দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশিল্প কার না ভালো লাগে? প্রাচীনকালের সেই পিরামিড থেকে আধুনিককালের আইফেল টাওয়ার। এমন স্থাপত্যশৈলী একদিকে যেমন বাণিজ্যিক চাহিদা মেটায় অন্যদিকে এর নান্দনিকতা দিয়ে ভাবনার খোরাকও যোগায়। নান্দনিক আদলে গড়া এসব স্থাপত্যশৈলী শুধু চোখকেই শান্তি দেয় না বরং মনকে করে প্রশান্ত।
বছর ঘুরে নতুন বছর ছুটছে আগামীর তরে। নতুন বছরে কি হবে কিংবা আগামীকে কি হতে পারে এমন ধারণাটা সাধারণত পুরাতন বছরগুলো বিশ্লেষণ করলেই টের পাওয়া যায়। আর আগামীতে স্থাপত্যশৈলী কতটা দৃষ্টিনন্দন, নান্দনিক আর দৃঢ়তায় গড়ে উঠবে তা আমরা জানতে পারবো পেছনের বছরের সেরা স্থাপত্যশৈলীগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই। আজকের আয়োজনে থাকছে ২০১৯ সালের সেরা ১০টি স্থাপত্যশৈলীর কথা; যা দেখে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন পৃথিবী কতটা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের রাজ্যে।
০১. বেইজিং দাক্সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চীন
বেইজিং দাক্সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যা বেইজিং নতুন বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। ২০২১ সালের মধ্যেই এই মেগা প্রজেক্টের আওতায় প্রায় ৪৫ মিলিয়ন যাত্রী আনা নেওয়ার কাজ করবে এই বিমানবন্দর এবং ভবিষ্যতে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০০ মিলিয়নেও পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল সমৃদ্ধ এই বিমানবন্দর, বছরে প্রায় ৪ মিলিয়ন কার্গো পণ্য পরিবহণে সক্ষম হবে। ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭০ বছর পূর্তি। সেই উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সি চিং পিং বেইজিংয়ে এই বিমানবন্দরটির উদ্ভোধন করেন।
৭ লাখ বর্গ মিটার আয়তনের এই বিমানবন্দরটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার। আর এটি এতটাই বিশাল যে, প্রায় ৯৮টি ফুটবল মাঠের সমান এর আয়তন। তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে ৪৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই বিমানবন্দরটি দেখতে অনেকটা স্টার ফিশের মতো বলে চাইনিজ মিডিয়া একে ‘স্টারফিশ’ বলে অভিহিত করেছে। এই বিমানবন্দরের নকশা করেছেন ইরাকি বংশোদ্ভূত বিখ্যাত স্থপতি জাহা হাদিদ। আর কাজ করেছে তারই প্রতিষ্ঠান জাহা হাদিদ আর্কিটেকচার।
চারতলা বিমানবন্দরটি একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রকে ঘিরে বানানো হয়েছে; যেখানে স্বচ্ছ কাচের আবরণ ভেদ করে রৌদ্রের আলো পৌঁছায়। আর নির্মাতা ফার্ম এই কেন্দ্রকে ‘সেন্ট্রাল ওরিয়েন্টেশন স্পেস ডোম’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এই কেন্দ্রীয় স্থানকে ঘিরেই চারিদিক জুড়ে গড়ে উঠেছে চেক-ইন স্থান, আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সুরক্ষা ডেস্ক এবং একইসাথে শপিংমল আর ফুডকোর্ট। কেন্দ্রকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ছ’দিকের ছয়টা আলাদা জোনকে একসাথে এই কাঠামোটিকে উপর থেকে একটা স্টারফিশের মতোই দেখায়।
চীনা ঐতিহ্যবাহী উঠানের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এই বিমানবন্দরে। এছাড়া, ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে পুরোটা জুড়েই শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে বেইজিং সেন্ট্রাল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এর কল্যাণে। এছাড়া নান্দনিক ডিজাইনের চেয়ার এবং পুরো হলওয়ে জুড়ে এলইডি স্ক্রিনের সুব্যবস্থা; যা কেবল মানুষ চলাচলের সময়ই দৃশ্যমাণ হয়। ভবিষ্যতে আরও দারুণ এবং আকর্ষণীয় হবে বলে ধারণা পোষণ করছে চায়না সরকার এবং এর নির্মাতা স্টুডিও।
০২. কিস্তেফোস জাদুঘর, নরওয়ে
সমসাময়িক শিল্পকর্মের জন্য কিস্তেফোস ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক ভাষ্কর্য উদ্যান। ১৯৯৬ সালে নরওয়ের এই জাদুঘর স্থাপন করেছিলেন আর্ট সংগ্রাহক এবং ব্যবসায়ী ক্রিস্টেন সিভাস। বর্তমানে এটি একটি শিল্প জাদুঘর, যেখানে দুটি আর্ট গ্যালারী এবং মনোরম পরিবেশে চিত্তাকর্ষক ভাষ্কর্যের একটি পার্ক রয়েছে। প্রতি বছরই এই পার্কে এক বা একাধিক নতুন ভাষ্কর্য স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এই পার্কে ৪৬টি ভাষ্কর্য আছে, যার মধ্যে ইয়াইউ কুসামা, ক্লেস ওল্ডেনবার্গ, ফার্নান্ডো বোতেরো, টনি ক্রেগ, ওলাফুর এলাইসন এবং আনিশ কাপুরের মতো বিখ্যাত ভাষ্করদের ভাষ্কর্য আছে।
প্রতিবছর কিস্তেফোস শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে, যেখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পীদের কাজ শোভা পায়। আয়োজন করা হয় দুটি গ্যালারিতে। একটি হচ্ছে নাইব্রুকেত আর অন্যটি দ্য টুইস্ট। দ্য টুইস্ট হচ্ছে আসলে স্থাপত্যশৈলীর এক মাস্টারপিস, যা একইসাথে একটি গ্যালারি, একটি সেতু এবং নান্দনিক এক ভাষ্কর্য। প্রায় ১,৪০০ বর্গ মিটারের ভবনটি একটি ভাষ্কর্যের আদলে গড়ে উঠেছে। ভবনটি সেতুর মতো তৈরি হলেও মধ্যপথের পাকান বা বাঁকানো অংশটি একে আরও বেশি নান্দনিক করে গড়ে তুলেছে। র্যান্ডসেলভা নদীর উত্তর আর দক্ষিণ দিকের মধ্যে এক সংযোগস্থল স্থাপন করেছে এই ভবনটি।
ড্যানিশ আর্কিটেকচারাল ফার্ম বিজার্ক ইঙ্গেলস গ্রুপ, যা সংক্ষেপে বিগ নামে পরিচিত, দ্য টুইস্ট নামক এই সেতু-জাদুঘর এবং ভাষ্কর্যের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল নতুন কিছু স্থাপনা বা ভাষ্কর্য গড়ার নিমিত্তে। সেই প্রতিযোগিতায় বিগ প্রতিষ্ঠানটি এই ভবনের নকশা এবং পরিকল্পনা দিলে তা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
পথের শেষ মাথার দুটি কাঠের ব্রীজ এই ভবনটিকে সংযুক্ত করে রেখেছে এবং ভাষ্কর্য পার্কের দুটি দিককে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে নান্দনিক গঠনশৈলীর মধ্য দিয়ে। ভবনটির বাঁকানো অংশটা কেবল দৃষ্টিনন্দন তা কিন্তু নয়। আলাদা উচ্চতার পরিমাপের ভিত্তিতে এই অংশটা নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। দক্ষিণ দিকে এটি একতলা হলেও উত্তর দিকে এটি দ্বিতল বিশিষ্ট আকার ধারণ করেছে এই বাঁকানো অংশের বদৌলতে।
দর্শনার্থীরা দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করবে এবং উত্তর দিকে যাওয়ার পথে তথ্যকেন্দ্র, ক্যাফে এবং জাদুঘর পেরিয়ে যাবে। মধ্যভাগে একটি উন্মুক্ত বারান্দা পড়বে যা দর্শনার্থীদের বনভূমির সৌন্দর্য অবলোকনে সাহায্য করবে। এই অভিনব বাঁকানো অংশটির কারণে সরাসরি সূর্যালোক, পার্শ্ব-সূর্যালোক এবং অন্ধকার জায়গার জন্য উপযুক্ত শিল্পকর্ম সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
০৩. জাতীয় জাদুঘর, কাতার
দোহার এক প্রান্তে ৪০,০০০ বর্গ মিটারের একটা ‘ডেজার্ট গোলাপ’ প্রস্ফুটিত হয়েছে। দুই বছর বিলম্ব হলেও অবশেষে গত বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে কাতারের জাতীয় জাদুঘর উদ্ভোধন হয়েছে। প্রিজকার পুরষ্কারপ্রাপ্ত স্থপতি জ্যঁ ন্যুভেল এটির নকশা করেছেন; যিনি আবুধাবির ল্যুভরেরও নকশা প্রণেতা। ৪০ হাজার বর্গ মিটারের এই বিশাল আয়তনের জাদুঘরটি নির্মাণে সময় লেগেছে এক দশক এবং ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। ইউকে টাইমস এই স্থাপত্যকে “দশকের সেরা অসাধারণ ভবন”, ফিন্যানশিয়াল টাইমস “পরিবর্তনের সূচক মরুভূমির গোলাপ” এবং দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এই ভবনটিকে “চোখ-জুড়ানো স্থাপত্য” নামে আখ্যায়িত করেছে।
কাতারের মরুভূমি অঞ্চলে জিপসাম এবং বালির মিশ্রণে তৈরি পাথরগুলো ধীরে ধীরে গোলাপের পাপড়ির আকার ধারণ করে। আর সব পাপড়ি একসাথে করলে একটা প্রস্ফুটিত গোলাপের মতোই লাগে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই পাথরের উপরের বালি সরে গেলে আলো প্রতিফলিত করে এবং দারুণ এক প্রাকৃতিক স্যুভেনিয়রে পরিণত হয় এই ডেজার্ট রোজ বা মরুভূমির গোলাপ। এটি কাতারের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ বলেও গণ্য করা হয়। আর তাই এই ডেজার্ট রোজের আদলেই কাতারের জাতীয় জাদুঘরের নকশা করা হয়েছে।
প্রায় দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ১১টি গ্যালারি দিয়ে কাতারের ইতিহাসের তিনটি অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে এই জাদুঘরের অভ্যন্তরে। শুধু যে স্থাপত্যে বিশেষ স্বতন্ত্র এই জাদুঘর তা কিন্তু নয়; বরং এর অভ্যন্তরের সাজসজ্জাও একদম চোখধাঁধানো। আরেকটা আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই জাদুঘরে প্রদর্শিত ডায়ারামোগুলো।
ডায়ারামো হচ্ছে এক ধরণের থ্রি-ডি বক্স; যা ত্রিমাত্রিক অবয়ব চোখের সামনে তুলে ধরে। ফলে হাজার বছরের ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠার অনুভূতি পাওয়া যায়। আর এর দেয়ালগুলো তাই অসমভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এই ডায়ারামোগুলো দেখতে কোনো অসুবিধে না হয় এবং কাতারের উপদ্বীপের সচিত্র আলোড়ন তৈরি করা হয়।
স্থপতি ন্যুভেল বলেন,
শিল্প আর তথ্যের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূচনা হয়েছে জাদুঘরটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কাতারের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত জীবনযাত্রার সাথে এর সংস্কৃতি এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন কীভাবে জড়িত তা-ই দেখাতে চেয়েছি আমরা।
০৪. আন্ডার, নরওয়ে
সবুজাভ আলোয় বসে খাবার খাচ্ছেন। পিনপতন নীরবতার মধ্যে সমুদ্রের গর্জন কানে ভাসছে। চকিতে ডান দিকে তাকিয়ে দেখলেন সমুদ্রের তলদেশের জীববৈচিত্র্য। মুগ্ধ হবেন না? হ্যাঁ, পৃথিবীকে একদম অবাক করে দিয়ে নরওয়েতে সম্প্রতি চালু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং ইউরোপের প্রথম পানির নীচের রেস্তোরাঁ আন্ডার।
নরওয়েজিয়ান সাগর উপকূলে সর্বদক্ষিণে অবস্থিত আন্ডার রেস্তোরাঁটি; যেখানে উত্তর আর দক্ষিণের সামুদ্রিক ঝড় আর বিশাল ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে। আর অতিরিক্ত লোনা এবং ইষৎ লোনা জলের সকল সামুদ্রিক প্রজাতিগুলো এখানে এসে জড়ো হয়। যার ফলে এ দিকটায় জীববৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক প্রাচুর্য আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়। স্ন্যোহেটার নকশা করা এই রেস্তোরাঁটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
নরওয়েজিয়ান ভাষায়, আন্ডারের দুটি আলাদা অর্থ আছে। এক অর্থে নীচে আর অন্য অর্থে ওয়ান্ডার বা আশ্চর্য বোঝায়। সমুদ্রের মধ্যে অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় থাকা এক প্রস্তের ৩৪ মিটার লম্বা ভবনটি পানির নীচে পাঁচ মিটার অবধি প্রসারিত। এই কাঠামোটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যেন একইসাথে ডুবে থাকা অংশ এবং উন্মুক্ত অংশ পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে টিকে থাকে।
কংক্রিটের খোলের রুক্ষতা কৃত্রিম প্রবালপ্রাচীরের কাজ করবে। যেজন্য সামুদ্রিক শ্যাওলা এবং শামুক প্রজাতির প্রাণীগুলো আকর্ষিত হবে। আর বন্ধুর উপকূলের শক্ত আর ঘন কংক্রিটের দেয়াল, উত্তাল সমুদ্রের চাপ থেকে ভেতরের কাঠামোটি শক্তপোক্ত রাখতে বানান হয়েছে। ডুবন্ত একটা পেরিস্কোপের মতোই, রেস্তোরাঁটির একটা জানালা আছে; যা ১১ মিটার প্রশস্ত এবং ৩.৪ মিটার লম্বা যেটা দিয়ে আপনি সমুদ্রের জীবন দেখতে পাবেন। শুধু যে একজন অতিথিকে স্থাপত্যশৈলী দিয়েই মুগ্ধ করবে আন্ডার রেস্তোরাঁ তা কিন্তু নয়। কেননা, সমুদ্রের তাজা আর সতেজ খাবারের অতুলনীয় স্বাদ অপেক্ষা করছে অতিথিদের জন্য।
স্ন্যোহেটার খ্যাতি জগতজোড়া। এর আগে অসলো অপেরা হাউজ এবং নিউ ইয়র্কের ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ইলেভেন মেমোরিয়াল মিউজিয়াম নকশা করে বেশ প্রসংসা কামিয়েছে। তবে আন্ডার দিয়ে সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছেন স্ন্যোহেটা। খাবারের পদে অবশ্যই সামুদ্রিক খাবার থাকছে। ডেনিশ রাঁধুনি নিকোলাস এলিফটগার্ড পেডারসন কর্ড, চিংড়ি, ঝিনুক এবং সামুদ্রিক উদ্ভিজ্জ দিয়ে অতুলনীয় স্বাদের খাবার রান্না করে থাকেন।
প্রায় ১৮ পদ নির্ধারিত হলেও থাকছে জুস আর ওয়াইনের সুব্যবস্থা তো থাকছেই। একসঙ্গে একবারে ৪০ জন বসা যাবে এই রেস্তোরাঁতে। আর জনপ্রতি খাবার খরচ ৪৩০ মার্কিন ডলার বা ৩৬ হাজার টাকা। দুই ভাইয়ের মালিকানাধীন এই অনন্য রেস্তোরাঁটি ইতিমধ্যেই ভ্রমণপিপাসু মানুষদের নজর কেড়েছে।
০৫. ভেসেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
অস্থায়ীভাবে ভেসেল নামকরণ করা হলেও স্থাপত্যটির আদল আসলে একটি ভেসেল বা ফুলদানীর মতোই। ভেসেল আসলে এমন একটি পাবলিক ল্যান্ডমার্ক, যেটা চক্রাকারভাবে ১৬ তলা অবধি উঠে গেছে এবং হাডসন নদী আর ম্যানহ্যাটনের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য প্রায় ৮০টি সিঁড়িঘর রয়েছে এতে। আমেরিকার ইতিহাসে বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই অপরূপ সুন্দর স্থাপত্যটির নকশা করেছেন ব্রিটিশ স্থপতি থমাস হেদারউইক।
হেদারউইক স্টুডিওকে প্রকল্পটি দেয়ার প্রাক্কালে বলা হয়েছিল, হাডসন ইয়ার্ডসের কেন্দ্রস্থলে এমন একটি স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে যা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করবে এবং ম্যানহাটনে লোক সমাগম বাড়াবে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম এবং উঁচু সব অট্টালিকার মাঝে এরকম দৃষ্টিনন্দন একটা স্থাপনা নির্মাণ সত্যিকার অর্থেই বেশ চ্যালেঞ্জিং একট ব্যাপার। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জটাই যেন আরও বেশি প্রেরণা দিয়েছে একটা অনন্য স্থাপত্য নির্মাণে।
তামাটে রঙের সফিটগুলোর কারণে প্লাজার নীচে দাঁড়ানো অথবা চলাচলরত মানুষজনদের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে পুরো ভবন জুড়ে। আর কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে ভেতরের দিকটা এতটা সূক্ষ্মভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে শহুরে একটা ভাব লক্ষ্য করা যায় এতে।
এই ভবনে আছে ১৫৮টি সিঁড়ির সংযোগস্থল, প্রায় ২,৫০০টি স্বতন্ত্র সিঁড়ির ধাপ এবং ৮০টি সিঁড়িঘর। এই খাড়াভাবে আরোহণের সময় ভবনের মাঝপথে বিশ্রাম এবং দৃষ্টি জুড়ানোর জন্য আছে নদী আর শহরের দৃশ্য দেখার সুযোগ।
০৬. উশি তাইহু মঞ্চ, চীন
গত বছরের একদম শেষের দিকে বাঁশঝাড়ের মতো দেখতে স্টিলের কাঠামোয় নকশা করা উশি তাইহু মঞ্চ নির্মাণ করেছে স্টিভেন চিল্টন আর্কিটেক ফার্ম। মঞ্চটি পূর্ব চীনের সাংহাইয়ের কাছাকাছি উশি শহরে নির্মিত হয়েছে। চীনের বৃহত্তম বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি হওয়ায় এটিকেও বাঁশঝাড়ের আদলেই গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো স্থাপত্যটির মধ্যভাগে আছে দুই হাজার আসন বিশিষ্ট মঞ্চ; যা পাথরের খোঁদাই করা চিত্র এবং চাকচিক্যময় দেয়াল দিয়ে ঘেরা।
ছাদের ছাউনিটি চারিদিক থেকে ভবনটিকে ঘিরে রেখেছে। ছাউনিটা ত্রিভুজাকৃতিতে জায়গাভেদে খোঁদাই করা; ফলে দিনের বেলা আলো এসে সেইসব ফাঁকা দিয়ে এবং আলো-ছায়ার এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয় চারিদিক জুড়ে। শুধু যে আলো-ছায়াই এটার মূল উদ্দেশ্য তা কিন্তু নয়। বরং প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখার একটি প্রক্রিয়াও বটে।
বাঁশঝাড়ের আদলে গাঁথা স্টিলের থামগুলো একেক দিক থেকে দেখতে একেক রকম দেখায় বলে বিভ্রম সৃষ্টি হয়। রাতের বেলা ভবনের থামগুলোর নীচ হতে আলোকসজ্জা জ্বললে, দূর থেকে এই বাঁশঝাড়কে এক স্বর্গীয় বাতিঘর বলে মনে হয়।
০৭. কোপেনহিল, ডেনমার্ক
কোপেনহিল অথবা ডেনিশ ভাষায় ‘আমাগের বাক্কে’, আসলে ডেনমার্কে কোপেনহেগেনের দক্ষিণ-পূর্ব আমাগার অঞ্চলে পাহাড়ের অভাবের এক শৈল্পিক অভিব্যক্তি। প্রায় এক দশক সময় হাতে নিয়ে এই নান্দনিক স্থাপত্যটি নির্মাণ করেছে বিজার্ক ইঙ্গেলস গ্রুপ বা সংক্ষেপে বিগ নামে পরিচিত স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানটি।
এটি আসলে শুধুমাত্র কোনো স্থাপত্যশৈলী নয়, পাশাপাশি এটি বর্জ্য থেকে শক্তি উদ্ভাবন কেন্দ্রও বটে। আর এর নির্মাণের পেছনের উদ্দেশ্যটাও বেশ সুদূরপ্রসারী। ২০২৫ সালের মধ্যে কোপেনহেগেনকে একমাত্র কার্বন-নিয়ন্ত্রিত শহরে পরিণত করা। কোপেনহিলের স্থাপত্যের আদলটি আসলে ১.২ মিটার লম্বা এবং ৩.৩ মিটার প্রশস্ত অ্যালুমিনিয়ামের ইট দ্বারা সজ্জিত যা একে অপরের কিছু অংশ ঢেকে রেখে এক সমাপতিত আকার ধারণ করেছে।
বর্জ্য ব্যবস্থা এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য সকল ধরণের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে কোপেনহিলের অভ্যন্তরে। বছরে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার টন বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা আছে এর চিমনিগুলোর এবং প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার বাড়িঘরকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পারবে এই কোপেনহিল। ৪১০ ফুট চিমনিটি জলীয় বাষ্প থেকে তৈরি ধোঁয়ায় প্রতিবার এক টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছাড়ে।
নান্দনিক এই স্থাপত্যশৈলী কোপেনহেগের জনগণের মধ্যে দারুণ এক আমেজ সৃষ্টি করেছে। নান্দনিক এই স্থাপত্য দেখতে নাগরিকরা যেমন ভিড় করছে, তেমনি স্কি করার জন্য প্রতিনিয়ত ভিড় করছে স্কি প্রেমিরা।
০৮. জুয়েল চ্যাঙ্গি বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর
বেশিরভাগ লোকেদের কাছেই বিমানবন্দর বলতে কেবল যাতায়াত এবং যাত্রাবিরতির একটা স্থান ব্যতীত অন্য আর কিছুই নয়। একটা বিমানবন্দর যে দর্শনীয় স্থান হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে, তা তাদের ধারণাতেও নেই। আর এমনই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছে সিঙ্গাপুরের জুয়েল চ্যাঙ্গি বিমানবন্দর। এর সর্বশেষ সম্প্রসারণ-জুয়েল চ্যাঙ্গি বিমানবন্দর-কেবল সিঙ্গাপুরের বিমান ব্যবস্থাই নয় বরং এর জীবনযাত্রার মান কতটা উচ্চ তারও একটা ধারণা দিয়েছে।
সাফদি আর্কিটেক এর মোশে সাফদির নকশায় গ্লাস এবং স্টিলের গম্বুজ আকৃতির দশতলা এই কাঠামোটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাধ্য করবে। ১.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বিমানবন্দরে থাকছে ১৩০টি হোটেল রুম এবং ২৮০টিরও অধিক আউটলেট।
এই মূল ভবনে টার্মিনাল ছাড়া আরও থাকছে-
স্কাই নেট – ২৫০ মিটারের একটা বাউন্সিং নেট; যা ৫০ মিটার লম্বা আর ২৫ মিটার উচ্চতার একটি আলাদা হাঁটার নেট। যা অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেবে।
শপিং – থাকছে দেশি-বিদেশি অসংখ্য খাবার এবং কাপড়সহ স্যুভেনিয়রের আউটলেট।
ক্যানোপি মেইজ – ৫০০ বর্গ মিটার এবং ৮ মিটার উচ্চতার এই মেইজ বা গোলকধাঁধাটি ক্ষণিকের জন্য দর্শনার্থীদের কল্পরাজ্য থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
ডিসকভার স্লাইডস – দুটি টিউব স্লাইড আর দুটি গ্রাউন্ড স্লাইড বাচ্চাসহ সকল বয়সী মানুষদেরকেই আনন্দ দেবে।
ফরেস্ট ভ্যালি এবং রেইন ভরটেক্স – চারতলা এই বাগানটা সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদের সর্ববৃহৎ সংগ্রহশালা এবং ৪০ মিটার উঁচু রেইন ভরটেক্সটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ উচ্চ অভ্যন্তরীণ জলপ্রপাত।
ফগি বোল – কৃত্রিম মেঘ আর কুয়াশাচ্ছন্ন এই জায়গাটা মনোমুগ্ধকর।
ক্যানোপি ব্রীজ – মাটি থেকে ২৩ মিটার উঁচু এবং ৫০ মিটার লম্বা কাঁচের এই ব্রীজটি দিয়ে চারপাশ ঘুরে দেখা যাবে।
০৯. লিজা সোহো, চীন
জাহা হাদিদ মানেই অনন্য কিছু, ভিন্ন কিছু, ব্যতিক্রম কিছু। একইভাবে চীনের বেইজিংয়ের লিজা সোহো হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপত্যই নয় বরং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্টিয়াম। ৪৫ তলা এই ভবনটি বেইজিংয়ের ছোট এবং মধ্যম আয়ের ব্যবসায়ীদের জন্য আদর্শ আর উপযুক্ত একটি জায়গা হবে ধারণা করা হচ্ছে। এই ভবনটি এমন একটি জায়গায় নির্মাণ হয়েছে যেটার নীচে একটি পাতাল রেলের টানেল রয়েছে।
এই টানেলের উপর ভবনটির অবস্থানের কারণেই জাহা হাদিদের স্থপতিরা ভবনটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে; ফলে দুই অংশের মাঝখানে বিশাল বড় এক আর্টিয়াম বা অলিন্দ তৈরি হয়েছে। এই আর্টিয়ামটি ভবনের নীচ থেকে একদম চূড়া অবধি ১৯৪.১৫ মিটার; যা দুবাইয়ের বুর্জ আল আরাফ হোটেলের শূণ্যগর্ভকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্টিয়ামে পরিণত হয়েছে।
আর্টিয়াম বানানোর ফলে স্থাপত্যটির অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক আলো, বাতাস চলাচল করে এবং ঘূর্ণায়মান আকৃতি হবার ফলে প্রাকৃতিক বায়ু নিয়ন্ত্রক হিসেবেও কাজ করে এটি। একইসাথে তাপমাত্রা সবসময় একইরকম রাখার চেষ্টা করে এই আর্টিয়াম এবং পরিষ্কার বায়ু চলাচলে এই নান্দনিক নকশা বেশ কাজে দেয়। বেইজিংয়ের অত্যধিক আর্দ্র পরিবেশেও ভবনটির ভেতরে শীতলতা থাকবে বলেই জানা যায়।
১০. মোশন পিকচার একাডেমি যাদুঘর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মাণের শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যাপারগুলো অন্বেষণ এবং গবেষণায় একাডেমি মিউজিয়াম অফ মোশন পিকচার্স হবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। পুরনো ভবনটির নতুন করে সংস্করণ ও সম্প্রসারণের নকশা করেছে প্রিজকার পুরষ্কারপ্রাপ্ত স্থপতি রেনজো পিয়ানো। নতুন ভবনের নকশাটি আসলে ভবনটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বা লক্ষ্যের সাথে মিল রেখে করা হয়েছে।
স্টিলের রিইনফোর্স কাঠামোর উপর ১,৫০০ সমতল, কাঠের ফলকে আটকানো, টেম্পার্ড গ্লাস দিয়ে এক বৃত্তাকার গম্বুজাকৃতির ছাদ গড়ে তোলা হয়েছে। কাচের এই বলয়ের মধ্যে ১ হাজার আসনবিশিষ্ট একটি থিয়েটার আছে, হলিউডের বিখ্যাত সেই পাহাড় দেখা যাবে এই ছাদের কার্নিশ থেকে। ভেতরের সাজসজ্জাসহ প্রায় ৩৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে এই জাদুঘরটি সংস্কারে।
আলোচ্য স্থাপত্য ছাড়াও বিশ্বব্যাপী আরও কিছু স্থাপত্যশৈলী সবার নজর কেড়েছে। সেগুলোর নাম এবং ছবিই চলুন দেখে নেয়া যাক।