বিশেষ ধরনের শৈল্পিকতার কারণে ইসলামি শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলা সারাবিশ্বে অনন্য। মুসলিম শিল্পীরা এই অনন্যতা অর্জন করেছেন জ্যামিতি ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যান্য ধর্ম বা সংস্কৃতির শিল্পের সাথে ইসলামি শিল্প একটা দিক থেকে মোটা দাগে আলাদা। অন্যান্য সংস্কৃতিতে মানুষ বা যেকোনো ধরনের প্রাণীর অবয়ব আঁকা বৈধ হলেও ইসলামি সংস্কৃতিতে তা বৈধ নয়। চিত্রকর বা শিল্পীর কল্পনা থেকে যদি সকল প্রকার প্রাণী বাদ যায়, তাহলে শৈল্পিকতার অনেক কিছুই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তবে মুসলিম শিল্পীরা এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছেন অন্য একটি দিক থেকে। দিকটি হচ্ছে শিল্পকলায় জ্যামিতির ব্যবহার। তারা এই দিকটিকে এতটাই শিল্পমণ্ডিত করে তুলে যে তাদের অভাব ও সীমাবদ্ধতাগুলো পরিণত হয় অনন্য শক্তিতে।
ইসলামি সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই জ্যামিতির প্রয়োগ দেখা যায়। মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার, কবরখানা, প্যালেস, রাজপ্রাসাদ, ইসলাম প্রভাবিত কোনো স্থাপনা, ইসলামি মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তির বাড়িঘর প্রভৃতিতে চমৎকার ইসলামি শিল্পের দেখা পাওয়া যায়।
বিশেষ এই সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় ৮ম শতকে ইসলামের ইতিহাসের শুরুর দিকে। ইতিহাসের এই অংশটি ছিল ইসলামি সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। ইসলামের প্রভাবে প্রভাবিত তৎকালীন আরবরা তাদের পূর্ববর্তী উন্নত সভ্যতার অনেক কিছু আত্তীকরণ করে নিয়েছিল এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গণিত ও বিজ্ঞানে অনেক মৌলিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনও হয়েছিল। পাশাপাশি ইসলামি শিল্পকলায় জটিল জ্যামিতির ব্যবহারও বিকাশ লাভ করেছিল তখন। অবস্থা এমন ছিল যে আরবকেন্দ্রীক একটি শক্তিশালী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারা তৈরি হবার জোর সম্ভাবনা ছিল। ইসলামে প্রভাবিত আরবদের তৎকালের চর্চা যদি পরবর্তীতেও বিদ্যমান থাকতো তাহলে আজকে তারাই থাকতো পৃথিবীর সেরা হিসেবে। কিন্তু কোনো এক বা একাধিক কারণে সেটি হয়নি। আরবরা পিছিয়ে গিয়েছে এই ধারা থেকে।
তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান হয়তো সময়ের সাথে সাথে পুরনো হয়ে যায়, আবেদন হারিয়ে ফেলে, কিন্তু শিল্প সংস্কৃতি তো আর কখনো পুরনো হয় না। শিল্পের উজ্জ্বলতা তো কখনো ম্লান হয় না। ইসলামের স্বর্ণযুগের অন্যতম একটি উজ্জ্বলতা হলো বিশেষ এই শিল্পকলা। ভিন্নধর্মী, জটিল ও অনন্য নকশার মাধ্যমে ফুটে উঠে এই শিল্প। ছাদ, দেয়াল, কার্পেট, টেক্সটাইল প্রভৃতিতে বিস্তৃত নকশার ব্যবহার গড়ে উঠে। নকশাগুলো এমন চমৎকার যে, একটির সাথে আরেকটি মিলিত হলে তারা যে জয়েন্ট তা অনুধাবন করা যায় না এবং মিল দিয়ে দিয়ে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। এমন গুণাবলী শুধু একটি দুটি নয়, হাজার হাজার প্যাটার্নের বেলায় প্রযোজ্য।
দেখতে জটিল হলেও এদের পেছনে আছে অত্যন্ত সাধারণ কৌশল। শুধুমাত্র একটি রুলার ও একটি কম্পাসের সাহায্যে এরকম লক্ষ লক্ষ জটিল প্যাটার্ন তৈরি করা যাবে। বৃত্ত ও সরলরেখা দিয়েই অসীম সংখ্যক জটিল প্যাটার্ন তৈরি করা যায়। এটিই ইসলামী শিল্পীদের অসাধারণত্ব, সাধারণ দুটি যন্ত্র দিয়ে অসাধারণ কিছু তৈরি করে ফেলা। কীভাবে? এটিই বলছি এখানে।
এ ধরনের প্যাটার্নের সবগুলোই শুরু হয় একটি বৃত্ত দিয়ে। এরপর বৃত্তটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। বেশিরভাগ ডিজাইনে বৃত্তকে ৪, ৫ বা ৬ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকটি ভাগ আলাদা আলাদা প্যাটার্ন প্রদান করে। ডিজাইনে বৃত্তের এ ধরনের ভাগকে বলা হয় ‘ফোল্ড’।
ডিজাইনগুলোতে সাধারণত বৃত্ত বা সরলরেখাকে সরাসরি দেখা যায় না। দেখা না গেলেও সেটি করা হয়েছে বৃত্তের মাধ্যমেই। এ ধরনের ডিজাইনে বৃত্ত মূল কংকাল হিসেবে কাজ করে। শরীরের মূল্যবান তন্ত্র কংকালকে যেমন বাইরে থেকে দেখা যায় না, তেমনই এ ধরনের ডিজাইনেও বৃত্তকে সরাসরি দেখা যায় না। একটু অভিজ্ঞ চোখ হলেই বের করা সম্ভব বৃত্তটি কোথাও কোথায় আছে এবং কীভাবে একে বিভক্ত করা হয়েছে।
বেশিরভাগ ডিজাইনেই তারকা সদৃশ অংশ থাকে। তারকার চারপাশে কোনা কিংবা পাপড়ি আকৃতির সজ্জা থাকে। এই সজ্জা বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া সম্ভব এটি কোন ধরনের ফোল্ডে পড়েছে। কোনো তারায় যদি ৬টি কোনা কিংবা ৬টি পাপড়ি থাকে, তাহলে ধরতে হবে এটি সিক্স ফোল্ড ক্যাটাগরিতে পড়ে।
পাপড়ি যদি আটটি থাকে, তাহলে সেটি ফোর ফোল্ড ক্যাটাগরিতে পড়বে। আটটি হলে ফোর ফোল্ডে পড়বে কেন? আসলে চারের ভেতরেই আট আছে। আটের জন্য আলাদা ক্যাটাগরির প্রয়োজন হয় না। বৃত্তকে চার ভাগে বিভক্ত করেই আট ভাগের কাজ করে নেয়া যায়। এভাবে অন্যান্য ফোল্ডগুলোকেও শনাক্ত করা যায়
এ ধরনের ডিজাইনের পেছনে আরো একটি গোপন ও মূল্যবান উপাদান আছে। এদেরকে বলা যেতে পারে ভিত্তি রেখা বা গাঠনিক রেখা। এই রেখাগুলো অদৃশ্য থাকে কিন্তু প্রত্যেকটি ডিজাইনের প্রত্যেকটি ‘একক অংশে’ রেখাগুলো ব্যবহৃত হয়। কাজ শুরু করার আগে রেখা টেনে নিলে একক অংশগুলো একটি আরেকটির মতো হয়। নইলে একটি থেকে আরেকটির মাঝে পার্থক্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ডিজাইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, বড়-ছোট হওয়া, বেখাপ্পা লাগা প্রভৃতি দূর করে এই গাঠনিক রেখাগুলো। গাঠনিক রেখাগুলো নকশাকে তো নিখুঁত রাখেই, পাশাপাশি নতুন নতুন প্যাটার্ন উদ্ভাবনেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
এবার একটি উদাহরণে দেখি কীভাবে এদের সাহায্যে শৈল্পিক নকশা তৈরি করা যায়। প্রথমে অবশ্যই একটি বৃত্ত দিয়ে শুরু করতে হবে। বৃত্তের চারপাশে থাকবে একটি বর্গ। বর্গের চারটি বাহুর কোনোটিকে ছেদ না করে ছুঁয়ে যাবে বৃত্তের চারটি অংশ। অর্থাৎ বর্গের ভেতর চার বাহু স্পর্শ করে থাকবে বৃত্তটি। তারপর একে আটটি সমান ভাগে ভাগ করি। মাপে মাপে এরকম চিত্র আঁকতে হলে কম্পাসের সাহায্য নিয়ে আঁকতে হবে। লেখার শেষ দিকে টেড এডুকেশনের একটি ভিডিও সংযুক্ত আছে, ভিডিওতে এর প্রক্রিয়া সুন্দর করে দেয়া আছে।
এতটুকু পর্যন্ত মূল অংশ। মূল অংশ হবার পরে চাহিদামতো ডিজাইনের জন্য আরো কিছু লাইন টানতে হবে। বৃত্তের যে আটটি অংশে সরলরেখাগুলো ছেদ করেছে সেগুলোকে ভিত্তি ধরে পরের ধাপে প্রবেশ করি। প্রবেশের ধাপকে লাল কালিতে দেখানো হয়েছে। লাল রেখাগুলোকে বলা হয় বিন্যাস রেখা বা কনস্ট্রাকশন লাইন।
হয়ে গেল আমাদের নকশার মূল কংকাল। এখানের যেকোনো ছিন্ন অংশ বা সেগমেন্ট-এর সেট থেকে আমাদের মূল পুনরাবৃত্তির প্যাটার্ন নির্বাচন করতে পারবো। ভিন্ন ভিন্ন সেগমেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে এই বিন্যাসরেখা থেকে অগণিত পরিমাণ প্যাটার্ন পাওয়া সম্ভব। প্রত্যেকটি ডিজাইনই হবে স্বতন্ত্র, একই রকম হবে না কোনোটি। এর মানে দাঁড়ায় শিল্পকলার বিশাল এক বৈচিত্র্য বসে আছে একটি বৃত্ত আর কতগুলো সরলরেখার মাঝে।
একে বিস্তৃত করলে পাওয়া যাবে নিচের এই প্যাটার্নটি। অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত করা যাবে একে। এভাবে বিস্তৃত করাকে গণিত বা ডিজাইনের ভাষায় বলা হয় Tessellation।
সামান্য ভিন্ন ধরনের রেখা নির্বাচন করলে পেতে পারি এরকম কোনো প্যাটার্ন। একটি থেকে আরেকটি ভিন্ন। আক্ষরিক অর্থেই সীমাহীন পরিমাণ প্যাটার্ন পাওয়া সম্ভব এভাবে।
এ তো গেলো ফোর ফোল্ড প্যাটার্নের কথা। সিক্স ফোল্ড প্যাটার্ন আরো বৈচিত্র্যে ভরা। ফোর ফোল্ডের মতোই প্রথমে বৃত্ত নিয়ে তাকে ছয় ভাগে ভাগ করে গাঠনিক রেখা এঁকে চমৎকার প্যাটার্ন তৈরি করা যায়। এই প্যাটার্নকে বিস্তৃত করে দৃষ্টিনন্দন শিল্প পাওয়া যায়।
আরো একটি সিক্স ফোল্ড প্যাটার্নের উদাহরণ দিচ্ছি। এটি শত শত বছর ধরে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিখ্যাত তাজমহল সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত স্থাপনাগুলোতে এই প্যাটার্নের ব্যবহার রয়েছে। এত এত ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু সামান্যতম পুরনোর ছোঁয়া লাগেনি। চিরসবুজ আছে জ্যামিতির এই সৌন্দর্য, থাকবেও চিরসবুজ।
ফোর ফোল্ড প্যাটার্ন বিস্তৃত অনেকগুলো চতুর্ভুজের জালে গঠিত। সিক্স ফোল্ড প্যাটার্ন বিস্তৃত ষড়ভুজের জালে গঠিত। কিন্তু ফাইভ ফোল্ড প্যাটার্ন? চতুর্ভুজ কিংবা ষড়ভুজ যদি একটির সাথে আরেকটি মিলে বিস্তৃত জাল তৈরি করে, তাহলে তাদের মাঝে কোনো ফাঁকা থাকে না। কিন্তু পঞ্চভুজ একটির সাথে আরেকটি মিললে ফাঁকা থেকে যায়। সেজন্য ফাইভ ফোল্ড প্যাটার্নে শুধু পঞ্চভুজ দিয়ে নকশা তৈরি করা যায় না। ফাঁকা অংশের সীমাবদ্ধতা দূর করতে পঞ্চভুজের বাইরে অন্যান্য আকৃতি আনতে হয়। তবে তারপরেও ফাইভ ফোল্ড প্যাটার্ন অনেক সুন্দর ও শিল্পমণ্ডিত হয়।
সেভেন ফোল্ডের প্যাটার্ন তৈরি করা অনেক কঠিন। কঠিন ও ঝামেলাকর বলেই হয়তো এর খুব একটা চর্চা হয়নি শিল্পকলাতে। এরিক ব্রাগ নামে একজন ইসলামি আর্ট বিশেষজ্ঞ নিচের সেভেন ফোল্ডের এই প্যাটার্নটি তৈরি করেছেন।
এরিক ব্রাগের পরিচয় এখানেই শেষ নয়। তিনি ইসলামী জ্যামিতির প্যাটার্ন নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ইসলামী শিল্পকলায় তিনি এতটাই পারদর্শীতা অর্জন করেছেন যে তাকে জীবন্ত কিংবদন্তী বলা যায়। তার নিজের তৈরি করা অনেকগুলো ইসলামী জ্যামিতিক ডিজাইন আছে, যা আগে তৈরি অন্যান্য ডিজাইন থেকে ভিন্ন।
এবার কিছু ইসলামী জ্যামিতিক শিল্পকলার বাস্তব উদাহরণ দেখবো।
ফিচার ছবি- Pinterest