বর্তমানে সংগীতাঙ্গনে আমাদের যে শক্তপোক্ত অবস্থান তা নিশ্চয়ই একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে হাজার মানুষের পরিশ্রম ও ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প। ছোট ছোট অনেক প্রাপ্তির সমষ্টি হয়ে বর্তমানে আমাদের এই সংগীত জগত। পেছনের দিকে ফিরলেই দেখা মিলে অনেক অনেক গুনী শিল্পীর, যাদের অসামান্য সব কাজ আমাদের সংগীত জগতে যুক্ত করেছে অসামান্য সব মাইলফলক। এসব শিল্পীর নাম হয়তো আজকের দিনে তেমনভাবে সমাদৃত নয়, কিন্তু তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারদের হাতেই বর্তমানের সংগীত জগতের চাবিকাঠি তা বলতে মানা নেই। এমনই এক অতি পরিচিত, অসম্ভব গুণী, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী ও সংগীত পরিচালক এবং অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা শিল্পী সমর দাস।
বর্তমানে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার নবদ্বীপের বসাক লেন এলাকার একটি বাড়িতে ১৯২৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাস ও মাতা কমলিনী দাসের কোল আলো করে ধরণীর বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেন সমর দাস। লক্ষ্মীবাজারের এই ঘরটিতে সারাদিন ছড়িয়ে থাকতো সংগীতের মূর্ছনা। সমর দাসেরও তাই সংগীতের স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠা। পিতার কাছ থেকে বেহালা দিয়ে শুরু করেন সংগীত জীবনের প্রথম পাঠ। পরবর্তীতে নর্থ ফিল্ড নামে এক মিশনারীর শরণাপন্ন হন পিয়ানো, গিটার আর বাঁশি শেখার উদ্দেশ্যে। খুব ছোটবেলা থেকেই যেকোনো বাদ্যযন্ত্র খুব সহজেই আয়ত্ত করে ফেলতে পারতেন সমর দাস। তাই খুব অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের উপর দক্ষতা অর্জন করেন তিনি।
সমর দাসের প্রথম সংগীত জগতে পদার্পণ একজন যন্ত্রশিল্পী হিসেবে। ১৯৪৫ সালের দিকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রে একজন বংশীবাদক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে কলকাতা বেতার ও কলকাতা এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতেও যন্ত্রসংগীত শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যন্ত্রশিল্পে তার অসামান্য দক্ষতার জন্যে চারদিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫০ পরবর্তী সময়ে কলকাতায় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’কোম্পানি বা এইচ.এম.ভিতে কাজ করার সুবাদে কলকাতার খ্যাতনামা কিছু গুণী শিল্পী যেমন কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ প্রমুখের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ফলে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিলেন সমর দাস তাই বলাই বাহুল্য।
১৯৫০ সালের শেষের দিকে কলকাতার জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরির সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয় সমর দাসের। সেই বছর বাংলা ছবি ‘লটারি’র সংগীত পরিচালনায় সলিল চৌধুরির সাথে একসাথে কাজ করেন তিনি। সলিল চৌধুরির সাথে কাজের অভিজ্ঞতা সমর দাসের জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর কাজ শুরু হলে সমর দাস সেখানে সংগীত পরিচালক হিসেবে এককভাবে কাজ করেন।
এছাড়াও অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্র, যেমন ‘মাটির পাহাড়’ (১৯৫৯), ‘আসিয়া’ (১৯৬০) ‘গৌরী’, ‘জিঘাংসা’, ‘রাজা এলো শহরে’ (১৯৬৪), ‘ধীরে বহে মেঘনা” (১৯৭৩) ইত্যাদি চলচ্চিত্রে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন নৃতনাট্য, যেমন ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’, ‘নদীর সন্তান’, ‘সোনার সবুজ গাঁয়ে’, ‘নবারুণ’ ইত্যাদির সংগীত পরিচালনায়ও কাজ করেন।
১৯৬১ সালের দিকে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে তিনি স্থায়ী শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। এই সময়টি ছিল সমর দাসের জন্য বেশ ব্যস্ততার সময়। বেতার কেন্দ্রে কর্মরত অবস্থায় অজস্র গানের সুরকার হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্যেও অসামান্য সব কাজ করেছেন তিনি। সেই সময়ে তার সৃষ্টি ‘ওগো মায়াবী রাতে এক চাঁদ আমি আজ তোমারই মতন’, ‘আমার আকাশে প্রেম তারার মতো জ্বলে’, ‘মেঘে দেওয়ায় করছে মেঘলি তোলাইলো পূবাল বাও’, ‘পাগলা পিরের দরগায় জ্বলে ঘিয়ের বাতি’ ইত্যাদি গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
১৯৬৬ সালে তিনি কিছুদিন পিআইএ সাংস্কৃতিক দলের সংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে করাচিতে কাজ করেন। সেইসময় তার সারাক্ষণ মন পড়ে থাকতো দেশে ফেরার অপেক্ষায়। পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠলে তাদের আমন্ত্রণে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দান করেন।
বেতার ও টেলিভিশনের জন্যে তিনি গান সুর করে গেছেন অসংখ্য। সরকারি হিসেবে তার সুরারোপিত গানের সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি। তার সৃষ্ট ‘লাজুক লাজুক চোখ মেলে ঐ সূর্যমুখী ফুটল’, ‘তন্দ্রাহারা নয়ন আমার এই মাধবী রাতে’, ‘ডাকপিওনে সারাটা দিন চিঠি বিলি করে বেড়ায়’, ‘আজকে ছুটির দিনে কাছে এসে ওগো বন্ধু’ প্রভৃতি তার অসামান্য কাজের নিদর্শন বহন করে।
দেশের মানুষের জন্যেও তার আকুতির কোনো কমতি ছিল না। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত আনলে অজস্র মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। তখন দুর্গত মানুষকে সহায়তা করার জন্য পল্টন ময়দানে সমর দাসের উদ্যোগে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ নামে একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১৯৭১ সালটি শিল্পী সমর দাসের জীবনে সম্পূর্ণ নতুন মোড় এনে দেয়। এই সময়টিতে পুরো বাংলাদেশ ছিল এক নতুন স্বপ্নে বিভোর। জাতির ক্রান্তিলগ্নে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার দোদুল্যমানতায় পুরো দেশ যখন ভীত তখন শিল্পী পাড়াতেও কিছুটা ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার দুর্লভ শিখায় প্রজ্বলিত হওয়ার আহবান সংগীত থেকেই উজ্জীবিত করার চিন্তায় সেই বছরই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক এবং প্রধান পরিচালক হিসেবে কাজ করেন সমর দাস। হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে প্রেরণা জোগাতে এবং দেশবাসীকে মুক্তিসংগ্রামে নিজেদের মনোবল দৃঢ় রাখার তাগিদে তৈরি হচ্ছিল অজস্র জ্বালাময়ী গান।
গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখায় এবং সমর দাসের সুরে তৈরি হলো এক কালজয়ী সংগ্রামী গান, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল। নইম গহরের লেখা ‘নোঙ্গর তোলো তোলো, সময় যে হলো হলো’তে সমর দাস সুরারোপ করলেন। এছাড়াও মোস্তাফিজুর রহমানের লেখায় ও সমর দাসের সুরে ‘ভেবোনা গো মা তোমার’ গানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গানগুলো এখনো একাত্তরের চেতনায় বাঙ্গালীর রক্ত উত্তেজিত করে তোলে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ নির্বাচিত হলে তার সামরিক সংস্করণের দায়িত্ব পড়ে সমর দাসের উপর। কিন্তু তখন গানটি জাতীয় অঙ্গনে প্রচারিত হওয়ার জন্য অর্কেস্ট্রার উপযোগী কোনো পশ্চিমা নোট ছিল না। পরবর্তীতে সমর দাস গানটির পশ্চিমা নোট সংযোজনের মাধ্যমে আধুনিক সুরবিন্যাসে বিবিসি লন্ডন থেকে রেকর্ড করে আনেন। জাতীয় বেতার বা টেলিভিশনে এখনও জাতীয় সংগীতের এই সংস্করণটিই শুনতে পাওয়া যায়।
সেই একই বছর তিনি আরেকটি অসামান্য কাজ করেন। কলকাতার এইচ.এম.ভি কোম্পানি ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ শিরোনামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ২৬টি গান নিয়ে দীর্ঘ সময়ের একটি রেকর্ড প্রকাশ করেন যার সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সমর দাস। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রসহ ভারতের অনেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এই রেকর্ডে অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ নামে দুটি এল.পি ডিস্কে একজন সফল সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৮৫ ও ১৯৯৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের সূচনা সংগীতেও কাজ করেন তিনি।
সমর দাস তার বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবনে দেশে ও দেশের বাইরে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে ‘একুশে পদক’ এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেশের শিল্পীদের অসহায়ত্ব এবং অবহেলার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে গড়ে তোলা হয় ‘বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ’। এই সংগঠনের সূচনালগ্ন থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন সমর দাস। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই অসামান্য সংগীত পুরুষ। আমাদের সংগীত জগতে এই কীর্তিমানের কীর্তি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ফিচার ইমেজ-bdshow.biz