ধর্মের প্রধান অঙ্গ বিশ্বজগতের মূল শক্তিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের আকুতি। এই আকুতির উৎস সবার জন্য এক না। গীতা সেই নিবেদক শ্রেণিকে চারটি স্তরে উপস্থাপন করেছে- আর্ত, অর্থার্থী, ভক্ত এবং জিজ্ঞাসু। বিপদে পড়ে যে স্রষ্টার সাহায্য প্রার্থনা করে, সে আর্ত। বিপদ না পড়েও নেহায়েত নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য যে পরম সত্তার দ্বারস্থ হয়, সে অর্থার্থী। ভক্ত আরো উচ্চ স্তরের মানুষ, তার কোনো প্রয়োজন বা ইচ্ছা নেই। কেবল শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই উপাসনা করে। সবিশেষ জিজ্ঞাসু চায় পরম সত্তাকে জানতে। আকাঙ্ক্ষার এই বিভেদের কারণে আসে বেদ-বিদ্যাতেও বিভক্তি।
“ব্রহ্মবিদরা বলে থাকেন, দু’টি বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে – পরা এবং অপরা। অপরাবিদ্যা হলো ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, এবং জ্যোতিষ। আর পরাবিদ্যা হলো তাই, যার দ্বারা ব্রহ্মকে অধিকার করা যায়।” (মুণ্ডক উপনিষদ, প্রথম খণ্ড, ৫)
উক্তিতে বৈদিক সাহিত্যের সম্পূর্ণ তালিকা বর্ণিত, যা দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগে আছে ব্রহ্মবিদ্যা – অর্থাৎ, বিশ্বের মধ্যে যে অবিনাশী সত্ত্বা প্রচ্ছন্নভাবে ক্রিয়াশীল, তার জ্ঞান। এই শ্রেণির জ্ঞান উপনিষদ নামে পরিচিত। উপনিষদ অর্থ, যা এক প্রান্তে অবস্থিত। বেদের প্রান্তে অবস্থিত বলে একে বেদান্তও বলা হয়। বৈদিক সাহিত্যের অপর ভাগে পড়ে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান। প্রথমে আছে চারটি বেদ- ঋক, সাম, যজু এবং অথর্ব। পরবর্তীতে আছে শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ। তাই মোটা দাগে বেদকে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলা হলেও তা মানবজ্ঞানের আদি ভাণ্ডারও বটে।
বেদ
বিদ্ ধাতু থেকে নির্গত বেদ শব্দের অর্থ পরমজ্ঞান। চোখ, কান, নাক, জিভ এবং ত্বক- এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে আমরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, কল্প, রস ও স্পর্শের জ্ঞান অর্জন করি। একে ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান বা পার্থিব জ্ঞান বলে। এর মধ্য দিয়ে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান লাভ সম্ভব না, পরম সত্য ইন্দ্রিয়ের উর্ধ্বে। যার মধ্য দিয়ে আমরা অতীন্দ্রিয়ের জ্ঞান লাভ করি, তা-ই বেদ। ধর্ম এবং তার সাথে সম্পর্কযুক্ত কর্ম, কর্মের ফলস্বরূপ যজ্ঞ এবং যজ্ঞের ফলস্বরূপ স্বর্গ, পরলোকত্ব, অদৃষ্ট ইত্যাদির জ্ঞান বেদ থেকেই অর্জিত হয়; অর্জিত হয় ব্রহ্ম এবং মোক্ষের জ্ঞানও।
ভারতীয় আর্যদের কাছে বেদ সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক গ্রন্থ, স্থান সকলের উপরে। ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকা না থাকা এখানে বিশেষ দোষের কিছু নয়, কিন্তু বেদে অবিশ্বাস ক্ষমার অযোগ্য। ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখেও বেদে অবিশ্বাসী হবার দরুণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক বলে অখ্যাত হতে হয়। অন্যদিকে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস নিয়েও কেবল বেদে বিশ্বাস রেখে অনেকেই আস্তিক সাব্যস্ত হন।
গোড়ায় বেদের লেখ্য রূপ ছিল না। গুরুশিষ্যের মাধ্যমে প্রবাহিত হতো অন্তর থেকে অন্তরে। এইজন্য বেদের আরেক নাম শ্রুতি। পরবর্তীতে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সূক্তগুলো কাঠামোবদ্ধ করেন। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পাণিনি বেদকে অভিহিত করেছেন ‘ছন্দস’ নামে। ঋক, সাম, যজু – এই ত্রিবিদ মন্ত্রের দরুণ বেদকে ত্রয়ীও বলা হয়। বেদের যে মন্ত্রগুলোতে অর্থ অনুসারে ছন্দ ও পাদব্যবস্থা আছে; সেই মন্ত্রকে ঋক বলা হয়। ঋকের মধ্যে আবার যেগুলো গীতিযুক্ত বা গাওয়া যায়, তাদের বলা হয় সাম। এই ঋক ও সাম লক্ষণ ছাড়া বাকি সব ঋক ও যজুঃ মন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।
বিন্যাস
বেদ নিয়ে আলোচনায় তার প্রাচীনত্ব মনে রাখা জরুরি। বেদের যুগে উপাসনা রীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। প্রকৃতির বুকে যেখানে ঋষিশক্তি বা সৌন্দর্য্যের উৎস আবিষ্কৃত হয়েছে, তার উপরেই দেবত্ব আরোপ করে বর্ণিত হয়েছে স্তোত্র। এই স্তোত্রের নাম হলো সূক্ত। অনেকগুলো মন্ত্র নিয়ে সূক্ত নির্মিত; আর সূক্ত নিয়ে গঠিত বেদের মূল অংশকে বলা হয় সংহিতা। সূক্তগুলো রচিত প্রাচীন ভাষায়। বেদে ব্যবহৃত হয়েছে বলে তা ‘বৈদিক ভাষা’ নামে খ্যাতি পেয়েছে। আবার, শ্রদ্ধা নিবেদন কেবল মন্ত্র পাঠেই হয় না, তার জন্য কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। বৈদিক যুগে সেই আচারাদি স্বীকৃত হতো যজ্ঞ নামে।
যজ্ঞের বিভিন্ন ধরণ আছে। কীভাবে পালিত হবে, কতদিন স্থায়ী হবে প্রভৃতি। বিভিন্ন যজ্ঞের বিধিনিষেধ এবং সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া যেখানে বর্ণিত আছে, তার নাম ব্রাহ্মণ। সুতরাং সংহিতা অংশের সূক্তগুলি এবং ব্রাহ্মণ অংশের বিধিনিষেধগুলি নিয়েই বেদ গঠিত। আবার, ব্রাহ্মণ অংশের অন্তিম ভাগকে আরণ্যক বলে। আর সেই আরণ্যকের অন্তিম অংশকে বলা হয় উপনিষদ। অর্থাৎ আরণ্যক এবং উপনিষদ মূলত ব্রাহ্মণেরই অংশ। তারপরও তাদের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য আছে।
ইতঃমধ্যে অনেক সংজ্ঞাই যেহেতু স্পষ্ট, আরেকটু ভেতরে যাওয়া বোধহয় অনুচিত হবে না।
মন্ত্র, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদকে সামগ্রিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে – কর্মকাণ্ড এবং জ্ঞানকাণ্ড। যজ্ঞ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে কর্মকাণ্ড গঠিত। বেদের সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ অংশ এর অন্তর্ভুক্ত। জ্ঞানকাণ্ড গঠিত ব্রহ্মতত্ত্বের বিষয় আলোচনা নিয়ে। এর অন্তর্ভুক্ত উপনিষদ। আরণ্যকের অবস্থান এদের মধ্যবর্তী; কারণ, তাতে কর্ম এবং জ্ঞান দুই-ই ঠাঁই পেয়েছে। প্রতি বেদের সাথে সংযুক্ত ব্রাহ্মণ আছে; কিন্তু প্রতি বেদের সাথে যুক্ত আরণ্যক থাকে না। যেমন, অথর্ববেদের একটি ব্রাহ্মণ থাকলেও কোনো আরণ্যক নেই।
আবার, যে বিষয়গুলো বেদ পাঠ ও যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সাহায্য করে, তাদের বলা হয় বেদাঙ্গ। ষড়বিংশ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, ‘চারটি বেদ হলো শরীর, আর ছয়টি বেদাঙ্গ হলো তাদের অঙ্গ।’
-
প্রথম বেদাঙ্গ শিক্ষা, বেদের সংহিতা অংশই প্রধানত শিক্ষার আলোচ্য বিষয়।
-
দ্বিতীয় বেদাঙ্গ ব্যাকরণ, মন্ত্রকে যজ্ঞে প্রয়োগ করার সময় কোন কোন ক্ষেত্রে লিঙ্গ, বিভক্তি, সন্ধি প্রভৃতি ব্যাকরণের প্রয়োগ ঘটে।
-
তৃতীয় বেদাঙ্গ ছন্দ, মন্ত্র পাঠের সাথে ছন্দ স্বাভাবিকভাবেই জরুরি হয়ে পড়ে; কারণ, বেদের মন্ত্রগুলো ছন্দবদ্ধ।
-
চতুর্থ বেদাঙ্গ নিরুক্ত, পদকে অর্থ ভেঙে ব্যাখ্যা করাই নিরুক্ত। এটি ব্যাকরণের পরিপূরক। ব্যাকরণের সম্পর্ক শব্দ নিয়ে; আর নিরুক্তের সম্বন্ধ অর্থের।
-
পঞ্চম বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত হয় অহোরাত্র, পক্ষ, মাস, ঋতু, অয়ন এবং সংবৎসর গণনা করে। ফলে জ্যোতিষের ভূমিকা ব্যাপক।
-
ষষ্ঠ বেদাঙ্গের নাম কল্প, তাতে আছে যজ্ঞের প্রয়োগবিধি এবং গার্হস্থ জীবনের সংস্কার নিয়ে আলোচনা।
বেদপাঠ
সঠিক ও সম্যকভাবে বেদের মন্ত্র জানতে হলে শুধু আক্ষরিক অর্থ জানলেই হবে না। জানতে হবে বেদমন্ত্রসমূহের ঋষি, ছন্দ, দেবতা, ব্রাহ্মণবাক্যের অর্থসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়। বেদমন্ত্রের দর্শককে ঋষি বলে। কথাটাকে আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, তপস্যারত ব্রহ্মনিষ্ঠ ঋষিগণ ব্রহ্মের দয়ায় বেদমন্ত্র দর্শন করেছিলেন। যিনি যে মন্ত্র দর্শন করতেন, তিনি সেই মন্ত্রের দ্রষ্টা বা ঋষি। ঋষিরা কিন্তু বেদ মন্ত্রের কর্তা নন। কারণ বেদ অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোনো মানুষের রচিত নয়। যার সৃষ্টি আছে, তার বিনাশ আছে। বেদ এই সৃষ্টি-বিনাশের চক্র থেকে মুক্ত।
বেদের প্রতি মন্ত্রে দেবতার জ্ঞান অতি যত্ন সহকারে অর্জন করা আবশ্যক, দেবতা বিষয়ক জ্ঞান জন্ম নিলেই প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম হবে। প্রতিটি মন্ত্র একজন দেবতাকে উৎসর্গ করে বর্ণিত। সেই মন্ত্র দ্বারা নির্দিষ্ট সেই দেবতাকে আহবান বা স্তুতি করা হয়। এতে তারা খুশি হয়ে মনের বাসনা পূরণ করেন। দেব শব্দের অর্থ: যিনি দান করেন কিংবা যিনি নিজে প্রকাশ পেয়ে অন্যকে প্রকাশিত করেন। সচ্চিদানন্দস্বরূপ আত্মচৈতন্যই দেবতাগণের প্রকৃত রূপ। বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন রূপে তারা সেই এক অব্যক্ত অদৃশ্য পরম ব্রহ্মেরই প্রকাশ মাত্র। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে –
একং সৎ বিপ্র বহুধা বদন্তি
অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহু।অর্থাৎ সেই এক অখণ্ড সৎ ব্রহ্মকে বিপ্রগণ বহু প্রকার নামে অভিহিত করেন। যথা – অগ্নি, যম এবং মাতরিশ্বা (বায়ুর অন্য নাম)।
ধ্যানস্থ থাকার সময় বৈদিক ঋষিগণের নিকট মন্ত্র যখন প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন তারা যে স্পন্দন অনুভব করেন, তা-ই ছন্দ। বেদে ছন্দের সংখ্যা মোট ৭টি। গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্ঠুপ, বৃহতী, পঙক্তি, ত্রিষ্টুপ এবং জগতী। বেদমন্ত্রের মোট অক্ষরসংখ্যা গুনে ছন্দ নির্ণয় করা হয়। তাই বেদের ছন্দকে অক্ষরছন্দও বলা হয়ে থাকে। অক্ষর মানে বর্ণ না, পদাংশকে বোঝায়। আবার, কোন যজ্ঞে কোন মন্ত্রের প্রয়োগ হবে, তা নির্ধারণ করাকে বলা হয় বিনিয়োগ।
পরবর্তী যুগে যেন পাঠবিকৃতি না ঘটে, এজন্য ঋষিগণ বেদের বিশুদ্ধতা রক্ষায় বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেন। ঋষি শৌনক ‘চরণব্যূহ’ গ্রন্থে প্রতিটি বেদসংহিতার সূক্ত সংখ্যা, ঋক সংখ্যা, ঋকের পদসংখ্যা এবং সংহিতার অক্ষর সংখ্যা পর্যন্ত লিখে রেখে গেছেন। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের পদক্ষেপ বিস্ময়কর।
যা হোক, এগারোভাবে বেদ পাঠ করা যায়। তার মধ্যে প্রকৃত পাঠ তিনটি; বাকিগুলো বিকৃত। প্রকৃত তিনটির নাম – সংহিতা পাঠ, পদ পাঠ এবং ক্রম পাঠ। বেদমন্ত্রসমূহ ঠিক যেভাবে সংহিতায় পাওয়া যায়, সেগুলোকে অবিকল একইভাবে সন্ধিযুক্ত, সমাসবদ্ধ করে যথাযথভাবে পাঠ করাকেই সংহিতা পাঠ বা বেদ পাঠ বলে।
সময়
বেদের ভাষা বিশ্লেষণ করে একটা নির্দিষ্ট কালের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঠিক নির্দিষ্ট কাল নিয়ে মতবিরোধ আছে অবশ্য। জাপানের কাকাসু ওকাকুরা সুবিখ্যাত দ্য আইডিয়ালস্ অব দ্য ইস্ট গ্রন্থে দাবি করেছেন, বৈদিক যুগের বিস্তৃতি ৪,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। বেদ সংকলিত হয় মহাভারত যুগের শেষ দিকে। অনেকেই মহাভারতের ঘটনাকে দুই হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে বর্ণনা করেন। ইংরেজ ভারতবিদ এফ. ই. পার্জিটার পুরাণে বর্ণিত রাজাদের তালিকা ঘেঁটে মহাভারতের সময়কাল ৯৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে দাবি করেন। আলাদাভাবে বেদের ব্রাহ্মণ অংশে প্রাপ্ত তথ্য থেকে উপসংহারে পৌঁছেছেন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী। সে হিসাবে মহাভারতের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ।
ঋগ্বেদের বয়স আলোচনা করতে ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত টেনেছেন খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০-১০০০ অব্দে। বৈদিক ভাষা আর প্রাচীন পারসিক আবেস্তার ভাষায় রয়েছে বিস্ময়কর সাদৃশ্য। আগে উভয় জনগোষ্ঠী একসাথে বসবাস করতো, উভয় ভাষাও একটা সাধারণ ভাষা থেকে উৎসারিত। আসলে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষারও অদ্ভুত মিল আছে। উদাহরণস্বরূপ, সংস্কৃত ‘পিতৃ’ শব্দটি ল্যাটিনে প্যাটের, ইংরেজিতে ফাদার, জার্মানে ফাটার এবং ফরাসিতে প্যা’র। যাহোক, গৌতম বুদ্ধের সময় বেদ ও উপনিষদ সুগঠিত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই গঠনের জন্য বয়স তিন-চারশ’ বছর পিছিয়ে ১০০০ অব্দে টানা খুবই সম্ভব।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্য জাতি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। স্থানীয় নগরসভ্যতাকে পরাজিত করে থিতু হয় নিজেরা। ঋগ্বেদের সূক্তগুলোতে এই সংঘর্ষের ছায়াপাত আছে। নগরসভ্যতার মানুষেরা ছিল শান্তিপ্রিয় ও দুর্বল; অন্যদিকে আর্যরা ছিলেন দুর্ধর্ষ ও যাযাবর প্রকৃতির। ফলাফল তাই একরকম পূর্বনির্ধারিত। তার উপরে অনার্যদের অনেকেই ভয়ে, ভক্তিতে কিংবা লোভে আর্যদের হয়ে কাজ করেছে। লঙ্কাযুদ্ধে রামের পক্ষের বানর সেনা, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব – এরা সবাই দেশীয়। বিভীষণ মানেই নিজ দেশের শত্রু; অনেকটা পলাশী যুদ্ধে মীর জাফরের মতো যেন তার ভূমিকা।
ভারতে প্রবেশ এবং বসতি স্থাপনের পরে ঋগ্বেদ রচনা শুরু করতে কয়েক শতক সময় লাগা স্বাভাবিক। এভাবে হিসাবে করে বেদের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী বলে ধরে নেয়া হয়।
অনুবাদ ও গবেষণা
বিদেশী পণ্ডিতদের মধ্যে বেদের অনুবাদে প্রথম হাত দেন ল্যাটিন ভাষার পণ্ডিত অধ্যাপক রোজেন। ১৮৩০ সালে ঋগ্বেদের কয়েকটি মন্ত্র অনুবাদ করেন তিনি। অল্প হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮৪৬ সালে বেদের সাহিত্য ও ইতিহাসের উপর পুস্তিকা প্রণয়ন করেন রুডলফ রথ। তা ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয় রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে। এরপর এগিয়ে আসলেন পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার। ১৮৭৭ সালে সমগ্র ঋকসংহিতা রোমান হরফে প্রকাশ করলেন, সঙ্গে শব্দসূচিও ছিল। আস্তে আস্তে ইউরোপিয়ান পণ্ডিতদের মাঝে বেদ গবেষণা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। মার্টিন হগ, আলফ্রেড লুদভিগ, ব্লুমফিল্ড, লুই রেনু এবং হিলেব্রান্ট স্ব স্ব ভাষায় বেদ নিয়ে গবেষণা ও অনুবাদ করেছেন।
ভারতীয় পণ্ডিতেরা এগিয়ে গিয়েছিল আরো কয়েক ধাপ। শিবরাম শাস্ত্রী, দয়ানন্দ সরস্বতী, রাম গোবিন্দ ত্রিবেদী, রঘুবীর, ক্ষেমকরণ ত্রিবেদীর মতো অনেক পণ্ডিতেরাই বেদের বিভিন্ন অংশ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন। অনেকে গবেষণা করেছেন বৈদিক সাহিত্য ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে। চিন্তামনি বিনায়ক বৈদ্য ১৯৩০ সালে প্রকাশ করেন ‘বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাস’। ঋগ্বেদের ইতিহাস ও সমাজচিত্রের উপর অবিনাশ চন্দ্র দাস রচনা করেন ‘Rigvedic India’ এবং ‘Rigvedic Culture’ নামে দুটি বই। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনকে বিষয়বস্তু করে হয় আলোচনা। যুক্ত হয় আরো অনেক নাম।
বাঙালি পণ্ডিতদের অবদানও নেহায়েত কম না এখানে। ঋগ্বেদের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন রমেশচন্দ্র দত্ত। তবে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন আচার্য সত্যব্রত সামশ্রমী। ‘বৈদিক গ্রন্থ প্রত্ন’ নামে একটা মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু পণ্ডিত তার প্রশংসা করেছেন। রাজেন্দ্র লাল মিত্র এবং দুর্গাদাস লাহিড়ীর বেদ গবেষণা বেশ স্পষ্ট। পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী, চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার, ড. অমরেশ্ব ঠাকুরের মতো অনেক নামও পাওয়া যাবে সেই তালিকায়।
শেষের আগে
বেদ কেবল ধর্মগ্রন্থ নয়, জীবনচক্রের এক অনন্য দলিলও বটে। সেই যুগের সমাজ বিন্যাস, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানুষের বিভিন্ন বৃত্তি, সমাজে নারীর স্থান, রাজনৈতিক টানাপোড়েন প্রভৃতি তথ্য বেদের বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকেই সংগ্রহ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু ধর্মে ঋষির অবস্থান সবার উপরে। ঋগ্বেদে অন্তত সাতজন নারী ঋষির নাম পাওয়া যায়। নারী ঋষিগণের মধ্যে বিবাহ সূক্তের ঋষি সূর্যা অন্যতম। এ থেকে তৎকালীন নারীর সামাজিক অবস্থা নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও হৃদয়বৃত্তিকে অবলম্বন করেই মানুষের ধর্মবোধ অঙ্কুরিত হয়। মানুষ প্রতিকূলতায় সহায় খোঁজে, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বৃহৎ শক্তির সাহায্য কামনা করে। অবলম্বনের এই আকৃতিই হলো ধর্মবোধের বীজ। পরিণত হয়ে উঠার সাথে সাথে বিস্তার লাভ করে ভক্তি ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা। এইজন্য বেদ পাঠের সময় মানব ইতিহাস এবং মানব অস্তিত্বের ক্রমপরিবর্তনকে মনে নিয়েই পাঠ করতে হয়। কখনো একেশ্বরবাদ, কখনো সর্বেশ্বরবাদ, আবার কখনো নিরেশ্বরবাদে চিন্তাধারা প্রবাহিত হলেও তার আদি অবস্থান বেদেই চিহ্নিত। এইজন্যই বলা হয়, বেদ মানবজ্ঞানের আদি ভাণ্ডার।
অনলাইনে কিনুন- বেদ সমগ্র অখণ্ড