বাংলা ভাষায় কতো রকমের প্রবাদ যে প্রচলিত আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, মাঠে-ঘাটে লাখো মানুষের মুখে ঘুরে ফেরে হাজারো প্রবাদ। অঞ্চলে অঞ্চলে প্রবাদের যে কতো রকমফের আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে কিছু প্রবাদ-প্রবচন আমাদের অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে বাঙালি সত্তা থেকে তাকে আর আলাদা করার জো নেই। শুধু বাংলাদেশের বাংলাদেশিদের মাঝেই নয়, কলকাতার বাঙালিদের মধ্যেও তা সমানভাবেই সমাদৃত।
কেউ যদি আপনার কাছে ভালো কোনো কাজে টাকা চায়, আর আপনার কাছে টাকা থাকে তাহলে কি একবারের জন্য হলেও হাসতে হাসতে আপনি বলবেন না- ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’? এখন প্রশ্ন হলো কে এই গৌরী সেন যে সবাইকে এতো টাকা দিয়ে বেড়ায়? এমন একটা বিখ্যাত একটা মানুষকে প্রতি মুহূর্তে আমরা মুখের কথা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি ঠিকই, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় জানার বেলায়ই আমাদের যত উদাসীনতা। এই উদাসীনতা দূর করে আজ তবে জেনে নেয়া যাক গৌরী সেন, বনলতা সরকার, হরি ঘোষ, উমিচাঁদ, গোবিন্দমিত্র মিত্র ও হুজুরীমলের কথা।
গৌরী সেন
১৭ শতকে বাংলার বুকে বিচরণ করতেন গৌরী সেন, তার জন্মসালটা খুব সম্ভবত ১৫৮০। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার ব্যালী মোরের বান্ডেল চার্চের নিকটেই তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা। কারো কারো মতে অবশ্য জায়গাটা হুগলী নয়, মুর্শিদাবাদের বহররমপুর। নন্দরাম সেনের সুযোগ্য পুত্র গৌরী সেন। মজার ব্যাপার হলো, শাহরুখ খানের স্ত্রী গৌরীর কথা মাথায় রেখে অনেকেই গৌরী সেনকে নারী বলেই জানেন। যার কাছ থেকে এতো টাকা আশা করছেন, তার সম্পর্কে একটু তো ঠিকঠাক মতো জানা প্রয়োজন!
জন্মসূত্রে গৌরী সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। মূলত ব্যবসায়ের সাথেই জড়িত ছিলেন তার পূর্বপুরুষ। সেই সূত্রেই পারিবারিক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি আর তরতর করে উঠে যান সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। ব্যবসায়িক চক্রগুলোতে দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। কেউ কারো কাছ থেকে ঋণ করেছে কিংবা কেউ সময়মত বেতন না পেয়ে দেনায় জর্জরিত হয়ে আছে, এমন খবর পেলেই তিনি দেদারসে সেই অসহায় ব্যক্তিদের অর্থ দান করতেন। যেমন বিপুল পরিমাণে আয় ছিল তার, ঠিক তেমনি দু’হাত ভরে খরচ করতেও কার্পণ্যবোধ করতেন না গৌরী সেন। তাই তো গোটা বাংলায় এক নামে তিনি মুক্তহস্তে অর্থ দানকারী প্রবাদ পুরুষ বলে গেছেন। সেই আমল থেকে যে লোকে বলা শুরু করেছে ‘টাকা যা লাগে দেবে গৌরী সেন’, এখনো পর্যন্ত তার চল যায়নি। তবে ২০১৭ সালে এসে আমরা যতই বলি না কেন টাকা দেবে গৌরী সেন, তা কিন্তু আদতে সম্ভব নয়। কেননা ১৬৬৭ সালেই তিনি পৃথিবীতে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। অনেকে মনে করেন হুগলীতে তার জন্মস্থানের কাছে নির্মিত গৌরীশঙ্কর শিবের মন্দিরটি তারই কীর্তি। অবশ্য এ কথার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
হরি ঘোষ
১৭২০ সালে বঙ্গে জন্মগ্রহণ করা হরি ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান, বর্তমান সময়ে যাকে আমরা ম্যানেজার বলি। যোগ্যতার দিক থেকে অবশ্য সেই আমলে তার ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না। বাংলা, ফারসি এবং ইংরেজি ভাষার উপর ভালো দখল ছিল তার। কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর কলকাতাতেই গাঁটছড়া বাঁধেন তিনি।
গৌরী সেনের মতো অগাধ সম্পদের অধিকারী তিনি ছিলেন না। তারপরও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজকল্যাণের জন্য বেশ ভালোই দান করেন হরি। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে যাওয়া দরিদ্র যেসব ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হতো না, তারা সবাই হরি ঘোষের উত্তর কলকাতার বাড়িতে লজিং থাকতেন। বাড়ির কাচারি ঘরটাকে তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন মুক্ত বুদ্ধির জ্ঞানচর্চা ও আলোচনার জন্য। প্রতিদিন বিকালে হরি ঘোষের বৈঠকখানায় অসংখ্য মানুষ এসে বসতেন আর রাতের না খাবার না খাইয়ে তাদের কাউকে ছাড়তেন না তিনি। সেখান থেকেই স্থানীয় লোকজন মজা করে হরি ঘোষের বৈঠকখানার এই আড্ডার নাম দেয় ‘হরি ঘোষের গোয়াল’। এখনো পর্যন্ত এই কথাটি বেশ প্রচলিত। ১৮০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন জনহিতৈষী এই সমাজসেবক।
বনমালী সরকারের বাড়ি
গোবিন্দরাম মিত্রর ছড়ি
উমিচন্দের দাড়ি
হুজুরীমলের কড়ি
কে না জানে?
মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এই ছড়াটিই বা কে না জানে? এই ছড়ার সাথে মিশে থাকা চরিত্রগুলো রয়ে যায় আমাদের চেনা-জানার পরিধির বাইরে।
বনমালী সরকার
‘বনমালী তুমি পর জনমে হইও রাঁধা’- এই বনমালী আর সেই বনমালী মোটেই এক নন। বনমালী সরকার বিখ্যাত তার বাড়ির জন্য। ব্রিটিশ আমলে তিনি পাটনার প্রথম ‘দেওয়ান’ ছিলেন। পরবর্তীতে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘ডেপুটি ট্রেডার’ পদে আসীন করা হয় তাকে। তার গ্র্যান্ড হাউজটি কুমারটুলিতে অবস্থিত। ১৭৪০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে বাড়িটি নির্মাণ করেন বনমালী সরকার।
গোবিন্দরাম মিত্র
বনমালী সরকারের বাড়ির পরেই চলে আসে গোবিন্দরামের ছড়ির কথা। মাথার উপরে ছড়ি ঘোরানো বলতে যেমন কারো উপর আধিপত্য বিস্তার করা বোঝায়, ঠিক তেমনি গোবিন্দরাম মিত্রর ছড়ি বলতে তার ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে বোঝানো হয়। ব্রিটিশ আমলে গোবিন্দরাম ছিলেন একদম শুরুর দিককার একজন ভারতীয় কর্মকর্তা। নিজ যোগ্যতাবলে তিনি বিপুল অর্থ এবং দাপটের অধিকারী হন।
উমিচাঁদ বা উমিচন্দ
এবার পালা উমিচন্দের দাড়ির। উমিচন্দ বা উমিচাঁদের আরেকটি নাম ছিল আমিনচন্দ বা আমিনচাঁদ। তিনি মূলত একজন শিখ ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসার উদ্দেশ্যে অমৃতসর থেকে কলকাতায় চলে আসেন তিনি, তখন ব্রিটিশরা ভারতে মাত্র পা রেখেছে। বলা হয়, ভারতে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য স্থাপনের পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন উমিচাঁদ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ব্যবসা করে বিস্তর অর্থের মালিক হন তিনি। মৃত্যুর সময় সম্পত্তির পুরোটাই তিনি দান করে যান ধর্মীয় কাজের উদ্দেশ্যে। লর্ড ক্লাইভের হাতে ভারত ও নিজেকে সঁপে দেয়ার জন্য তিনি এক প্রকার কুখ্যাত হয়েই থাকবেন। শিখ এই ব্যবসায়ী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী দাড়ি রাখতেন। কলকাতার লোকজনের মধ্যে দাড়ি রাখার তেমন চল ছিল না বলে উমিচাঁদ তার এই দাড়ির জন্যই বহুল পরিচিত ছিলেন।
হুজুরীমল
হুজুরীমল উমিচাঁদেরই শিখ একজন বন্ধু ছিলেন। ছড়ার শেষের দিকে উল্লেখ করা হয় তার কড়ি বা টাকার কথা। উমিচাঁদের মতোই তিনিও ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভালো দাও মেরে ব্যাপক অর্থের মালিক হন। তবে তিনি তার অর্জিত সম্পদের পুরোটাই জনকল্যাণকর কাজে ব্যয় করেন। জনগণের স্বার্থে তিনি বৈঠকখানা এলাকায় একটি ট্যাংক, হাওড়া ব্রিজে দক্ষিণে স্নানঘাট (পূর্বে তা আর্মেনিয়ান ঘাট নামেই পরিচিত ছিল), আর্মেনিয়ান চার্চের চূড়া, কালীঘাটের কালী মন্দিরের কাছে একটি ঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করেন। শিখ হওয়া সত্ত্বেও কলকাতার লোকজনের প্রতি তার ভালোবাসার কারণে তিনিও লোকের হৃদয়ে এবং মুখে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।
সমসাময়িক হওয়ায় এই কয়টি চরিত্রের কথা আমরা সহজে জানতে পারি। কলকাতায় কিংবা তার আশেপাশে অথবা আমাদের এই বাংলাদেশেই হয়তো বিরাজ করেছিলেন আরও উল্লেখযোগ্য কোনো চরিত্র। হুজুরীমলের মতো তিনি মানুষের সেবাও করতে পারেন, উমিচাঁদের মতো দেশকে বেচেও দিতে পারেন। নতুন করে কখনো তদের কথা জানতে পারলে পাঠকদেরকেও তা জানানোর চেষ্টা হবে।
তথ্যসূত্রঃ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বোস সম্পাদিত ‘সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান’, প্রথম খণ্ড।
ফিচার ইমেজ- bp.blogspot.com