ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি না জানা মানুষ খুব কমই আছেন। তুষারে ঢাকা পাহাড়ের সারি, উপত্যকায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ আর অবারিত ফুলের বাগানের জন্য সুইজারল্যান্ডের বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে। সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মতো দেশটির বিভিন্ন উৎসবের প্রাণবন্ত আনন্দের খ্যাতিও একেবারে কম নয়।
সুইজারল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে রাইন নদীর তীরে বাসেল নামে এক শহর আছে। ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের শুরুতে এই শহরে জবড়জং মুখোশ, মনকাড়া কস্টিউম ও আকাশ বাতাস মাতানো বাদ্যের আমেজে পুরো এলাকা আমোদিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতির অকৃপণ শোভার মাঝখানে এমন মনমাতানো উৎসবে শহরবাসীর সমবেত আনন্দ যেন বাঁধ ভেঙে চারিদিকে একেবারে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, এই উৎসব হচ্ছে বিখ্যাত ‘বাসেল কার্নিভাল’। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘বাসেলর ফাস্নাখট’।
এই বর্ণাঢ্য উৎসবের ইতিহাস নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন কাজ। কারণ, ১৩৫৬ সালের এক ভয়ানক ভূমিকম্পে শহরটির এক বড় অংশ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র চিরতরে হারিয়ে যায়। বেঁচে যাওয়া একটি নথিতে পাওয়া যায়- ১৩৭৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের মুন্সটারপ্লাটজ অঞ্চলে সাধারণ নাগরিক ও নাইট সদস্যরা একসাথে কোনো উৎসবের অংশ হিসেবে মিছিলে যোগ দিতেন। সেসময় এমন এক মিছিলে নাগরিক ও নাইট সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ থেকে সহিংসতা তৈরি হয়েছিলো। এতে চারজন অভিজাত নিহত হলে তৎকালীন শাসক রোমান সম্রাট ৪র্থ চার্লস ১২ জন সাধারণ নাগরিককে প্রাণদণ্ড দেন। বাসেল শহর কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই দিনটি বাসেলের ইতিহাসে ‘বোস ফাস্নাখট’ বা ‘ইভিল কার্নিভাল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো।
মজার ঘটনা হচ্ছে, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের অন্য শহরে এই উৎসব এক সপ্তাহ আগে পালিত হয়। ধারণা করা হয়, ১৫২০ সালে ইউরোপে সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে অন্যান্য শহরে কার্নিভাল উদযাপন বন্ধ থাকলেও বাসেলে চালু ছিলো। ১৫২৯ সাল থেকে ক্যাথলিক প্রথা থেকে পৃথক হবার জন্য এক সপ্তাহ পিছিয়ে উৎসব পালনের রীতি চালু হয়। এখনকার দিনে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে চালু থাকা খ্রিস্টীয় কার্নিভালগুলোর মধ্যে বাসেল কার্নিভাল প্রথম ও একমাত্র প্রোটেস্ট্যান্ট কার্নিভাল।
বাসেল কার্নিভাল সাধারণত খ্রিস্টীয় উৎসব ‘অ্যাশ ওয়েন্সডে’ এর পরের সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়। এর মেয়াদ পুরো তিন দিন। ১২ হাজারেরও অধিক লোক এতে অংশ নিয়ে থাকে। এ কার্নিভালের সেরা কস্টিউম পরিহিত মিছিলকারীরা সাধারণত ‘ওয়াগিস’ নামে পরিচিত। ‘ওয়াগিস’ কস্টিউমের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিরাট নাকযুক্ত ও জমকালো বাহারি রঙের মুখোশ। বলা হয়, পূর্ব ফ্রান্সের আলজাঁস শহরের ক্যাথলিক অধিবাসীদের পরিহাস করার জন্য কার্নিভালে এমন মুখোশ ব্যবহার করা হয়।
এই কার্নিভালে অংশ নেওয়া উৎসবকারীরা বেশ কয়েকভাগে বিভক্ত থাকে। সুইজারল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ‘গুগেনমিউজিক’ বাজানো ব্যান্ড দল ‘গুগ’ কার্নিভালের অন্যতম আকর্ষণ। তাদের বাদ্যের সুর কার্নিভালের আমেজ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সে বাদ্যের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গান করতে থাকা গায়কদের সুইস জার্মান ভাষায় ‘শ্নিটজেলব্যাক’ বলে। পূর্বে মূলত স্থানীয় লোককবি বা ছড়াকারদের এই নামে ডাকা হতো। তারা গানে গানে সমকালীন ইউরোপীয় বা বিশ্বের আলোচিত ঘটনা নিয়েও গান করে। এছাড়া বড় ট্রাকে করে ‘ওয়াগিস’রা সমবেত মিছিলের দিকে কমলা, মিষ্টি, চকলেট ও ফুল নিক্ষেপ করে থাকে। ‘গুগেনমিউজিক’ ও ‘শ্লিটজেলব্যাক’ দলের বাদ্য ও গান ছাড়াও অন্য কিছু ছোট গানের দল মিছিলে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে ‘স্কিসড্রাগজিগলি’ দল উল্লেখযোগ্য।
খ্রিস্টীয় উৎসব ‘অ্যাশ ওয়েন্সডে’ অনুষ্ঠিত হবার পরের সপ্তাহের সোমবারে ‘মোরগেস্ট্রেইখ’ উৎসবের মাধ্যমে বাসেল কার্নিভালের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। ঠিক ভোর চারটায় শহরের সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। উৎসবের কুশীলবদের হাতের লণ্ঠনের আলো ছাড়া অন্য কোনো আলো এ সময় থাকে না। মিছিল শুরু হবার সময় হলে ‘মোরগেস্ট্রেইখ- ভরওয়ার্টস মার্শ্চ’ বা ‘মোরগেস্ট্রেইখ- এগিয়ে চলো’ ঘোষণার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এদিন মিছিলে এলোমেলোভাবে একক বাদ্য বাজানো হয়, ‘গুগেনমিউজিক’ হয় না। ভোর চারটা থেকেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট উৎসবের বিশেষ খাবার ও আয়োজন নিয়ে আনন্দ বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হয় ‘গুগেনমিউজিক’ এর কনসার্ট। বাসেলের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় নির্বাচিত ব্যান্ড দলের আয়োজনে শুরু হয় মন মাতানো গানের উৎসব। সাধারণত মার্কটপ্লাটজ, বার্ফুসেরপ্লাটজ ও ক্লারাপ্লাটজ এলাকায় আকর্ষণীয় সাজের উঁচু মঞ্চে ‘গুগেনমিউজিক’ আয়োজিত হয়। এদিনের উল্লেখযোগ্য গানের অনুষ্ঠান বাসেলের টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। ‘গুগেনমিউজিক’ ছাড়া অন্য ছোট কিছু গানের দল মঞ্চের পাশের রাস্তায় ড্রাম ও ক্ল্যারিওনেট বাজিয়ে এগিয়ে চলে। অনেক ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টেও ‘গুগেনমিউজিক’ এর দল গান করে থাকে।
মঙ্গলবারেই পরিবারসহ শিশুদের বিশেষ আয়োজন থাকে। এ পর্যায়ে রাজপথে বিশেষ প্যারেডের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্যারেডে শহরের শিশু ও তাদের পরিবার অংশ নিয়ে থাকে। সাধারণত এ মিছিলে মুখোশ ও অন্যান্য কস্টিউম ছোটদের পরতে নিষেধ করা হয়। সোমবার বিকেল থেকে বুধবার সকাল অবধি চলে লণ্ঠন উৎসব। মুনস্টারপ্লাটজ এলাকায় খোলা আকাশের নিচে এই প্রদর্শনী হয়। বাসেল কার্নিভালের লণ্ঠন প্রদর্শনী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ওপেন এয়ার আর্ট এক্সিবিশন’ হিসেবে খ্যাত।
বাসেল কার্নিভাল বা ‘বাসেলর ফাস্নাখট’ উৎসব শুধু মিছিল বা সমবেত গান-বাদ্যের অনুষ্ঠান নয়। এই কার্নিভালের বিশেষ খাবারও রয়েছে। এ উৎসবে ৩ প্রকার খাবার প্রধান হিসেবে গণ্য হয়। ‘বাসলের মাহলসুপ্পে’ বা ব্যাসেল ফ্লাওয়ার স্যুপ এদিনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মজার ঘটনা, ২০০০ বছর আগে স্থানীয় রোমান শাসক ও অভিজাতবর্গ ফ্লাওয়ার স্যুপ খেতেন। ক্যাথলিক সংস্কৃতি বর্জন করার মাধ্যমে বাসেল কার্নিভাল চালু হলেও রোমান সংস্কৃতি কিন্তু রয়েই গেছে !
‘জিব্বেলেওয়াইজি’ বা অনিয়ন টার্টকে অবশ্য খাবার হিসেবে খাঁটি সুইস বলাই যায়। রুটি বানানোর সময় বেঁচে যাওয়া আটা এই বিশেষ অনিয়ন টার্টের অন্যতম উপকরণ। আগেকার দিনে এর সাথে পেঁয়াজ বা অন্য কোনো সবজি মিশিয়ে এটি তৈরি হতো। সহজেই বোঝা যায় যে, বাসেল উৎসব ও এর খাবার একসময় কৃষক উৎসব ছিলো। ‘কাসওয়াইজি’ বা চিজ টার্টও এর প্রায় কাছাকাছি। এতে আটার বদলে শুধু পনির ব্যবহৃত হয়। শুরুতে কৃষকদের খাবার হলেও পরে এটি মধ্যবিত্তের পছন্দের ডিশ হয়ে ওঠে।
বাসেল কার্নিভালে মিষ্টি ছুঁড়ের মারার প্রথা বেশ কৌতূহলের জন্ম দেয়। মিষ্টিকে ইতালিয়ান ভাষায় ‘কনফেত্তি’ বলা হয়, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘কনফেকশনারি’। অনেক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, ইউরোপ বা আমেরিকার অনেক জায়গায় কার্নিভাল বা অন্য কোনো আনন্দ মিছিলে ‘কনফেত্তি’ ছুঁড়ে আনন্দ করার রীতি বাসেল কার্নিভাল থেকেই এসেছে। তবে এর পক্ষে অকাট্য কোনো প্রমাণ দেখানো কঠিন। উল্লেখ্য, উনিশ শতকে উৎসবের অংশ হিসেবে মিষ্টি ছুঁড়ে মারা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। তখন মিষ্টির বদলে একরকম কাগজের বল ব্যবহৃত হতো। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় এই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বাসেলের জার্মান উচ্চারণে ‘কনফেত্তি’ ‘র্যাপ্পলি’ নামে পরিচিত। মজার ঘটনা হচ্ছে, কার্নিভালে ব্যবহারের জন্য মিষ্টির রং নিয়ে মোটামুটি কড়া এক নিয়ম আছে। মিছিলে ছোঁড়ার জন্য যেসব মিষ্টি ব্যবহৃত হবে, তা অবশ্যই এক রঙের হতে হবে। এক রঙের মিষ্টিতে অন্য যেকোনো রঙের উপস্থিতি কার্যত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, একাধিক রঙের মিষ্টি ও ছোঁড়ার পর রাস্তায় পড়ে থাকা মিষ্টি অনেক সময় একরকম দেখায়। আর রাস্তায় পাওয়া পরিত্যক্ত মিষ্টি ছোঁড়া অস্বাস্থ্যকর।
বাসেল কার্নিভালের জন্য থিম নির্বাচন এই উৎসবের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় ভাষায় থিম নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া ‘সুঁজেত’ নামে পরিচিত। থিম হিসেবে সমকালীন দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা ও ইস্যু প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করলে সে বছরের বাসেল কার্নিভালে প্রসিডেন্ট বুশকে ‘সুঁজেত’ নির্বাচিত করা হয়।
২০১৭ সালে ইউনেস্কো সুইজারল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী বাসেল কার্নিভালকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ বলে ঘোষণা করে। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় এই উৎসব নিঃসন্দেহে ইউরোপের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির এক অন্যতম দৃষ্টান্ত।