প্রকৃতিনির্ভর প্রসন্ন, উদার, শান্ত, নিসর্গবেষ্টিত পরিবেশ কে না চায়? সহজাতভাবে আমরা সবুজ রঙের কাছাকাছি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যখন আমাদের চারপাশে গাছপালা থাকে, তখন আমরা কম চাপ অনুভব করি, সবুজ রঙে চোখেরও বিশ্রাম হয়। এক টুকরো মনোরম সবুজে, নির্ভেজাল নিশ্বাসে, সরল প্রাকৃতিক আবহে বেঁচে থাকা আমাদের সবারই নিরন্তর চাওয়া। করোনাপীড়িত সাম্প্রতিক মহামারির এই সময়টাতে এসে তা আমরা আরো নিবিড়ভাবে টের পাচ্ছি। একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেন, মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারা, ফিল্টার হওয়া বায়ুময় পরিবেশ- সবটাই এখন আমাদের প্রাণের চাওয়া।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, জন্মগতভাবেই মানুষ প্রকৃতির কাছে থাকতে চায়। যখন বেশি সময়ের জন্য প্রকৃতির বাইরে থাকতে হয়, তখন মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। কিছুই ভালো লাগে না। অকারণেই একঘেয়ে লাগতে শুরু করে।
কিন্তু দিনে দিনে আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। নগরায়নের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা, রাস্তা-ঘাট, সেতু ইত্যাদি বানাতে আমরা সবুজ উজাড় করে অরণ্যবিমুখ হয়ে পড়ছি। আমাদের নাগরিক জীবন কোলাহলমুখর, ধুলো-ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে এবং ইট-কাঠের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে। যান্ত্রিকতার চাদরে মোড়ানো জীবনটায় আমরা নিজেদেরকেই অবরোধ করেছি এক অপ্রাকৃতিক ইট-পাথরের পরিবেষ্টনে। নাগরিক ব্যস্ততার যাপিত জীবন, দূষিত গ্যাস এবং ধুলোকণা ইত্যাদি উপাদান আমাদের বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলেছে। তবে আমরা প্রকৃতির যেসব ক্ষতি করছি, তা না করে প্রকৃতিকে আধুনিক স্থাপত্যকৌশলে সুবিধার কাজেও লাগাতে পারি। স্থাপত্যশিল্পে তেমনই এক পরিবেশবান্ধব সমাধানের সুন্দর প্রচেষ্টার নাম ‘ভার্টিকেল গার্ডেন’ বা ‘উল্লম্ব উদ্যান’।
গাছ-গুল্ম-লতায় সাজানো যেকোনো স্থান সবসময়ই ভীষণ আকর্ষণীয়। আর এ অনুধাবন থেকে ইট-কাঠ-কংক্রিটে ঠাসবুনোটের শহুরে জীবনে ঘন সবুজের আবহে সাজানো বিভিন্ন স্থাপনায় ভার্টিক্যাল গার্ডেনের ধারণা একরকম স্বস্তিই বলা যায়। স্থপতিবিদরা অভ্যন্তরীণ বা বহিরাঙ্গন ল্যান্ডস্কেপিংয়ের মাধ্যমে স্থাপনাগুলোকে প্রাকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে নান্দনিক চেহারায় প্রাণবন্ত ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণশিল্পের আরেকটি দিক উন্মোচন করে দিয়েছেন। ভার্টিক্যাল গার্ডেনের আদ্যোপান্ত এবং স্থাপত্যশিল্পের সাথে আমাদের আধুনিক সমাজচিত্রের প্রাকৃতিক যোগসূত্র স্থাপনের কলা-কৌশল জানতে পুরো লেখাটি চলুন পড়ে নেওয়া যাক।
নেপথ্য কথা
আধুনিক সমাজচিত্রে ‘বাগানবিলাসী মন’ কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে। দেয়ালে দেয়ালে সবুজ জড়িয়ে থাকা, সেই সাথে হরেক প্রজাতির গাছ-গুল্ম-লতা-ফুল একটা ভবন-কাঠামোয় উলম্বভাবে উদ্যানের মতো দাঁড়িয়ে আছে, দেখে যে কারো ভালো বোধ হয়। প্রাচীন সভ্যতা থেকে আজকের সময় পর্যন্ত মানুষের এই প্রকৃতিপ্রেম যুগ যুগ ধরে চলছে। শহুরে জীবনে আমরা যখন সবুজের অভাবক্লিষ্ট হয়ে পড়ছি, তখন তারই এক সমাধানকল্পে উলম্ব উদ্যান ধারণার উদ্ভব হয়।
এই বিষয়টি কোনো নতুন ধারণা নয়, ধারণাটি ১৯৩০ দশকের এবং এটি তখনকার বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বাস্তবসত্যের আধুনিক রূপ- আজকের এই উলম্ব উদ্যান। সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে গাছপালায় আচ্ছাদিত কোনো প্রাচীরে, মাটি এবং সমন্বিত জল সরবরাহ ব্যবস্থা, জলবর্জ্য নিষ্কাশনের স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্যবস্থা দালান বা যেকোনো স্থাপনায় জুড়ে দেয়া হয়।
বিষয়টি বড় বড় স্থাপনা, অফিস ভবন, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, শপিং মলগুলোয় স্থাপত্য নকশায় সাধারণ বাগানের মতোই প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে আধুনিক নকশা এবং পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত। পুরোপুরি প্রকৌশলবিদ্যার কৌশল কাজে লাগিয়ে বায়োফিলিক ডিজাইনে যেকোনো দালান এবং স্থাপনায় উলম্ব উদ্যান তৈরি করা হয়, যেখানে উদ্যানের গাছগুলোর রুটিন পরিচর্যা, স্বয়ংক্রিয় জল সরবরাহ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। সবুজ রঙকে প্রাধান্য দিয়ে এবং উদ্যানের পুরো সিস্টেমকে ধুলো ফিল্টার করা এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমযোগ্য করে নকশা করা হয়। সেই সাথে অন্যান্য সুবিধার মধ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ এবং শব্দ দূষণ নিরোধক ব্যবস্থাও থাকে।
ভার্টিক্যাল গার্ডেন বা উল্লম্ব উদ্যান কী?
হাইড্রোপোনিক্স ব্যবহার করে উল্লম্বভাবে স্থাপিত প্যানেলে গাছপালা উত্থাপন করার কৌশলই হচ্ছে উল্লম্ব উদ্যান। এ কৌশলে ব্যবহৃত কাঠামোগুলো ফ্রিস্ট্যান্ডিং হয়ে বা কোনো প্রাচীরের সাথে সংযুক্ত থাকে। উল্লম্ব উদ্যানের একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এটি ছোট ছোট খোপ বা বিভিন্ন মডুলার প্যানেলে স্পেস ডিভাইডার, পিভিসি পাইপ, পার্টিশান- এরকম নানা অনুষঙ্গে মূল উল্লম্ব কাঠামোর অভ্যন্তরীণ প্রাচীর বা বহিরাঙ্গনের প্রাচীরে সংযুক্ত থাকতে পারে এবং এতে বহু প্রজাতির গাছপালা স্থাপন করা যায়। উল্লম্ব উদ্যান একটি স্বয়ংক্রিয় ড্রিপ ইরিগ্র্যাটিন সিস্টেম ব্যবহার করে জল সরবরাহ করা হয়, যা জল সাশ্রয় করে এবং বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনাও একই ব্যবস্থায় কাজ করে।
বায়োফিলিক ডিজাইন এবং আমাদের স্বাস্থ্য
বায়োফিলিক ডিজাইন হলো বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে প্রাকৃতিক উপাদান এবং প্রক্রিয়াগুলোকে অন্তর্নির্মিত পরিবেশে একীভূত করে প্রকৃতির সাথে নির্দিষ্ট প্রকল্পের প্রাকৃতিক সংযোগ ঘটানো। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, মানুষের সাথে প্রকৃতির অকৃত্রিম সংযোগ স্থাপনই হচ্ছে বায়োফিলিক; যার মাধ্যমে অধুনা এই সময়ে স্থাপত্য নকশায় আমরা বায়োফিলিক ধারণা জুড়ে দিয়ে সবুজ আচ্ছাদনে নান্দনিক এক পরিবেশবান্ধব স্থাপনা গড়ে তুলতে পারছি। ইট-কাঠ-কংক্রিট কাঠামোর নিষ্প্রাণ ভবনকে সবুজ সঞ্জীবনীর মোড়কে প্রাণময় নৈসগিক সৌন্দর্য্যের এক অনন্য দৃশ্যে উপস্থাপন করতে পারছি। বায়োফিলিক ডিজাইনে যেকোনো স্থাপনায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখা, ভবনের এক্সটেরিয়র সুন্দর দৃশ্যসহ আবাসকারীদের জন্যও এর ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনগুলো সবুজ বা প্রাকৃতিক আবহবেষ্টিত থাকলে তা বসবাসকারী, অফিসকর্মীদের স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটায়।
২০১১ সালে আমেরিকান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই)-এর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। বেশ কয়েকজন বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী সেই গবেষণায় অংশ নেন। গবেষণাপত্রের মূলকথা ছিল, কর্মক্ষেত্রে সামান্য একটু প্রাকৃতিক ছোঁয়া কর্মীদের কাজে আগ্রহ, কর্মোদ্দীপনা বাড়ানোর সাথে সাথে মানসিক চাপ কমায়। এনসিবিআই-এর গবেষণা ছাড়াও, কর্মক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপকারিতা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা হয়েছে। মোদ্দাকথা, বায়োফিলিক ডিজাইনে উলম্ব উদ্যান ধারণা আমাদের শরীর-মনোবৃত্তীয় কার্যকলাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যে দারুণ প্রভাব রাখে।
বিশ্বের বৃহত্তম উলম্ব উদ্যানটি কলম্বিয়ার বোগোটাতে অবস্থিত এবং এটি সান্তালাইয়ার বিল্ডিং নামে পরিচিত। বিল্ডিংটি পুরোপুরি ৮,৫০০ উদ্ভিদের কয়েকটি ঘন সবুজ স্তর দিয়ে আচ্ছাদিত, যা ৩,১০০ বর্গ মিটার (৩৩, ৩৬৮ বর্গফুট) জুড়ে বিস্তৃত। উল্লম্ব উদ্যানটি প্রতি বছর ৩,১০০ জনেরও বেশি পরিমাণে অক্সিজেন তৈরি করতে পারে; ১,৭০৮ পাউন্ড ভারি ধাতব প্রক্রিয়াজাত করতে পারে; ২,০০০ টনেরও বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস ফিল্টার করতে পারে এবং ৮৮১ পাউন্ডের বেশি ধূলিকণা ধরতে পারে। বিশ্ব জুড়ে এই উদ্যানগুলো সৃজনশীলতাকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
বাতাস পরিষ্কার করা, দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি মানুষকে প্রকৃতির কাছাকাছি রেখে সবুজ প্রাচীর বা উলম্ব উদ্যানগুলো আমাদের পরিবেশকে আরও ভালো, সুস্থ এবং স্বাভাবিক রাখছে। এগুলো অন্দর বা বহিরাঙ্গন দেয়ালে, দালানের বিভিন্ন খাঁজে বা এমনকি মুক্ত স্থানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি স্থাপত্যিক সৌন্দর্যকেও নানানভাবে প্রতিফলিত হয় এর মাধ্যমে।
উল্লম্ব উদ্যানের জনক হলেন প্যাট্রিক ব্ল্যাঙ্ক। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ফরাসি ল্যান্ডস্কেপ স্থপতি প্যাট্রিক ব্ল্যাঙ্ক প্যারিসে এবং পরে বিশ্বের অন্যান্য শহরে উল্লম্ব উদ্যানের বাস্তবায়নের পথিকৃৎ হয়েছিলেন। সবুজাভ প্রাচীর বা ভার্টিক্যাল গার্ডেন ধারণাটি প্রথম স্ট্যানলে হার্ট হোয়াইট ১৯৩৮ সালে পেটেন্ট করেন, তবে এটি প্যাট্রিক ব্ল্যাঙ্কের নামের মাধ্যমেই স্থাপত্যশিল্পের নকশায় অন্তর্ভুক্তি হয়। প্যারিসের মিউজু ডু কুই ব্রানলিতে সর্বাধিক বিখ্যাত সবুজ উল্লম্ব উদ্যান তৈরির পর, তিনি টেকসই স্থাপত্যশিল্পে একটি বিপ্লব ছড়িয়ে দিয়ে ‘উদ্ভিজ্জ প্রাচীর’-এর জনক হিসাবে মনোনীত হন। তিনি কেবল শহর এবং পাবলিক ভবনের জন্য নয়, অনেকগুলো ব্যক্তিগত আবাসের জন্যও প্রাকৃতিক এই উল্লম্ব উদ্যান শিল্পের অবিশ্বাস্য প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
সুবিধা
উল্লম্ব উদ্যান অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং স্থাপনায় কাঠামোগত যেসব সুবিধা দেয়:
- বিল্ডিং প্রোফাইল এবং সৌন্দর্যায়ন
- বিশুদ্ধ বায়ু
- জীববৈচিত্র্য এবং আবাসস্থল
- উন্নত স্বাস্থ্য
- মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি
- কার্বন ডাই অক্সাইড স্তর হ্রাস
- বেনজিন এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মতো নির্দিষ্ট দূষণকারী গ্যাসের মাত্রা হ্রাস
- বায়ুবাহিত ধুলোর স্তর হ্রাস
- বায়ু তাপমাত্রা কম রাখা
- অ্যাকাস্টিক বাফারিং
পরিবেশের সহায়তা
গাছপালা প্রাকৃতিকভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ু উৎপাদন করে আমাদের জীবনধারণে অন্যতম ভূমিকা রাখে। উল্লম্ব উদ্যানও পরিবেশকে একইভাবে বাঁচিয়ে রাখছে। গাছপালা বাতাস পরিষ্কার করে, শব্দদূষণ হ্রাস করতে সহায়তা করে বায়ুমন্ডলকে স্বাভাবিক রাখে এবং সেই সাথে সাউন্ড ও হিট বাফার হিসেবেও কাজ করে, যার দরুন বায়ু ও তাপমাত্রা পরিবেশের অনুকূলে থাকে। এছাড়াও উল্লম্ব উদ্যানের গাছগুলো অন্যসব গাছের মতোই বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে এবং দূষণকারী গ্যাসগুলোকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে পরিষ্কার অক্সিজেনের বিনিময়ে ফিল্টার আউট করে দেয়।
উল্লম্ব উদ্যান কীভাবে কাজ করে?
উলম্ব উদ্যানের সবুজে ঘেরা প্রাচীরগুলো নিমার্ণের সাধারণ প্রাচীরের মতোই নির্মিত হয়। এগুলো বিভিন্ন মডুলার প্যানেল বা ফ্রেম সংযুক্তির মাধ্যমে প্রাচীরের পৃষ্ঠদেশে কাঠামো দাঁড় করানো হয় এবং পার্টিশান বা স্পেস ডিভাইডার দিয়ে বিভিন্ন ব্লক করে নকশামতো গাছপালা এবং ফুলগুলো ধারণ করার উপযোগী ব্যবস্থায় পুরো ব্যবস্থাটিকে উন্নত করা হয়। সবুজ প্রাচীরগুলো আনুভূমিকভাবে তুলনামূলক ছোট জায়গায় প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ ধারণ করে। প্রাচীরগুলোর পৃষ্ঠকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এবং উপরের দিকে প্রসারিত করে বা ঝুলিয়ে রেখে গাছগুলো যুক্ত করা হয়। গাছগুলোকে সুস্থ রাখতে একটি স্ব-জল সরবরাহ ব্যবস্থা থাকে, যা জল সরবরাহের পাইপ সরঞ্জামাদি সবুজ দেয়ালে আবৃত অবস্থায় রাখা হয়।
উল্লম্ব উদ্যানে কোন ধরনের গাছপালা ব্যবহার করা হয়?
যেহেতু প্রতিটি সবুজ প্রাচীর পৃথকভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য ডিজাইন করা হয়, প্রতিটি প্রাচীরের ক্ষেত্রেই আলাদাভাবে গাছপালার উদ্ভিজ্জ বৈশিষ্ট্যের উপর বিবেচনা করা হয়। প্রাচীরের একেকটি অংশে আবহাওয়ার একেক প্রভাব থাকে। অভ্যন্তরীণ গাছগুলো বহিঃপ্রাচীরের ব্যবহৃত থেকে সম্পূর্ণ পৃথক অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিক অঞ্চলের গাছপালা জলবায়ু অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে বেছে নেওয়া হয়, কারণ সঠিক অঞ্চলে সঠিক গাছপালা ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ। গাছপালা এমনভাবে বেছে নেওয়া হয়, যা অবস্থানের জলবায়ুর চেয়ে উচ্চতর জলবায়ু অঞ্চলে কিছুটা বিরূপ পরিবেশেও যেন টিকে থাকতে পারে। বায়োফিলিক ডিজাইনের সাথে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ, ঝাড়, শ্যাওলা এবং পাতা ও ফুলের রঙের প্যাটার্ন মিলিয়ে একেকটি প্যানেল নকশানুযায়ী প্রাচীরের যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়।
প্রকৃতির সাথে সংযোগস্থাপন আমাদের সুস্থতার ক্ষেত্রে সহায়ক এবং একইসাথে কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়োজন এবং অপরিহার্যও বটে। অরণ্যকে ফিরে পাবার বাসনা এবং কাষ্ঠ ও প্রস্তরবেষ্টিত নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আক্ষেপকে জানান দিতে ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় বলেছেন-
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর”
অধুনা সময়ে নগরায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চললেও আমরা মানুষরা মূলত শেকড়ের টান বা আমাদের সৃষ্টির আদি অকৃত্রিম প্রকৃতি প্রেমকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে মানুষ উন্নতির শীর্ষদেশে উঠছে। ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন আকার আর ধরনের সুউচ্চ বিল্ডিং কাঠামো, হেলানো, ভাসমান এবং ক্যান্টিলিভার পদ্ধতিতে ঝুলে থাকা বিল্ডিং কাঠামোগুলো গড়ে উঠছে প্রতিনিয়তই। আধুনিক নগর-সভ্যতা মানব জীবনে অনেক অগ্রগতি এনেছে, এ কথা সত্য। কিন্তু এ সভ্যতা আজ মানুষের হৃদয়বৃত্তির ওপর এমনভাবে চেপে বসেছে যে, মানুষ হয়ে পড়ছে ক্রমেই ইট-কাঠ-পাাথর কাঠামোয় ঘেরা এক জড়-ঘন পরিবেশের কৃত্রিম আবাসের বাসিন্দা।
এ সভ্যতার জঠরে বস্তুভারের বেড়াজালে মানুষ হারিয়েছে শান্ত নিসর্গবেষ্টিত জীবনের সরল সৌন্দর্য। হারিয়েছে প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে দেহ-মনের অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিকাশের সুযোগ। আধুনিক সভ্যতার পাষাণ-পিঞ্জরে অবরুদ্ধ মানুষ মুক্তি প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে প্রকৃতিচালিত হৃত জীবনকে ফিরে পাওয়ার জন্যে। তাই লক্ষ-কোটি বছর পরেও মানুষ অরণ্যের প্রতি টান অনুভব করছে, চাইছে ফেলে আসা এক সহজ প্রাকৃতিক আবহে ফিরে যেতে। তারই নিমিত্তে এক সময়োপযোগী প্রয়াস স্থাপত্যশিল্পের এই ভার্টিক্যাল গার্ডেন বা উলম্ব উদ্যান ।
এই শিল্পের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটুক এবং বনাঞ্চল হতে আমাদের শহরাঞ্চল- সবখানেই প্রকৃতি বেঁচে থাকুক সবুজ সঞ্জীবনী প্রেরণায়।