‘এন্টারটেইনমেন্ট’ বা বিনোদন শব্দটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে ভিন্নরূপে ধরা দেয়। বিনোদনের কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া নেই। দেখা ও শোনার যুগলবন্দীতে ভালো লাগার কিছুটা সময় অতিবাহিত করার অন্য আরেক নামই বিনোদন। এই বিনোদনের মাধ্যম সর্বদা পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনে এমন মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। বিনোদনের এমনই এক প্রাচীনতম মাধ্যম হলো সার্কাস, যা বহু বছর হতে চলে আসলেও, আজ এর উত্তরণ অন্তিম সূর্যাস্তের দিকে ঢলে পড়েছে।
সার্কাস শব্দটি মূলত একটি ইংরেজি শব্দ। ১৪শ’ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম এর ব্যবহার হয়। আবার এই ইংরেজি ‘সার্কাস’ আসলে ল্যাটিন Circus থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই ল্যাটিন শব্দটি আবার গ্রীক শব্দ Kirkos থেকে এসেছে, যার মানে একটা গোলাকার ক্রীড়াচক্র, যাকে ঘিরে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা থাকে। সার্কাস মূলত একদল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম দ্বারা নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলে এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের দিন তাদের দক্ষতা জাহির করে।
সার্কাসে অনেক ধরনের খেলা দেখানো হয় বলে বেশ প্রশস্ত জায়গা নিয়েই এর প্রদর্শনী চলে। পুরো কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে বড় ধরনের তাঁবু ব্যবহার করা হয়, যা ‘বিগ টপ’ নামে পরিচিত। সার্কাসের আকার সাধারণত গোলাকৃতি হয়ে থাকে। মাঝখানের গোলাকৃতি মঞ্চ যেটি ‘রিং’ নামে পরিচিত, সেখানে সকল খেলার প্রদর্শনী হয়ে থাকে। যিনি সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন তাকে রিংমাস্টার বলা হয়।
সার্কাসের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। বহু প্রাচীনকাল থেকেই রোম, মিশর ও গ্রিসের বিভিন্ন শহরে সার্কাসের খেলা দেখানো হতো। তখন যদিও একে সার্কাস বলা হতো না, তবে মূল বিষয় ছিল একই। সেই সময়কার সার্কাস এখনকার মতো এত আড়ম্বড়পূর্ণও ছিল না। তখনকার দিনে সার্কাস বলতে ছোটখাট আগুনের খেলা, লাঠি ঘোরানো, দড়ি খেলা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, ভারোত্তোলন ইত্যাদি দেখানো হতো। এর পাশাপাশি ছিল কিছু জন্তু-জানোয়ারের প্রদর্শনী, যা আজকের দিনের চিড়িয়াখানার চাইতে বেশি কিছু নয়।
সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমলে রোমে প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্কাস প্রদর্শন করা হয়। আর এই সার্কাস পরিচালনা করে তখনকার বৃহত্তম সার্কাসদল ‘ম্যাক্সিমাস’। দুই লক্ষের বেশি লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন চত্বর পাথর দিয়ে ঘেরাও করে নির্মাণ করা হয় সার্কাসের ক্ষেত্র। এরপর থেকে সার্কাসের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে আঞ্চলিক মেলাগুলোতেও সার্কাস প্রদর্শনী শুরু হয়।
আঠারো শতকের দিকে এসে সার্কাসের চেহারা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। আর এই পরিবর্তনের কর্ণধার হলেন ইংল্যান্ডের ফিলিপ অ্যাসলো। মূলত তার হাত ধরেই আধুনিক সার্কাসের যাত্রাপথ শুরু হয়। বর্তমান সার্কাসের অনেক জনপ্রিয় খেলা ছিল তার সৃষ্টি। ফিলিপের হাত ধরে সার্কাসের পুরো চেহারাই পাল্টে যায়।
আঠারো শতকের শেষ দিকে তিনি একটা ছোট্ট ঘোড়সওয়ারির দল নিয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে একটা গোলাকার ক্রীড়াক্ষেত্রে নানারকমের আশ্চর্য খেলা দেখাতে শুরু করলেন। এই খেলা খুব অল্প দিনের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তিনি যে বৃত্তাকার ক্রীড়াভূমি ব্যবহার করতেন, তাকেই মূলত বলা হতো রিং। সেই থেকে সার্কাসের ক্রীড়াক্ষেত্র বলতেই ‘রিং’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়।
এরপর থেকে সার্কাসের প্রসার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিপের এক সহকারী চার্লস হিউজেস সমসাময়িককালে রাশিয়াতে সার্কাস দেখানো শুরু করেন। এ সময় ইউরোপীয় সার্কাস দলের প্রায় সবারই নানা শহরে স্থায়ী খেলার মাঠ ছিল।
১৭৮০ সালের শেষ দিকে সার্কাস প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পদার্পণ করে জন বিল রিকেটস-এর হাত ধরে। তিনি ১৭৯৩ সালের ৩রা এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে একটি প্রদর্শনী করেন, যেটিকে সার্কাসের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই শো এতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন পর্যন্ত শো দেখতে আসেন।
কালের পরিবর্তনে সার্কাসে নিত্য নতুন আইডিয়ার খেলা এবং দুঃসাহসী খেলার আগমন ঘটতে থাকে। আইজ্যাক ভ্যান অ্যামবুর্গ নামের এর মার্কিনী পেশায় একজন খুব নামকরা বন্যজন্তু শিক্ষক ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খুব দুঃসাহসী। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তিনিই সিংহের মুখের ভেতর নিজের মাথা ঢুকিয়ে নিরাপদে মাথা বের করার খেলা দেখিয়ে সার্কাসের খেলার পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছিলেন।
১৮৫৯ সালের দিকে সার্কাসে এক নতুন খেলার প্রচলন ঘটে যার নাম ‘ফ্লায়িং ট্রাপিজ’। ট্রাপিজ হলো এক ধরনের দড়িখেলা, যা বহু অনুশীলন ও শারীরিক কসরতের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়। আর ফ্লায়িং ট্রাপিজ হলো দড়ির সাহায্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে উড়ার খেলা। জুল লিয়টার্ড নামক এক ফরাসি প্রথম এই খেলার আবিষ্কার করেন।
সেই একই বছর জুন মাসে আরেক অসাধ্য সাধন করে চারিদিকে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন চার্লেস ব্লন্ডিন নামে আরেক ফরাসি। তিনি শক্ত দড়ির উপর হাঁটতে পারতেন খুব অনায়াসে। কিন্তু তার চিন্তাভাবনা ছিল দুর্ধর্ষ কিছু করে দেখানোর। তিনিই প্রথম আমেরিকা ও কানাডা সীমান্তে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব বিশিষ্ট ‘দি নায়াগ্রা জর্জ’ একটি সরু দড়ির উপর হেঁটে পার হন। আর সেই থেকে তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে সার্কাসের গোড়াপত্তন হয়। ১৮৭৯ সালে রোমান উইলিয়াম সিরিন একটি ইতালিয়ান সার্কাস দল নিয়ে উপস্থিত হন ভারতের কেরালা রাজ্যে। সেখানে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে, সারা ভারতে তার দলের কোনো খেলা নকল করে দেখানোর মতো উপযুক্ত কেউ নেই। এ চ্যালেঞ্জ মহারাষ্ট্রের রাজা কুরুওয়ানদানের আত্মসম্মানে আঘাত করে। তখন তিনি উইলিয়ামের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি তার অশ্ব প্রশিক্ষক এবং আরো দুই শিষ্যকে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন খেলায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং উইলিয়ামের সার্কাস দলের প্রদর্শিত খেলা একে একে নকল করে দেখান। ভেঙে দেন রোমানের অহঙ্কার। এরপর এ তিন ভারতীয় মিলে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সার্কাস দল। শুধু দল গঠনই নয়, প্রতিষ্ঠা করেন সার্কাস স্কুল। যে কারণে ভারতের কেরালাকে উপমহাদেশের সার্কাস ইতিহাসের পূণ্যভূমি বলা হয়।
কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে প্রায় প্রত্যেক বছর নিয়ম করে দেখানো হতো রাশিয়ান সার্কাস। এই জায়গার নামকরণও ওই সার্কাস প্রদর্শনকে ঘিরেই। সেই থেকেই শুরু করে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক পর্যন্তও প্রতি বছরের শীতের আমেজ জমিয়ে রাখতো পার্ক সার্কাস ময়দান।
তৎকালীন পাকিস্তানের ‘লাকি ইরানি সার্কাস’ হলো খুব নামকরা একটি সার্কাস দল। এই দলটি দেশটির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে সার্কাস খেলা দেখায়। পাকিস্তানে এমন কয়েক প্রজন্ম পাওয়া যাবে যাদের কাছে বিনোদনের অন্যতম উপাদান ছিল লাকি ইরানির সার্কাস। বংশ পরম্পরায় আজও এই সার্কাস দলটি টিকে আছে।
বাংলাদেশে ১৯০৫ সালে ‘দি লায়ন সার্কাস’ নামে প্রথম একটি সার্কাস দল গঠিত হয়। ১৯৭০ সালে দলটির নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘দি সাধনা লায়ন সার্কাস’। বাংলাদেশের সার্কাস দলগুলোতে সাধারণত জীবজন্তুর খেলা এবং মানুষের চোখ দিয়ে রড বাঁকানো, ভারোত্তোলন, এক চাকা, দু’চাকা, লোহার খাঁচা ও কূপের মধ্যে মোটরসাইকেল চালানোসহ নানা খেলা দেখানো হতো।
স্বাধীনতা পূর্বকালে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সালে পর্যন্ত এদেশে বেশকিছু দল প্রায় নিয়মিতভাবে সার্কাস প্রদর্শনী করতো। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– রাধিকা মোহন মোদকের ‘দি বেবি সার্কাস’, সাতক্ষীরার জুড়ান কর্মকারের ‘দি আজাদ সার্কাস’, ১৯৪৭ সালে গঠিত বরিশালের লক্ষণদাসের ‘দি রয়েল পাকিস্তান সার্কাস’, বনমালি মোদকের ‘দি ইস্ট পাকিস্তান সার্কাস’, নারায়ণগঞ্জে রাধানাথ সরকারের ‘দি আর এন ডল ড্যান্স সার্কাস’, নবাবগঞ্জে কার্তিক সরকারের ‘লক্ষীনারায়ণ সার্কাস’ ও সাধুদাসের ‘দি লায়ন সার্কাস’, ১৯৬৫ সালে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমএ সামাদের ‘দি সেভেন স্টার সার্কাস’ ও ‘দি নিউ স্টার সার্কাস’ এবং ১৯৬৮ সালে গঠিত রংপুরে আলী আকবরের ‘দি রওশন সার্কাস’।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশে যে সকল সার্কাস দল গঠিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বগুড়া-মহাস্থানগড়ের আব্দুস সাত্তারের ‘দি বুলবুল সার্কাস’, বরিশালের বীরেনচন্দ্র দাসের ‘দি রয়েল সার্কাস’, ফেনির সুনীল চন্দ্র পালের ‘দি সবুজ বাংলা সার্কাস’, সাতক্ষীরার ‘দি সুন্দরবন সার্কাস’, নারায়ণগঞ্জের মুকুলের ‘দি কাঞ্চন সার্কাস’, চট্টগ্রামের আনোয়ার খানের ‘দি কোহিনূর সার্কাস’, সৈয়দপুরের আকবর শেখের ‘দি রওশন সার্কাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমএ সামাদের ‘দি নিউ স্টার সার্কাস’, আব্দুল বশিরের ‘দি ন্যাশনাল সার্কাস’, ঢাকা-নবাবগঞ্জের নিরঞ্জন সরকারের ‘দি লায়ন সার্কাস’, ঢাকা-বর্ধনপাড়ার রতন সরকারের ‘দি রাজমহল সার্কাস’, শৈলেন বাবুর ‘নিউ সবুজ বাংলা সার্কাস’ এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের বসন্তকুমার মোদকের ‘দি সোনার বাংলা সার্কাস’।
কালের প্রবাহে বিনোদনের মাধ্যমে এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন বিনোদন মাধ্যমগুলোর জৌলুশ। যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারার কারণে আর বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠার কারণে বিলুপ্তির পথে এই প্রাচীন সংস্কৃতি। এইতো কিছুদিন আগেও আমরা মেলায় গেলে দেখতে পেতাম, মেলার সবচাইতে বেশি জায়গা জুড়ে রয়েছে সার্কাসের তাঁবু। আবার টেলিভিশনের পর্দায় বিদেশি সার্কাস দেখার আগ্রহও কোনো অংশে কম ছিল না। কিন্তু সময় আজ অনেক পরিবর্তিত। বিনোদনের এই মাধ্যমটি এখন মানুষের মুখে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের উপকরণ। তাই আজকের লেখায় রইল আধুনিকতার মেরুকরণে হারিয়ে যেতে বসা সার্কাসকে কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়ার অভিব্যক্তি।
ফিচার ছবিসূত্র: starkinsider.com