উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর আরবি ভাষাভাষী জনগণকে নিয়ে অনেকের মনেই একটা প্রশ্ন আছে- তারা কি আফ্রিকান, নাকি আরব? ভৌগলিক দিক থেকে উত্তর আফ্রিকা পরিষ্কারভাবেই আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। সেদিক থেকে এর আরবি ভাষাভাষী জনগণও আফ্রিকান। কিন্তু জাতিগত দিক থেকে?
জাতিগত দিক থেকে উত্তর আফ্রিকার জনগণের এক অংশ নিঃসন্দেহে আরব। সপ্তম শতকে ইসলাম প্রচারের জন্য আরবরা যখন উত্তর আফ্রিকায় অভিযান চালায়, তারপর থেকে তাদের অনেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে। কালক্রমে ব্যবসায়িক এবং প্রশাসনিক কারণেও আরব উপদ্বীপ থেকে অনেকে উত্তর আফ্রিকায় পাড়ি জমায়। বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার জনগণের একটা অংশ তাদেরই বংশধর।
কিন্তু এই অংশটা কম। মরক্কো, আলজেরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বর্তমানে যে বিপুল সংখ্যক আরবি ভাষাভাষী জনগণ বসবাস করে, তাদের অধিকাংশই আরবদের বংশোদ্ভূত আরব না। তারা মূলত আরবিকৃত স্থানীয় জনগোষ্ঠী। কালের আবর্তনে তারা আরবি ভাষা এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করে আরব হয়ে গেছে। উত্তর আফ্রিকার এই স্থানীয় জনগোষ্ঠী, যারা আরবদের আগমনের পূর্বে হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূমিতে বসবাস করে আসছিল, এরাই আমাজিঘ (Amazigh, বিকল্প বাংলা বানান আমাজিগ) নামে পরিচিত।
উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকার দশটি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই আমাজিঘরা এসব এলাকায় বসবাস করে আসছে অন্তত ১০,০০০ বছর ধরে। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি এবং সভ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা আজও টিকে আছে তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতির স্বকীয়তা নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় প্রতিটি দেশে তারা আজও অবহেলিত, বঞ্চিত এবং অস্বীকৃত। এমনকি নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার, নিজেদের নববর্ষ পালনের অধিকারের জন্যও তাদেরকে সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে।
বহির্বিশ্বের আমাজিঘদের পরিচিতি মূলত তাদের ইংরেজি নাম বার্বার (Berbers) হিসেবে। শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ বার্বারোস থেকে, যার অর্থ বর্বর। গ্রিকরা মূলত তাদের নিজেদের দেশের বাইরের সবাইকেই বার্বারোস হিসেবে অভিহিত করত। পরবর্তীতে রোমান এবং আরবরাও শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু ঋণাত্মক অর্থের কারণে আমাজিঘরা নিজেরা এই নামে পরিচিত হতে পছন্দ করে না। নিজেদেরকে তারা আমাজিঘ বলেই অভিহিত করে। দাবি করা হয়, তাদের ভাষা তামাজিঘ্ত অনুযায়ী ‘আমাজিঘ’ শব্দটির বা এর বহুবচন ‘ইমাজিঘেন’ শব্দটির অর্থ ফ্রি পিপল (মুক্ত মানব) বা নোবেল পিপল (সৎ মানুষ)।
আমাজিঘদের বসবাস উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকার বিশাল এলাকা জুড়ে। পূর্বে মিশর-লিবিয়া সীমান্তের সিওয়া মরুদ্যান থেকে শুরু করে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত এবং উত্তরে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূল থেকে দক্ষিণে প্রায় নাইজার ও সেনেগাল নদী পর্যন্ত সুবিশাল এলাকা জুড়ে আমাজিঘদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই এলাকার মধ্যে আছে ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামিক মাগরেব নামে পরিচিত লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো এবং মৌরতানিয়া, ছাড়াও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, মালি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো এবং মিশরের কিছু অংশ। প্রায় ৭০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এই বিশাল বাসভূমি তামাজিঘ্ত ভাষায় তামাজঘা নামে পরিচিত। বিভাজিত না হলে তামাজঘা হতে পারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র।
বর্তমানে অবশ্য এসব এলাকায় আরবিকৃত আমাজিঘরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, শত শত বছর আগেই আরবি ভাষা আত্মীকরণ করে নেওয়ার কারণে যারা নিজেদেরকে আর আমাজিঘ হিসেবে বিবেচনা করে না। এখনও যারা নিজেদেরকে আমাজিঘ হিসেবে বিবেচনা করে, অর্থাৎ যাদের এখনও যাদের মাতৃভাষা তামাজিঘ্ত অথবা অন্য কোনো আমাজিঘ উপভাষা, তাদের অবস্থান বর্তমানে এই তামাজঘার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকায়। প্রতিটি রাষ্ট্রেই আমাজিঘরা বর্তমানে সংখ্যালঘু। এবং অধিকাংশ রাষ্ট্রেই তাদের অবস্থান পাহাড়ি বা মরুময় এলাকায়।
নির্ভরযোগ্য আদমশুমারি না হওয়ার কারণে আমাজিঘ জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না। তারপরেও ধারণা করা হয়, তামাজঘা অঞ্চলের দেশগুলোতে বর্তমানে মোটামুটি ৩ থেকে ৪ কোটি আমাজিঘ বসবাস করে। এরমধ্যে মরক্কোতেই আছে প্রায় দেড় কোটি, আলজেরিয়াতে আছে প্রায় সোয়া এক কোটি, মৌরিতানিয়াতে প্রায় ২৮ লক্ষ, নাইজারে প্রায় ১৬ লক্ষ, মালিতে প্রায় ৮ লক্ষ, লিবিয়াতে প্রায় ৩-৪ লক্ষ এবং তিউনিসিয়াসহ অন্যান্য দেশে আরও কয়েক লক্ষ করে। মরক্কোতে আমাজিঘদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ, এবং আলজেরিয়াতে প্রায় ২৫ শতাংশ। এর বাইরেও ফ্রান্সসহ ইউরোপের কিছু দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমাজিঘ প্রবাসী বাস করে।
লিবিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশে প্রাচীন গুহায় আঁকা চিত্রকর্ম থেকে বোঝা যায়, এসব অঞ্চলে আমাজিঘদের বসবাস অন্তত ১০-১২ হাজার বছর ধরে। তবে লিখিত আকারে তাদের সম্পর্কে প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় প্রায় ৩,৩০০ বছর আগের মিশরীয় লিপিতে। মিশরীয়দের মতোই সে সময় আমাজিঘরা প্রধানত সূর্য এবং চন্দ্র দেবতার পূজা করত। তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতির সাথেও মিশরীয়দের ধর্ম এবং সংস্কৃতির বেশ মিল ছিল।
পাশাপাশি এলাকা হওয়ার কারণে লিবিয়ার আমাজিঘদের সাথে মিশরীয়দের ব্যবসায়িক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু একইসাথে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতাও ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের দিকে লিবিয়ান আমাজিঘ গোত্র মেশওয়েশের সদস্যরা ধীরে ধীরে মিশরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে এবং সেখানকার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে এই মেশওয়েশ গোত্রের আমাজিঘ রাজা প্রথম শোশেঙ্ক মিশরের ফারাও হিসেবে দ্বাবিংশতম রাজবংশের সূচনা করে। এটি ছিল প্রথম কোনো আমাজিঘের সর্বোচ্চ অর্জন।
অবশ্য এর বিপরীতে প্রাচীনকাল থেকেই আমাজিঘরা নিজ ভূমিতে বহিঃশত্রুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে এসেছে। কার্থেজিনিয়ান, রোমান, গ্রিক, ভ্যান্ডাল এবং বাইজেন্টাইনরা প্রত্যেকেই আমাজিঘদের এলাকা আক্রমণ করে তাদের উর্বর ভূমিতে বসতি স্থাপন করার চেষ্টা করেছে। এরকম ক্ষেত্রে আমাজিঘরা শহরগুলো শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে মরুভূমিতে কিংবা পাহাড়ে-পর্বতে পালিয়ে যেত এবং এরপর সেখান থেকে পুনরায় সংগঠিত হয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করত।
সপ্তম শতকে মুসলমানরা যখন উত্তর আফ্রিকায় অভিযান পরিচালনা করে তখন আমাজিঘরা প্রথম ইসলামের এবং সেই সাথে আরবদের সংস্পর্শে আসে। আরবদের সাথে আমাজিঘদের সম্পর্ক ছিল পূর্বের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্কের তুলনায় ভিন্ন। আরবদের সাথেও কিছু কিছু আমাজিঘ গোত্রের যুদ্ধ হয়েছে, রানী কাহিনাসহ অনেকেই আরবদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু মোটের উপর বাইজেন্টাইনদেরকে পরাজিত করার জন্য আমাজিঘরা মুসলমান আরবদের অভিযানকে স্বাগতই জানিয়েছিল।
স্থানীয় আমাজিঘদের সহায়তায়ই মুসলমানরা বাইজেন্টাইনদেরকে পরাজিত করে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা নিজেদের করতলে নেয়। পরবর্তীতে যখন মুসলমানরা ইউরোপের দিকে নজর দেয় এবং ইবেরিয়া দ্বীপপুঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে, তখন তাদের সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশই ছিল নতুন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা এই আমাজিঘরা। যে মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ প্রথম জিব্রাল্টার পাড়ি দিয়ে স্পেনের ভিসিগথ সাম্রাজ্য জয় করেন, তিনি নিজেও ছিলেন একজন আমাজিঘ, এবং তার ৭,০০০ সৈন্যের বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যও ছিল আমাজিঘ।
আমাজিঘদের উত্তর আফ্রিকা ছিল আরবের মুসলিমানদের সাথে একদিকে নতুন জয় হওয়া মুসলিম স্পেন, অন্যদিকে সাব-সাহারান আফ্রিকার সাথে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আমাজিঘরা অল্প সময়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিল। এরপর ধর্ম প্রচার, রাজ্য জয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আরবদের সংস্পর্শে থেকে থেকে তাদের অনেকেই ধীরে ধীরে আরব হয়ে ওঠে। অবশ্য প্রায় সকল আমাজিঘ সুন্নি মুসলমান হলেও শেষ পর্যন্ত সবাই আরব হয়নি। আর মুসলমানদের বাইরে প্রচুর আমাজিঘ ইহুদিও ছিল আফ্রিকাতে, যারা পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর সেখানে পাড়ি জমায়।
মুসলমানদের শাসনামলে আমাজিঘরা তাদের পৃথক ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি বজায় রেখে, আরবদের সাথে মিলেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। এ সময় তারা নিজেরাও মোরাভিদ (আল-মুরাবেতুন), আলমোহাদ (আল-মুয়াহ্হেদুন) সহ একাধিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবংসাহিত্য, সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যে উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ সাধন করে। কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তারা দুর্বল হয়ে আসে। স্পেনে মুসলমানদের পতনের ষোড়শ শতাব্দীতে উসমানীয়রা যখন উত্তর আফ্রিকা জয় করে নেয়, তখন আমাজিঘরা ধীরে ধীরে ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে সরে যায়।
তবে আমাজিঘদের, বিশেষ করে আলজেরিয়া এবং মরক্কোর সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাজিঘদের ভাগ্যে চূড়ান্ত বিপর্যয় নেমে আসে উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনামলের সময় থেকে। ১৮৩০ সালে ফরাসিরা যখন আলজেরিয়া আক্রমণ করে, তখন স্থানীয় ক্যাবায়ল আমাজিঘরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কয়েকমাসের মধ্যেই রাজধানী আলজিয়ার্সের পতন ঘটলেও আমাজিঘদের ঘাঁটি ক্যাবায়লিয়া পার্বত্য অঞ্চল দখল করতে ফরাসিদের সময় লেগে যায় দীর্ঘ ৩০ বছর।
ক্যাবায়লিয়া দখল করার পর ফরাসিরা আলজেরিয়াতে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি প্রচলনের লক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদের তুলনায় আমাজিঘদেরকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাজিঘরা তা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের লড়াই চালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
একইভাবে মরক্কোতেও ফরাসি এবং স্প্যানিশ ঔপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রিফ অঞ্চলের আমাজিঘ গোত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মরক্কোর কিংবদন্তী গেরিলা নেতা আব্দুল করিম আল-খাত্তাবি, যাকে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়, যার রণকৌশল অনুপ্রাণিত করেছিল মাও সে তুং, হো চি মিন এবং চে গুয়েভারাকে, সেই খাত্তাবিও ছিলেন একজন আমাজিঘ।
কিন্তু স্বাধীনতার জন্য আমাজিঘদের এই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন স্বাধীনতা-পরবর্তী আলজেরিয়া এবং মরক্কোর আরব শাসকগোষ্ঠী করেনি। ডিকলোনাইজেশনের অংশ হিসেবে সর্বক্ষেত্রে ফরাসি ভাষাকে অপসারণ করে তারা আরবি প্রচলন করতে গিয়ে দেশগুলোর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেবলমাত্র আরবিকেই স্বীকৃতি দেয়। ফলে আড়ালে চলে যায় আমাজিঘদের মাতৃভাষা। এছাড়া আরব জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় ঐক্যের নামেও তারা দেশের ভেতরে বিভিন্ন জাতির মধ্যকার স্বাভাবিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে দেশগুলোকে কেবল আরব পরিচয়ে পরিচিত করানোর চেষ্টা করে।
তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশরসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রেও একই চিত্র দেখা যায়। সেসব দেশেও আরব জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ স্বৈরশাসকরা আমাজিঘদের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে জোরপূর্বক দমন করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাজিঘ ভাষা চর্চার কোনো সুযোগ না রেখে তাদেরকে বাধ্য করা হয় আরবিতে পড়াশোনা করতে। লিবিয়া, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশে এমনকি শিশুদের আমাজিঘ নামও রেজিস্ট্রেশন করতে দেওয়া হতো না। প্রকাশ্যে কোথাও আমাজিঘ লিপি প্রচার করতে দেওয়া হতো না। আমাজিঘদেরকে তাদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির চর্চা করতে হতো অনেকটাই গোপনে।
এই উগ্র আরব জাতীয়তাবাদ এবং আরবিকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অনেক সময়ই আমাজিঘরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে। এরকম একটি প্রতিবাদ থেকেই ১৯৮০ সালে আলজেরিয়ার ক্যাবায়েল এলাকায় সংঘটিত হয় আমাজিঘ স্প্রিং। তার ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় আমাজিঘ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস, যাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র উত্তর আফ্রিকার আমাজিঘদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা।
১৯৯৮ সালে আমাজিঘ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস আমাজিঘদের জন্য একটি পতাকা নির্ধারণ করে। আমাজিঘদের নির্দিষ্ট কোনো দেশ নেই, এবং আমাজিঘ অ্যাক্টিভিস্টরা সেরকম কোনো দেশ দাবিও করে না, কিন্তু তারপরেও তাদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিটি দেশের আমাজিঘদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে পতাকাটি।
তিন রঙের এই পতাকার উপরের নীল রং হচ্ছে সমুদ্রের প্রতীক, মাঝের সবুজ রং হচ্ছে উর্বর পাহাড়ি সবুজ ভূমি, এবং নিচের হলুদ রং হচ্ছে সাহারা মরুভূমি। আর মাঝখানের লাল প্রতীকটি হচ্ছে তামাজিঘ্ত ভাষা লেখার জন্য যে তিফিনাঘ (Tifinagh) বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়, সেই বর্ণমালার একটি বর্ণ, ইয়াজ (ⵣ)। দেখতে দুই হাত-পা দুই দিকে ছড়িয়ে রাখা এই প্রতীক আমাজিঘ তথা মুক্ত মানুষকে নির্দেশ করে।
আমাজিঘদের নিজস্ব একটি ক্যালেন্ডারও আছে। কিছু কিছু আমাজিঘ যাযাবর এবং শিকারী হিসেবে জীবন যাপন করলেও অধিকাংশই মূলত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে হাজার হাজার বছর ধরেই তারা নববর্ষ পালন করে আসছে, যদিও পূর্বে তারিখটি নির্ধারিত ছিল না। পরবর্তীতে রোমানদের শাসনের সময় আমাজিঘরা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী বর্তমানের জানুয়ারির ১৩ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে নির্ধারণ করে।
আমাজিঘদের নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু হয় জানুয়ারির ১২ তারিখে এবং শেষ হয় ১৩ তারিখে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ইয়ানায়ের। এটি একইসাথে আমাজিঘ ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসেরও নাম। ধারণা করা হয়, ইয়ানায়ের শব্দটি এসেছে তামাজিঘ্ত শব্দ ইয়েন এবং আইয়ুর থেকে। ইয়েন অর্থ এক এবং আইয়ুর অর্থ মাস। সেই হিসেবে ইয়ানায়ের (জানুয়ারি) অর্থ বছরের প্রথম মাস।
ষাটের দশকে আমাজিঘরা প্রথম তাদের ক্যালেন্ডারের জন্য শূন্য বর্ষ নির্ধারণ করে। আর এই শূন্য বর্ষকে নির্ধারণ করার জন্য তারা বেছে নেয় তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অর্থাৎ লিবিয়ান আমাজিঘ রাজা শোশেঙ্কের ক্ষমতা গ্রহণের বছরকে। হিব্রু বাইবেলে শিশাক নামে মিশরের এক ফারাওর নাম উল্লেখ আছে, ধারণা করা হয় এই শিশাকই হচ্ছেন আমাজিঘ রাজা শোশেঙ্ক। সে হিসেবে এটিই হচ্ছে কোনো আমাজিঘ ব্যক্তি সম্পর্কে লিখিত সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক দলিল।
একেই মানদণ্ড হিসেবে নিয়ে শোশেঙ্কের ক্ষমতায় আরোহণের বছরকে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ সালকে প্রথম বর্ষ হিসেবে ধরে এরপর আমাজিঘদের ক্যালেন্ডারে বছর গণনা করা হয়। সেই হিসেবে এ বছর (২০২১ সালে) ১২ জানুয়ারি আমাজিঘরা ২,৯৭১ তম নববর্ষকে বরণ করে নিবে।
দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকলেও গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে আমাজিঘদের ভাগ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ২০০০ সালে দ্বিতীয় আমাজিঘ স্প্রিং তথা আমাজিঘ ব্ল্যাক স্প্রিং আন্দোলনের পর আলজেরিয়ার সরকার তামাজিঘ্তকে সাংবিধানিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় মরক্কোও তামাজিঘ্তকে সাংবিধানিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
যদিও এখনও যথেষ্ট না, কিন্তু মূলত আরব বসন্তের পর থেকে কিছু কিছু স্কুলে তামাজিঘ্ত ভাষা পড়ানোর সুযোগ চালু করা হয়েছে। এছাড়াও মরক্কোতে এখন সরকারি বিভিন্ন ঘোষণা আরবির পাশাপাশি তামাজিঘ্ত ভাষাতেও প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়াও রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সাইনবোর্ডেও ক্রমশ আরবির পাশাপাশি তামাজিঘ্ত ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারপরেও আমাজিঘদেরকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হচ্ছে অধিকতর অধিকার আদায়ের জন্য। ২০১৭ সালে আলজেরিয়াতে আমাজিঘ নববর্ষকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য দেশের আমাজিঘরা এখনও নববর্ষের ছুটি, তামাজিঘ্তকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং স্কুলে তামাজিঘ্ত ভাষা শেখানোর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
ভাষা এবং সংস্কৃতির বাইরে আমাজিঘদের সাথে উত্তর আফ্রিকার আরব জনগোষ্ঠীর পার্থক্য খুব বেশি না। সকলের ধর্মই ইসলাম। এবং যদিও আমাজিঘদের ঐতিহ্যবাহী রঙিন নকশাযুক্ত পোশাক, তাদের খাদ্যাভ্যাস, নারীদের মুখে ট্যাট্টু অঙ্কনের সংস্কৃতি দেশগুলোর মূল আরবিকৃত জনগোষ্ঠীর তুলনায় ভিন্ন, কিন্তু সে ভিন্নতাও অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ভিন্নতার মতো প্রকট না। যেহেতু এই আরবিকৃতরা নিজেরাও কয়েকশো বছর আগেও আমাজিঘই ছিল, তাই উভয়ের জীবনযাত্রায় যথেষ্ট মিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
আমাজিঘরা কুর্দিদের মতো পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী না। ভৌগলিক বিবেচনায় সেটা বাস্তবসম্মতও না। তারা কেবল নিজেদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতেই আগ্রহী। এবং এই দাবি তাদের ন্যায্য অধিকার। রাষ্ট্রে যদি ন্যায় বিচার থাকে, যদি সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়, কাউকে বঞ্চিত করা না হয়, তাহলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ধারণ করেও জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখা যায়।