যেমন শরীর স্থির রেখে নিজের মাথা ১৮০ ডিগ্রীর চেয়ে বেশি ঘোরাতে পারে না, তেমনি বিল্ডিংগুলোকেও বিকল্প সমাধান ছাড়া খুব বেশি ঘোরানো সম্ভব হয় না।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রকৌশলীরা এসব সমস্যার বিভিন্ন সমাধান আবিষ্কার করেছেন। অ্যারাউন্ড দ্য সী-তে কানেকশন হিসেবে রাবারের তৈরি নমনীয় পাইপের ব্যবহার, সুইট ভোলার্দে রান্নাঘর, বাথরুম প্রভৃতিকে অঘূর্ণায়মান অংশে স্থাপন এবং রোটেটিং হোমে স্লিপ রিং এর মাধ্যমে সুইভেল টেকনোলজির ব্যবহার তারই কয়েকটি উদাহরণ।
বিদ্যুতের লাইনের সমস্য সমাধানের জন্যও বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর চেয়েও বর্তমানে প্রস্তাবিত নতুন ঘূর্ণায়মান ভবনগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে স্বয়ংসম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বিশিষ্ট ভবন তৈরির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হেলিওট্রোপ ভবনের মতোই এই ভবনগুলো সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে উত্পাদিত বিদ্যুত দিয়ে নিজেকে ঘোরানো সহ পুরো ভবনের সকল চাহিদা মেটাতে এবং অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি বিদ্যুত ন্যাশনাল গ্রীডে রপ্তানি করতেও সক্ষম হয়।
প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ায় আশা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের দৃষ্টিনন্দন ঘূর্ণায়মান ভবনের সংখ্যা আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।