কনফুসিয়ানিজম: ভারসাম্যের প্রতিশ্রুতিতে ধর্মদর্শন

পাঁচজন বৃদ্ধ সাধুপুরুষ সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছেন। পেছনে অদ্ভুত এক প্রাণী। দেখতে ড্রাগনের মতো হলেও মাথায় শিং। যেন ড্রাগন আর ইউনিকর্নের সম্মিলিত রূপ। চীনা সংস্কৃতিতে একে চিলিন বলে। প্রাণীটা ধীরে ধীরে সামনে এসে অবনত করলো মাথা। তারপর মুখ থেকে বের করে দিলো একটা পাথরের টুকরা। তাতে লেখা, ‘তোমার ছেলে হবে মুকুটবিহীন সম্রাট’। গর্ভবতী ছেংচাই এই স্বপ্নটা দেখেছেন কয়েক দফা। আর অচিরেই প্রমাণিত হলো ভবিষ্যদ্বাণী। বিশৃঙ্খল দুনিয়ায় ভারসম্য স্থাপন করতে আগমন করলেন এক অনন্য সম্রাট, কনফুসিয়াস।

বর্তমান বিশ্বের ষাট লাখেরও বেশি মানুষ নিজেদের কনফুসিয় মতবাদের অনুসারী বলে গণ্য করে। অবশ্য অনুসারী তৈরির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বচিন্তায় এই মতবাদের ভূমিকা। আড়াই হাজার বছরেরও আগে কোনো এক ব্যক্তির চিন্তা কীভাবে চীনা ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য এবং মূল্যবোধকে সংহত রূপ দিয়েছে, তা রীতিমত বিস্ময়কর। চীনের কথা বাদ দিলেও জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতিতে এখনো দাগ লেগে আছে কনফুসিয় মতবাদের। পৌঁছে গেছে ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি আফ্রিকার মাটিতেও।

কনফুসিয়াস

মূলত মান্দারিন কং ফুচি নামের ল্যাটিনকৃত উচ্চারণ কনফুসিয়াস। জন্মগ্রহণ করেন ৫৫১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের চৌ সাম্রাজ্যের পতনের যুগে। পিতা কং শুলিয়াং ছিলেন ছোট্ট নগরী সু এর শাসনকর্তা। ধমনীতে তার শাং সম্রাটদের রক্ত। নয় কন্যা আর এক খোড়া পুত্রের পিতা শুলিয়াং শেষ বয়সে উপনীত হয়ে ছেংচাইকে বিয়ে করেন শুধু একটা উত্তরাধিকারের জন্য। ভাগ্য তাকে নিরাশ করেনি। তাদের ঘরেই জন্ম নেয় সেই পুত্র, যে বদলে দেয় গোটা চীনের ভবিষ্যৎ।

বিশ্বের উচ্চতম কনফুসিয়াস মূর্তি, Image Source: theculturetrip.com

মাত্র তিন বছর বয়সে পিতার মৃত্যুতে দরিদ্রতা যেন ঠেসে ধরে পরিবারকে। কনফুসিয়াস জীবনকে খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করতে শেখেন তখন থেকেই। খাদ্য সংগ্রহ করে দিতেন মাকে। অবসরে মজে থাকতেন সংগীতে। নিয়মিত পড়তেন কবিতা। তবে প্রাচীন চীনের বিখ্যাত পাঁচ ক্লাসিক তার জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে। পুস্তকের পাঠ চুকিয়ে সরকারি কর সংগ্রাহক পদে কিছুদিন চাকুরি করেন। নিজের চোখে দেখেন আমলাদের দুর্নীতি এবং কৃষকদের উপর চলমান জুলুম। একদিকে বিদ্যমান অর্থব্যবস্থায় ঘুষের প্রকোপ আর অন্যদিকে ফল ও ফসলে কর দেয়ার কারণে কৃষক পরিবারই অভুক্ত। এই অরাজকতা দেখেই মূলত খোলেন চুন জু নামে এক শিক্ষাকেন্দ্র।

বলতে গেলে তার উদ্দেশ্য ছিল, তরুণরা পরিশুদ্ধ মানুষ হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হবে। লম্বা সময় ধরে সেখানে শেখানো হতো উপাসনা, সংগীত, লেখালেখি, তীর চালনা, রথচালনা এবং গণিত। কনফুসিয়াস একজন ন্যায়পন্থী কল্যাণকামী শাসক চেয়েছিলেন। দক্ষাতা দেখিয়েছেন রাজনৈতিক মীমাংসায়। কিন্তু লু অঞ্চলের ডিউক তাকে কেবল জ্ঞানী হিসেবে দরবারের সৌন্দর্য করেই রাখলেন। হতাশ কনফুসিয়াস বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন যাযাবরের মতো। এই সময়েই দেখা হয় চীনা ইতিহাসের আরেক সিদ্ধাপুরুষ লাওজুর সাথে। এদিকে অচিরেই তার শিক্ষার যথার্থতা প্রমাণ করলো ছাত্র চান ছিউ। তার পরামর্শ আর কৃতিত্বের কারণে লু প্রতিবেশি রাজ্যের উপর বিজয়ী হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪ সালে ঘরে ফেরার দাওয়াত আসলো কনফুসিয়াসের। ঘটনাবহুল জীবনযাপনের পর ৪৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এই মহাপুরুষ।

মতবাদ

নিজেকে নতুন কিছুর প্রবক্তা মনে করতেন না কনফুসিয়াস। নিজেকে ভাবতেন প্রাচীন সাধু পুরুষদের রেখে যাওয়া জ্ঞানের প্রচারক হিসেবে। চিন্তায় প্রাধান্য পেয়েছে নৈতিকতা, ভালোবাসা এবং মানবতাবোধ। একবার এক শিষ্য তাকে প্রশ্ন করে, ‘এমন কোন কাজ আছে, যার মাধ্যমে মানুষের সমস্ত দায়িত্ব পালিত হয়?’ কনফুশিয়াস উত্তর দিলেন, ‘সহানুভূতি। তুমি অন্যের জন্য কখনোই তা করবে না। যা তুমি অন্যের মাধ্যমে নিজের সাথে ঘটতে অপছন্দ করো।’ তার সমস্ত কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তি ও সমাজজীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে ভারসম্য। এজন্য গুরুত্ব পেয়েছে ব্যক্তি-ব্যক্তি এবং ব্যক্তি-রাষ্ট্র সম্পর্কে ন্যায়ের সর্বোচ্চ চর্চা। সমাজের ইউনিট হচ্ছে পরিবার। ব্যক্তির ভেতরে নৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা পরিবারের মাধ্যমেই বিকশিত হয়। ফলে পরিবার বিশেষ স্থান নিয়ে আছে তার চিন্তায়।

গ্রিসে তখনো সক্রেটিস জন্ম নেননি, চীনে তখন কনফুসিয়াসের দরবার জমজমাট; Image Source: chatty.com

কনফুসিয় মতবাদের প্রতিক লি। সৎ ব্যবহার আর ভারসম্যপূর্ণ আচরণ ও ভদ্রতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। গোটা দর্শনের কেন্দ্রে যার অবস্থান। ভদ্রতা বলতে কনফুসিয়াস পাঁচটি গুণের সমাবেশকেই বুঝতেন। সৌজন্যবোধ, মহানুভবতা, সৎ বিশ্বাস, দয়া এবং অধ্যাবসায়। ভদ্রলোক আগে চর্চা করে, তারপর প্রচারে নিমগ্ন হয়। মানুষে মানুষে সম্পর্ককে পাঁচটা শ্রেণিতে ভাগ করেন তিনি। পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-ভাই, বন্ধু-বন্ধু এবং শাসক-প্রজা। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব রয়েছে। গোটা ব্যবস্থায় নারী ছিল যথেষ্ট নিরাপদ। অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী নারীও পরিবারে মর্যাদা নিয়ে থাকবে। পুত্র থাকবে আনুগত্য প্রবণ এবং পিতা দায়িত্ববান। শাসক-প্রজা সম্পর্কটা মূলত পিতা-পুত্র সম্পর্কেরই বিস্তৃত রূপ। রাজ্য যেন বিশাল পরিবারের মতো। প্রজা আনুগত্য আর সম্মান দেখাবে, শাসক প্রমাণ দেবেন দায়িত্ববোধের। মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বদা ত্যাগে প্রস্তুত থাকবেন। কনফুসিয়াসের মৃত্যুর শত বছর পরে চীনে তার মতবাদ রাষ্ট্রীয় বিশ্বাস হিসাবে গৃহীত হয়।

বিবর্তন

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পরে তার শিষ্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তিনি অভ্যন্তরীণ অনুভূতিকে বাহ্যিক আচরণের আত্মা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। অথচ অধিকাংশ উপদেশ শিষ্যদের কাছে হয়ে উঠে নেহায়েত আচারসর্বস্ব। জনৈক শিষ্য মোজি (৪৭০-৩৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তাই সেই পন্থা ত্যাগ করে নিজেই নতুন সহজিয়া ধরার পত্তন ঘটান। একই সময়ে বিস্তার লাভ করে তাওবাদ। কনফুসিয়াস এবং লাওজু- দুইজনেই ভারসম্যের কথা বলেছেন। ফারাক হলো প্রথমজনের কণ্ঠে সামাজিক ভারসম্য মূখ্য আর দ্বিতীয়জনের ভাষায় মূখ্য প্রকৃতিতে অন্তর্নিহিত ভারসম্যের সাথে নিজেকে মেলাতে পারায়।

কনফুশিয়াসের পরে মেনসিয়াসই শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করে মতবাদ বিস্তারে; Image Source: libertarianism.org

কনফুসিয় মতবাদের উত্তরণ ঘটে শিষ্য মেংচি (৩৭১-২৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)-এর মাধ্যমে। ল্যাটিন ভাষায় পরিচিত মেনসিয়াস নামে। সরাসরি কনফুসিয়াসের সান্নিধ্য না পেলেও তার এক নাতির অধীনে লাভ করেন শিক্ষা। প্রজ্ঞা আর বক্তৃতায় সমকালে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন খোদ কনফুসিয়াসের চেয়েও আত্মবিশ্বাসী। মানুষকে নিয়ে আরো বেশি আশাবাদী। তার ভাষ্যে,

সত্যিকার মানুষ সে-ই, যে তার দায়িত্ব পালন করে। সম্পদ আর সম্মানের নেশা যাকে দূষিত করে না। দারিদ্র আর নির্ভরতা যারে পরিবর্তিত করে না। ক্ষমতা যাকে নতজানু করতে পারে না।

মেনসিয়াসের পরেই আগমন করেন শুনচি (২৮৯-২৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। মানুষকে তিনি প্রকৃতিগত ভাবেই লোভী আর অপরাধপ্রবণ বলে মনে করতেন। সৎকর্ম পালনকারীকে পুরস্কার এবং দুষ্কৃতিকারীকে শাস্তি দিয়ে হলেও আলোর পথে আনা জরুরি। তার অনুসারীরাই চিন রাজার পরামর্শক থাকাকালেই রাজ্য বিস্তারের বুদ্ধি দেন। চৌ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন সাম্রাজ্য। ২২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চিন রাজা শিহুয়াংতি বা প্রথম সম্রাট নাম ধারণ করেই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্য শাসনে মনোনিবেশ করতে চান। কিন্তু কনফুসিয়াসের নীতি, ‘শাসক আইন দিয়ে না, নিজে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে শাসন করবে’। কনফুসিয়াসের শিষ্যদের সাথে বিরোধের জেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সম্রাট। কৃষি আর চিকিৎসা বাদে সমস্ত পুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্তত ৪০০ পণ্ডিতকে দেয়া হয় জীবন্ত কবর।

শিহুয়াংতির ক্ষমতা দীর্ঘ হয়নি। তার মৃত্যুর পর অরাজকতার সুযোগে লিও পাং প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত হান সাম্রাজ্য (২০৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ-২২০ খ্রিষ্টাব্দ)। লিও পাং নিজে পণ্ডিতদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্যই কনফুসিয়াসের অনুসারীদের সহযোগিতা নেন। নতুন করে শুরু হয় চর্চা। অবশেষে ১৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট উ তি কনফুসিয় মতবাদকে রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসের মর্যাদা দেন। মৃত্যুর চারশো বছর পর সত্যতা পেলো কনফুসিয়াসের স্বপ্ন।

সম্রাট উ তির আমলেই কনফুশিয় মতবাদ রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করে, Image Source: weekinchina.com

বৌদ্ধধর্ম এবং তাওবাদের মতো প্রভাবশালী মতবাদের সামনেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কনফুসিয়ানিজম। যাজক সম্প্রদায়ের বদলে তাদের ছিল সরকারি কর্তাব্যক্তি এবং পণ্ডিত। ছিল দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, শিল্প, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের নকশাও। ফলে কেবল চীনই না, আশেপাশের দেশগুলোও এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে ধরলো সাগ্রহে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, কোরিয়া, তাইওয়ান এবং জাপানে সৃষ্টি হয় স্বতন্ত্র ধারা।

পুস্তাকাদি

প্রাচীন চীনা জ্ঞানরাজ্যের আলোচিত পাঁচটি ক্লাসিকই কনফুসিয় মতবাদের প্রাথমিক ভিত্তি। সম্রাট উ তি-এর আমলে সরকারি চাকুরি প্রত্যাশী প্রত্যেককেই পুস্তকগুলো পড়তে হতো।

১) ৩০০ কবিতা নিয়ে গ্রন্থ শিচিং। একই সাথে গানও, কারণ সেই সময়ে চীনা কবিতা গাওয়াও হতো। অর্ধেক কবিতার বিষয়বস্তু প্রেম, যুদ্ধ আর কাজ। বাকি অর্ধেক বলতে গেলে দরবারি কবিতা। কনফুশিয়াস নিজেই শিষ্যদের কবিতা মুখস্থ করে ফেলার তাগিদ দিতেন। আবৃত্তি করতেন প্রায়শ।

২) আচার ও উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে রচিত গ্রন্থ লিচি। পুস্তকটিকে আবার তিনটা অংশে ভাগ করা যায়। প্রথমত, চৌ লি বা চৌ সাম্রাজ্যের আমলে আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতি। দ্বিতীয়ত, ই লি বা অভিজাতবর্গের আচারাদি। বিয়ে, ধর্মীয় উৎসর্গ, শেষকৃত্য, তীরচালনা প্রতিযোগিতা এবং ভোজ উৎসবের মতো। শেষ অংশটাই মূলত লিচি। সরকার পরিচালনা, রথ চালনা, রান্না, ঘরোয়া কাজ, শিশুর নামকরণ এবং ব্যক্তির মার্জিত ব্যবহারের পদ্ধতি তুলে ধরা। অবশ্য কনফুশিয়াসের পড়া আর লিচি পরবর্তীতে শিষ্যদের হাতে বিবর্তিত হয়েছে।

৩) আদিম রাজাদের কিংবদন্তি ও ইতিহাস সংবলতি গ্রন্থ শুচিং। উপকথা, কিংবদন্তি আর ইতিহাস মিলে এক অদ্ভুত দ্যোতনা তৈরি হয়েছে সেখানে। চীনে প্রথম সভ্যতার উদ্ভব থেকে শুরু করে চৌ আমলের প্রথম দিক অব্দি। আরো স্পষ্ট করতে বলতে গেলে ২০৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২৫৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।

৪) লু প্রদেশের ইতিহাস নিয়ে রচিত ছুন চিউ। ৭২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮১ খ্রিষ্টপূর্বাদ অব্দি। কনফুসিয়াসের প্রদেশ এই লু। বইটাতে অনেক ইশারাপূর্ণ কথা আছে। শিষ্যদের দাবি, আসলে কনফুসিয়াস নিজেই এই গ্রন্থের রচয়িতা। প্রদেশের সংরক্ষণাগারের নথি ব্যবহার করে লিখেছেন।

৫) লোকজ জ্ঞান আর জ্যোতিষবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ ই চিং। মানব অস্তিত্বের অর্থবাচকতা, প্রাকৃতিক ঘটনাবলির তাৎপর্য এবং ভবিষ্যত বুঝতে এই পুস্তক পাঠ করা হয়। ৬৪টি হেক্সাগ্রাম রয়েছে এখানে। সাথে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা। হেক্সাগ্রামের যেকোনো একটা লাইনের উপর পয়সা ফেলে বা কাঠি রেখে ব্যক্তির পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা হতো। কনফুসিয় মতবাদের অন্যান্য ক্লাসিক পুস্তকের থেকে ব্যতিক্রম। অনেক বেশি আধ্যাত্মবাদ নির্ভর। ফলে বলতে গেলে এই পুস্তকে এসে কনফুসিয় মতবাদ তাওবাদের বিকল্প হিসাবে দাঁড়িয়েছে।

পরবর্তী পুস্তকগুলো সরকারি চাকুরি লাভের জন্য অবশ্যপাঠ্যে পরিণত হয়; Image Source: chinahao.com

পরবর্তী সময়ে নয়া-কনফুসিয় মতবাদের অনুসারীদের মাঝে চারটি পুস্তক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাদের মধ্যে লিচি বা আচারপুস্তক থেকে দুইটা অংশ। তৃতীয়টি দীর্ঘ সময় ধরে শিষ্যদের মাঝে টিকে থাকা কনফুসিয়াসের উপদেশাবলি বা এনালেক্টস্। ৪৯৭টি সংক্ষিপ্ত পঙক্তি নিয়ে আড়াই হাজার বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে পঠিত পুস্তকের তালিকায় আছে। চতুর্থটি মেনসিয়াসের শিক্ষা ও প্রচারণা। এর বাইরে ছং ইয়ং নামের কিতাব পঠিত হয় মধ্যমপন্থা ও ভারসম্য চর্চার পাথেয় হিসেবে।

সংস্কারবিধি

দক্ষিণায়নের দিনে সবচেয়ে বড় উৎসব পালিত হয়। শীতের পরে সূর্যের পুনরায় রাজত্বের শুরু। ইনের আধিপত্যের পরে ক্ষমতায় আসে ইয়াং। উৎসর্গের বেশ কিছু ধরন আছে। শাসক নিজের তত্ত্বাবধানে সকলকে সাথে নিয়ে উৎসর্গ করেন বিপুল পরিসরে। জীবিত করা হয় হাজার বছরের ঐতিহ্য। বিভিন্ন মন্দিরেও তার সম্মানে উৎসর্গ করা হয়। বিপুল না হলেও মোটামুটি মাত্রায়। অন্যদিকে পারিবারিকভাবে উৎসর্গের নিয়ম তো থাকছেই। সবটাই হয় লিচি মেনে, ফলে কালের বিবর্তনেও উৎসর্গের ধরন একই। তিন দফায় কনফুসিয়াসকে স্মরণ করা হয়। প্রথমবার তার জন্মদিন। দ্বিতীয়বার তিনি যখন পণ্ডিত মহলে গুরু রূপে আবির্ভূত হলেন। সবিশেষ, কনফুসিয় মতবাদ যখন রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা পেল।

২০০৫ সালে কনফুসিয়াসের ২৫৫৬তম জন্মদিন পালিত হয়; Image Source: learnreligions.com

কনফুসিয় মতবাদের প্রধান এবং বৃহত্তম মন্দির হলো চুফুর মন্দির। মিং শাসনামলে (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ৪৯ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পুণ্যভূমি। কয়েকশো হলরুম, সুদৃশ্য মূর্তি এবং পাথরে খোদাই করা সাধুগণের বাণী। প্রতি বছর ২৮শে সেপ্টেম্বর পালিত হয় কনফুসিয়াসের জন্মদিন। মানুষ দলে উপদলে এসে নিজের প্রার্থনা করে। প্রতি গ্রামেই স্থানীয়দের উপসনার জন্য নির্মিত হয় মন্দির। তাছাড়া অভিজাত পরিবারের বাড়ির পূর্বপাশে কক্ষ নির্ধারিত থাকে। স্থান ও কাল ভেদে নিবেদনের ধরন ভিন্ন হয়। হওয়াটা স্বাভাবিক।

প্রথম পাঠ হিসেবেই শিশুকে বড়দের প্রতি আচরণ শেখানো হয়। কথা বলতে শেখার সাথে সাথে রপ্ত করানো হতে থাকে ভাষা ব্যবহারের সংযম। ছয় বছর বয়সে চলে সংখ্যা ও দিক সম্পর্কে জ্ঞানদান। ছেলে ও মেয়ে উভয়েই কনফুসিয়াসের এনালেক্টস্ পাঠের ক্ষমতা অর্জন করে। দশ বছর থেকে শুরু হয় ক্লাসিক বইগুলো আয়ত্ব করার তোরজোড়। ছেলেরা বাইরের জ্ঞান অর্জনে লিপ্ত আর মেয়েরা ঘরোয়া। বয়স পনেরো থেকে বিশের মধ্যে ছেলে ও মেয়েকে যথাক্রমে পরিণত পুরুষ ও নারী বলে স্বীকৃতি দেয়া হয় উৎসবের মধ্য দিয়ে। বিয়ের পুরো ক্ষমতা থাকে পাত্র ও পাত্রী পক্ষের অভিভাবকদের হাতে। পারিবারিক বন্ধনকে সুস্থ ও ভারসম্যপূর্ণ করতে সম্পর্কিত সকলের উপর অর্পিত হয় দায়িত্ব। বিপরীতে, প্রিয়জনের মৃত্যুতে তিন মাস ব্যাপী চলে শোক সন্তপ্ত আত্মীয়ের আচারাদি পালন।

তারপর

নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদের দৌরাত্ম, ইউরোপীয়দের আগমন এবং কম্যুনিজমের উত্থানের পরেও একবিংশ শতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কনফুসিয় মতবাদ। বর্তমানে চীনা সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের আদলে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট স্থাপন করে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। চীনা সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলছে কনফুসিয়াসের জীবন-দর্শন।

কনফুসিয়াস নিজেকে ব্যর্থ মনে করতেন। নিজেকে অভিহিত করতেন ‘গুপ্ত অর্কিড’ নামে; যার প্রস্ফুটিত হওয়া মানুষ দেখতে পায় না। অথচ তিনি জানতেন না নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে। তার মৃত্যুর পরে তিন বছর জুড়ে শিষ্যরা কেবল সমাধিতে বসে আহাজারি করেছে। নিবেদিত হয়েছে তার দেয়া দায়িত্ব পালনে। পৃথিবীকে বদলে দেবার দায়িত্ব। তারা পুরোপুরি সফল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো চীনা ব্যক্তিই উস্তাদ কনফুসিয়াসের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেননি। আজ আড়াই হাজার পরে তার সমাধির দৃশ্যই সেই সাক্ষ্য বহন করে।

This Bengali Article is about Confucianism, the most influential Philosophy that originated from the soil of China and still dominating far-east Asia. Here is a brief introduction to its belief and development.

References:

1) Confucianism, Dorothy and Thomas Hoobler, Chelsea House Publishers, Third Edition. 2009, New York

2) An introduction to Confucianism, Xinzhong Yao, Cambridge University Press, New York, 2000

3) The Great Religions of the world, Edward J Jurji, Princeton University Press, 1967, Pages-142 

4) https://www.worldhistory.org/Confucianism/

and Which are hyperlinked.
Featured Image: crcs.ugm.ac.id

Related Articles

Exit mobile version