Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অঞ্জন দত্ত: গানে যার জীবনের অন্যরকম ছোঁয়া

গান শুধু গান নয়, একেকটি গল্প। জীবন থেকে সেঁচে আনা খন্ড খন্ড ঘটনা কিংবা অতীতের জঞ্জাল, নস্টালজিয়া। খুব রাতে ঘুম করে গেলেও জেগে থাকার মতো তন্দ্রা, জমে যাওয়া হোমটাস্ক, ডায়াল করা রং নাম্বার, তিনশো বছরের শহরে প্রেমিকের কাঁধে প্রেমিকার মাথা রাখার হয়তো একটিই জায়গা।

অঞ্জন দত্ত, জীবনমুখী বাংলা গানের অন্যতম পথিকৃৎ; Source: dailynews365.com

১২ই মে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে, সেইসাথে ফিরে আসে ফেলে যাওয়া মালার পুরনো প্রেমিকের পাগলামি প্রলাপও। সে প্রশ্ন করে,

“তোমার সাজানো শরীরের ভেতরে, মালা তুমি কার?”

এ উত্তর মালা নিজেও দিতে পারে না। অনুত্তরের আফসোস নিয়েই কোনো এক শ্রোতা তার প্লেলিস্টের পরের গানটিতে যান। এখানে হয়তো বেলা বোসকে খুঁজে চলছে সদ্য চাকরি পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়া প্রেমিকটি। কিন্তু হায়, বেলা বোস কই? রং নাম্বারের সারিতে একটিই খোঁজ,

“হ্যালো…এটা কি ২৪৪১১৩৯? দিন না ডেকে বেলাকে একটিবার/ মিটারে যাচ্ছে বেড়ে এই পাবলিক টেলিফোনে, জরুরি খুব জরুরি দরকার!”

বেলা বোস কি কাঁদছে? সে কি শুনছে? নাকি শুনেও না শোনার ভান করছে! জানা হয় না, রয়ে যায় আরেক আঁজলা আক্ষেপ।

ঘুরতে ঘুরতে চলে যাওয়াই যায় ‘দাস কেবিন’ এ। সপ্তাহের একেকদিন একেক যুগল হানা দেয় এখানে। পকেটের ভার বুঝে সময় কাটায় তারা। আর কোথাও যাওয়া হয় না, প্রেমে নিমজ্জিত হবার বিলাসিতা করার আর কোনো ঠাঁই পায় না তারা, তাই তো অঞ্জন দত্ত গেয়ে ওঠেন “জায়গা নেই যে আমাদের আর কোনো এই তিনশো বছরের শহরে”। জায়গা নেই, একদম জায়গা নেই! জায়গা নেই বলেই, “রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দু’জনে/ রুদ্ধশ্বাস কত প্রতীক্ষা!”

‘চালচিত্র’ সিনেমায় অঞ্জন দত্ত; Source: chasingcinema.com

তিনি আক্ষেপ আঁকেন, আফসোসের সুরে প্রাণদান করেন, চোখ বন্ধ করে ডুবে থাকা শ্রোতার কানে নয়, মনে ঢেলে দেন গল্পের নির্যাস। এক এক করে তারা সবাই আমাদেরও চেনা হয়ে যায়। মনে হয় পুরনো চেনাজানা মানুষের কথাই বলা হচ্ছে। প্রশ্নও যে জাগে না এমন নয় তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে!

বেলা বোসের কি দেখা হয়েছিলো প্রেমিকটির সঙ্গে? ভেঙে কি দিতে পেরেছিলো মায়ের আনা সেই সম্বন্ধটি? নাকি সে-ও মালারই মতন ছেড়ে গিয়েছে, নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে বিদেশী উপহারে? বেলা বোসও কি মালারই মতন “রোজ রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে” কোথাও চলে যায়, ফেলে আসা দিনগুলোতে?

“মা গো আমার মা গো জানি, অনেক কষ্ট পাবে তুমি/ তবু আমার নেই কোনো উপায়…” ট্যাক্সিতে বসে থাকা প্রেমিকের হাত ধরে পালাতে চাওয়া মেয়েটি মাকে চিঠি লিখেছিলো। নাম তার রমা। রমা কি পেরেছিলো সেদিন পালাতে? নাকি বাবা-কাকার পছন্দের বরের হাতেই পরতে হয়েছিলো সিঁথির সিঁদুর? জিজ্ঞাসা রয়েই যায়, উত্তর মেলে না। তবু বারবার জানা গল্প শোনা হয়, যদি একবার গল্পের শেষটা জানা যায়- এ আশায়।

“ছোট্টবেলার প্রেম, আমার কালো মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে?” বুকফাটা আর্তনাদে মেরি অ্যানকে সে দেখে রিকশায় দুলে দুলে যেতে। মেরী অ্যানের “হাত দুটো গেছে ক্ষয়ে, গাল দুটো গেছে ঝুলে, নিয়মিত অবহেলায়”। রিপন স্ট্রিট আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকা মেরী অ্যানের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ কমেনি ছেলেটির। তবে সেদিনও যেমন পারেনি ধর্ম-বর্ণের গণ্ডি পেরিয়ে ঐ কালো হাত দুটো ধরতে। এ যে কি অপূর্ণতা, এ যে কি স্বপ্নভঙ্গ, তা শুধু অঞ্জন দত্তের গানেই ছুঁয়ে যায় হৃদপিন্ড।

অঞ্জন দত্তের গানে দেখা দেয় কত না চরিত্র; Source: imgum.org

“একটা সবুজ রঙের সালোয়ার, জয়িতা/ একটা কোনোমতে টিকে থাকা সংসার…জয়িতা!”

জানালার এপাশ থেকে প্রেমে পড়া জয়িতার, তাকিয়ে দেখা তার ভঙ্গুর সংসার। জয়িতার জীবন সংগ্রামের অংশ হওয়া হয় না, নীরব দর্শক হয়েই থেকে যেতে হয়। একদিন জয়িতা জানালার পাশে টেবিলটাতে পড়তে বসাও ছেড়ে দেয়, ওপাশে কতখানি দীর্ঘশ্বাস পড়ে কে জানে! কে জানে ওপাশের হাহাকার কতখানি তীব্রতা পায়? আবারো অপূর্ণতা, আবারো শেষ না হওয়া গল্প। আবারো অঞ্জন দত্ত। গানের নয়, জীবনের গল্পের ফেরিওয়ালা।

“রঞ্জনা আমি আর আসবো না, তাই দুপুরবেলাতে ঘুমিও। আসতে হবে না আর বারান্দায়” বলা ছেলেটির না আসার পেছনে তার ভীরুতাই হয়তো ধরা পড়ে, “বুঝবো কী করে তোমার ঐ মেজদাদা শুধু যে তোমার দাদা নয়!” কিন্তু দিনশেষে ঘরে ফিরে এই ছেলেটিই যখন বলে, “সত্যিকারের প্রেম জানি না তো কী তা, যাচ্ছে জমে হোমটাস্ক/ লাগছে না ভালো আর মেট্রো চ্যানেলটাও, কান্না পাচ্ছে সারারাত!” তখন নিজের কৈশোর প্রেম মনে করে কত রঞ্জনা, কত হোমটাস্ক জমানো কান্না পাওয়া ছেলে নিজেকে গুলিয়ে ফেলে গানের সাথে, কে জানে? জানা হয় না তা-ও। রয়ে যায় চিরচেনা গানগুলো, রয়ে যায় অঞ্জন দত্তের গানের প্রতি শ্রোতৃসমাজের আপাদমস্তক মুগ্ধতা।

‘অন্তরীন’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Source: mrinalsen.org

মুগ্ধতা বাড়তে বাধ্য হয়, যখন গল্পের রচয়িতা নিজেই গল্পে শামিল হন। অঞ্জন দত্তের অভিনয়গুণের প্রকাশও আমরা বেশ কয়েকবার দেখেছি ‘একদিন আচানক’, ‘যুগান্ত’, ‘অন্তরীন’, ‘নির্বাক’, ‘জানি দেখা হবে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘দেখা’, ‘মিস্টার এন্ড মিসেস আইয়ার’ সহ আরো বেশ কিছু সিনেমায়। মৃণাল সেনের পরিচালিত ‘চালচিত্র’তে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। এই অভিনয়ের জন্য তিনি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা নবাগত অভিনেতার পুরষ্কার অর্জন করেন। এছাড়া অঞ্জন দত্ত পরিচালনা করেছেন ‘দ্য বং কানেকশন’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’, ‘চলো…লেট’স গো’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘শেষ বলে কিছু নেই’, ‘মনবাক্স’ (এখনও মুক্তি পায়নি) ইত্যাদি সহ ব্যোমকেশ সিরিজের বেশ কিছু সিনেমা ।

তার জন্ম হয় ১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি। ‘দার্জিলিংয়ের রাস্তা’ গান গাওয়া অঞ্জন দত্ত বেড়ে উঠেছিলেন দার্জিলিংয়েরই রাস্তায়। সেখানকার পাহাড়ের ধারে সেইন্ট পল’স স্কুলে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। শৈশবস্মৃতির প্রতি আবেগমন্থন থেকেই তিনি ‘দার্জিলিংয়ের রাস্তা’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন ২০১৩ সালে। তিনি নিজেই বলেন, সিনেমাটি তার গল্প দিয়েই তৈরি।

অঞ্জন দত্ত একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, গায়ক, অভিনেতা, সাংবাদিক।  তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন আর্ট ফিল্মের ধারাতেই, তাই একসময় কাজের অভাবের কারণে তাকে কলকাতাভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ এ সাংবাদিকের কাজ নিতে হয়। এতেও অবশ্য তার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরো সমৃদ্ধই হয়, তবু বাণিজ্যিক মাত্রার দিকে কোনো আগ্রহ দেখাননি অঞ্জন দত্ত।

‘অসময়’ অ্যালবাম; Source: gaana.com

সে সময়ই বাংলা গানের জগতে অন্যধারার গানের আবির্ভাব ঘটে কবীর সুমনের হাত ধরে। এই স্বতন্ত্র ধারাটিকেই ‘জীবনমুখী বাংলা গান’ বলা হয়। এই পথ ধরে হেঁটেছেন কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত ও নচিকেতা চক্রবর্তী। কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা, অপূর্ণতাকে গানের কথায় তুলে ধরা হয় জীবনমুখী এই গানগুলোতে। খুব কম সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ মানুষ অন্য যেকোনো ধারার গানেই চাইতে এর সাথে বেশি নিজেকে সংযুক্ত করে নিতে পারে। নামেই যার ‘জীবন’ জড়িয়ে আছে, সে তো জীবনকে ছোঁবেই। জীবনমুখী বাংলা গানে জীবনকে ছুঁতে এলেন অঞ্জন দত্তও।

তবে অঞ্জন দত্তের গান জীবনমুখী গানের ধারার মধ্যেও স্বতন্ত্র একটি সত্ত্বায় অবস্থান করে। তার গায়কীতে লোকসঙ্গীত, দেশীয় গান, ব্লু’স (উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সঙ্গীতের একপ্রকার ধাঁচ), ব্লু গ্রাস (আমেরিকার লোকসঙ্গীতের একটি গড়ন) এর প্রভাব লক্ষণীয়।

অঞ্জন দত্ত থেমে নেই, একে একে যোগ করে চলছেন তার অর্জনের পংক্তিমালা। তিনি আরো এগোবেন। আরো অনেক চরিত্র, অনেক গল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন তার ভক্তকূলকে।

ফিচার ইমেজ- youtube.com

Related Articles