আগে অন্য দেশগুলোর মতো কোরিয়াতেও হ্যান্ডসাম বা সুন্দর ছেলে মানেই ছিলো ‘ম্যাচো’, ‘ড্যাশিং’, ‘রাফ এন্ড টাফ’ ইত্যাদি। আর আজকাল সেখানে ‘প্রিটি, ‘কিউট’ এর মতো বিশেষণগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ছেলেদের সৌন্দর্য বোঝাতে। যেগুলো কিনা সাধারণ বিচারে ‘মেয়েলি’ বিশেষণ! কে-পপের যারা ভক্ত নন, তারাও সম্ভবত ইন্টারনেটের কল্যাণে কে-পপ তারকাদের মুখের সাথে অন্তত পরিচিত আছেন। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, বেশ চড়া মেক-আপ, নিখুঁত ত্বক, ঝলমলে চুলসহ সব মিলিয়ে তাদের সাধারণ বিচারে অতটা ‘পুরুষালি’ মনে হয় না? এই ট্রেন্ডের প্রসার এতটাই বেড়েছে যে ‘প্রিটি বয়’ হওয়ার জন্য কোরিয়ান ছেলেরা গণহারে দৌড়াচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে। কীভাবে এলো এই ট্রেন্ড, কেনই বা জনপ্রিয় আর কীভাবেই বা টিকে আছে- তা নিয়েই আজকের লেখা।
হানা ইয়োরি দাঙ্গো, বয়েজ ওভার ফ্লাওয়ার্স, ইউ’র বিউটিফুল, ফ্লাওয়ার বয় রামিয়ুন শপ, মি টু ফ্লাওয়ার, ফ্লাওয়ার বয় নেক্সট ডোর ইত্যাদি হিট টিভি সিরিজের মাধ্যমে ২১ শতকের প্রথম দশকে সৌন্দর্যের এক নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। ‘kkotminam 꽃미남 বা Flower Boys’ মূলত এর উৎপত্তি জাপানি ম্যাঙ্গা থেকে। ফ্লাওয়ার বয়রা ‘মেট্রোসেক্সুয়াল’ সাজতে, শপিং করতে ভালোবাসে। সৌন্দর্যের দিক থেকে যেন ফুলের মতোই নিখুঁত আর কোমল। এই ফ্লাওয়ার বয়রা নিজেদের পুরুষ সত্তার অন্দরে থাকা কোমল, মিষ্টি ও প্রীতিবৎসল দিকগুলো প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন না। গায়ের জোরে ‘পুরুষ’ হবার চেয়ে প্রচণ্ড রকম আত্মসচেতন, বুদ্ধিদীপ্ত ও নিখুঁত রকমের সুন্দর হতেই তাদের সবটুকু মনযোগ। ফ্লাওয়ার বয় ট্রেন্ড এতটাই ব্যাপ্তি লাভ করেছে যে, অনেক মেয়েও তথাকথিত ‘পুরুষালি’ ছেলেদের চেয়ে আগ্রহী হচ্ছে এই ‘ফ্লাওয়ার বয়’দের প্রতিই। কেন হচ্ছে এমন?
মেট্রোসেক্সুয়ালদের সমকামী হিসেবেই সমাজের অনেকে দেখে থাকেন। অথচ কে-পপ সিরিজগুলোতে দেখানো হয়, এই মেট্রোসেক্সুয়াল ফ্লাওয়ার বয়রাই প্লেবয়ের মতো সমানে মেয়ে পটিয়ে যাচ্ছে! গণমাধ্যমের এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব অনুযায়ী এসবেই প্রভাবিত হচ্ছে বাস্তবতা, পাল্টাচ্ছে মেয়েদের চাহিদা। ‘ফ্লাওয়ার বয়’ হওয়াটাকেই তখন ছেলেদের আকর্ষণীয় দিক হিসেবেই মানছেন মেয়েরা। ওদিকে মেয়েদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে বলেই অনেকের কাছে ‘উদ্ভট’ হওয়া সত্ত্বেও এই ট্রেন্ড পাচ্ছে প্রসার।
এ তো গেলো ‘ফ্লাওয়ার বয়েজ’-এর একটা তত্ত্ব, ‘ম্যাঙ্গা/ড্রামা তত্ত্ব’। আরেকটা তত্ত্ব আছে এর উৎপত্তি নিয়ে, রাজনৈতিক অর্থনীতি তত্ত্ব। ১৯৯৭ সালের কুখ্যাত অর্থনৈতিক মন্দাকালের কথা বলছি। কোরিয়ান মেয়েরা এর আগে পাল্লা দিয়ে চাকরি করছিল ছেলেদের সাথে। কিন্তু মন্দা আসবার পর মেয়েরা গণহারে ছাটাই হতে থাকেন চাকরি থেকে। হতাশা পরিবর্তন আনতে থাকে মেয়েদের মনস্তত্ত্বে। মেয়েদের মন-প্রকৃতি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, এমন কোমল প্রকৃতির ছেলেদের ব্যাপারে আগ্রহী হতে শুরু করে মেয়েরা। যে কিনা পাশের বাড়ির সুন্দর ছেলেটির মতোই হবে অমায়িক, মন খুলে ভালোবাসবে খুব সাধারণ মেয়েটিকেই। ঠিক যেমন আজকের ‘ফ্লাওয়ার বয়েজ’।
এর বাইরে কিছু ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাও আছে। ধারণা করা হয়, কোরীয় উপদ্বীপে শিল্লা রাজবংশের শাসনকালে (৫৭ খ্রি.পূ থেকে ৯৩৫ খ্রি) সামরিক ও সাংস্কৃতিক অভিজাতরা ছিল হোয়ারাং, অর্থ করতে গেলে যেটা অনেকটা ‘ফ্লাওয়ার বয়’ই হয়। চীনা সূত্রগুলো থেকে এই অভিজাতদের শারীরিক সৌন্দর্যের বিবরণই কেবল পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকের দিকে জেনারেল ওয়াং কেওনের সময় পরিস্থিতি পাল্টে গেল। উত্তর ও দক্ষিণের দুই দ্বীপ এক হলো আর হোয়ারাংদের যশ কমতে লাগল। সাজগোজ-পাগল অত্যধিক সৌন্দর্যসচেতন, ঘরোয়া আর কিছু সমকামিদের সমার্থক হয়ে গেল শব্দটি। অথচ হোয়ারাংরা ছিলো যুদ্ধে পটু, যা কিনা পৌরুষের প্রতীক! কিন্তু বিংশ শতকে জাপানি ম্যাঙ্গাগুলো চিত্রপট পাল্টে দিল। বড় চোখ, ফর্সা-মসৃণ ত্বক, সুগন্ধভরা দেহ, অসম্ভব স্টাইলিশ- ছেলে চরিত্রগুলোকে সেখানে সাজানোই হলো এমনভাবে। এই আপাত ‘মেয়েলিপনা’র সাথে সমকামিতার সম্পর্ক ছিল না।
ফ্লাওয়ার বা প্রিটি বয়েজ ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে কে-পপ ভক্তদের অনেকেই অভিনেতা বে ইয়ং-জুনকে অগ্রপথিক মানেন। তারপর ‘প্রিটি’ অভিনেতা হিসেবে এলেন কিম হিয়ুন জুং, হিয়ুন বিন, কিম বাম প্রমুখ। শুধু অভিনেতারাই নন, এগিয়ে এলেন গায়কেরাও। সুপার জুনিয়র, শাইনি, বিস্টের মতো ব্যান্ডের ‘ফ্লাওয়ার বয়’ সদস্যরাই তাদের ব্যান্ডগুলোকে নিয়ে গেলেন খ্যাতির চূড়ায়। বিগ ব্যাং ব্যান্ডের সদস্যরা তো চোখে আই-লাইনার পরাকে বানিয়ে দিলো নতুন ট্রেন্ড!
দে-সে নাম, মেইনস্ট্রিম ম্যান ইত্যাদি রিয়েলিটি শো-তে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই কমবেশি ডাক্তারের ছুরি-কাচির নিচে নিজেদের মুখাবয়বকে সঁপেছেন। সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ‘ফ্লাওয়ার বয়’ ধারণার ব্র্যান্ডিং করবার বড় একটা কৃতিত্ব তাদের। আর স্বাভাবিকভাবেই কেউ যেহেতু অত নিখুঁত ‘ফ্লাওয়ার’ হিসেবে জন্ম নেয় না, সুতরাং প্লাস্টিক সার্জারির শরণ তাদের নিতেই হয়। ঠিক এ কারণেই দক্ষিণ কোরিয়া প্লাস্টিক সার্জারির দিক দিয়ে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রথম দুটি দেশ হলো আমেরিকা ও ব্রাজিল। প্রথম দেশটিতে ৮১ জনে ১ জন ও দ্বিতীয় দেশটিতে ৯০ জনে ১ জন প্লাস্টিক সার্জারি করান। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ায় সেটি কত জানেন? প্রতি ৪৩ জনে ১ জন!
সিউলের অভিজাত অঞ্চল ও প্লাস্টিক সার্জারির ‘মক্কা’খ্যাত গ্যাংনামের বানোবাগি প্লাস্টিক সার্জারি সেন্টারের প্রধান শল্যবিদ লি হিয়ুন-তায়েকের ভাষ্যে-
আগে ছেলেরা প্লাস্টিক সার্জারি করত পুরুষালি হবার জন্য, এখন তারা বিবি ক্রিম, স্কিন কেয়ার সহ কসমেটিক্স ও প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ‘মেয়েলি’ হবার দিকে ঝুঁকছে।
বানোবাগিতে মূলত কী কী ধরনের সার্জারির চাহিদা বেশি? উত্তর হিয়ুন-তায়েকই দিলেন। রায়নোপ্লাস্টি (নাকের আকৃতি ঠিক করা), আইলিড সার্জারি (চোখের নিচের চর্বি কমানো), ফেসিয়াল কন্টুরিং (ভি-লাইন স্পষ্ট করা, জ-লাইন কমানো)- এগুলোই নাকি ছেলেরা বেশি করান।
কোরিয়ানদের মুখমণ্ডল চ্যাপ্টা। তাই সবাই ত্রিমাত্রিক চেহারা চায়। … রায়নোপ্লাস্টির চাহিদা আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি, কারণ নাকের আকৃতি একজনের পুরো ব্যক্তিত্বই পাল্টে দিতে পারে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোরিয়ান প্লাস্টিক সার্জারি কোম্পানি ইউনোগো এর প্রধান নির্বাহী জয় ক্যাং জানালেন একটি মজার তথ্য,
কে-পপ তারকাদের যখন দেখবেন, খেয়াল করে দেখবেন তাদের সবার তীক্ষ্ম ভি-আকৃতির চোয়ালরেখা আর নিখুঁত ত্বকের সাথে পেশিবহুল দেহ রয়েছে। একে বলে ‘জিমসাং ডল‘। অর্থাৎ কমবয়সী কিউট ছেলে, যার দেহটা পুরুষালি। মেয়েদের ক্ষেত্রেও আছে ‘ব্যাগেল গার্ল’ নামে একটি ধারণা। মানে মুখ দেখতে বাচ্চামতন, কিন্তু শরীর অত্যন্ত যৌনাবেদনময়।
অর্থাৎ ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের সৌন্দর্যের ধারণা বা মানদণ্ড প্রায় এক- ত্বক ও মুখাবয়ব হওয়া চাই নিখুঁত, যাতে কম বয়সী দেখায়। যেহেতু সাধারণ মানদণ্ডে চেহারার কমনীয়তাকে নারীর ভূষণ বলা হয় এবং মনে করা হয় রূপচর্চার দ্বারা ছেলেদের নিখুঁত চেহারা বানাবার দরকার নেই, সেহেতু ‘জিমসাং ডল’দের ‘মেয়েলি’ বলে অনেকেই তুচ্ছজ্ঞান করে থাকেন। তবে তা মানতে বয়েই গেছে কোরিয়ানদের। চেহারার ক্ষেত্রে ‘পুরুষালি’, ‘মেয়েলি’ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে তারা হতে চান নিখুঁত। কিন্তু দেহের প্রশ্নে পুরুষেরা ঠিকই হতে চান আরো পুরুষালি, সুঠামদেহী; অন্যদিকে মেয়েরা আরো নারীসুলভ কমনীয়।
ব্যায়ামাগারে ঘাম ঝরিয়ে সিক্স প্যাক বানানোর কথা সবাই জানেন। কিন্তু কোরিয়ান ব্যস্ত ছেলেরা যে সার্জারির মাধ্যমে সিক্স প্যাক বানানোর দিকে ঝুঁকছে, তা কি জানেন? শরীরের অতিরিক্ত চর্বি বের করে দিয়ে পেশীর আকার দেন শল্যচিকিৎসক। একইভাবে বক্ষপেশীর চর্বিও অপসারণ করান অনেকে ছেলে। ফাস্টফুডের বিস্তারে কোরিয়া বেশ এগিয়ে। তাই স্থূলতাও যেমন হু হু করে বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্লাস্টিক সার্জারি করে শরীরের নানা জায়গার মেদ কমানোর প্রবণতা।
যেহেতু নিজেদের কমবয়সী দেখাতে কোরিয়ানরা বেশ তৎপর, তাই তারুণ্য ধরে রাখতেও তারা শরণ নেন আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার। ত্বকের বলিরেখা দূর করতে আর ঢিলে হয়ে যাওয়া চামড়া টানটান করতে ছেলেরা সস্তায় করাচ্ছেন বোটক্স ও ফিলার্স সার্জারি। আছে ছুরিকাচিবিহীন চিকিৎসাও। আলথেরাপি ও থার্মাজ- এই দুই প্রযুক্তি এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। শব্দোত্তর তরঙ্গ চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ঠিকঠাক করা আর কী। এসবের সাথে স্পা পার্লারগুলোতে হার্বাল চিকিৎসা আর ম্যাসাজ তো আছেই।
যুগ যুগ ধরে এই ধারণা সমাজে বদ্ধমূল করা হয়েছে যে, মেয়েরা ঘরকন্না সামলাবে, অন্যদিকে ছেলেরা বাইরে ঘাম ঝরাবে; তাই ছেলেদের হতে হবে শক্তিশালী, আর মেয়েদের তা না হলেও চলবে। আবার সমাজ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, তাই সৌন্দর্যের মানদণ্ডগুলোও পুরুষরাই ঠিক করে এসেছে। পরিশ্রম করে দিনশেষে ঘরে ফেরা পুরুষ নারীকে চোখের প্রশান্তি হিসেবে পেতে চেয়েছে। তাই তারা সাজসজ্জাকে বানিয়েছে নারীর একচ্ছত্র অলঙ্কার। অন্যদিকে নারীর কমনীয়তার বিপরীত আচরণ করাকেই মানা হয়েছে পৌরুষের গৌরব। এই প্রচলিত ধারণাকে ভেঙেছে কোরিয়ানরা।
সৌন্দর্য নিয়ে তাদের অতিমাত্রার খুঁতখুঁতেপনা, শুচিবায়িতা অনেকক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি রকমের। কিন্তু সৌন্দর্যের একটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ মানদণ্ড দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে কোরিয়ানরা। ছেলে কেন সাজতে পারবে না- এমন একটি অসামাধানযোগ্য প্রশ্নকে তারা এনেছে সামনে। সৌন্দর্য অবশ্যই আপেক্ষিক। একজন ছেলের মসৃণ গালের সাথে গোলাপি ঠোঁট আপনার-আমার ভালো না-ই লাগতে পারে। কিংবা কার্গো প্যান্ট পরা বব কাটের মেয়ের চেয়ে দীর্ঘকেশী-শাড়িপরিহিতাই আপনার অধিক প্রিয় হতে পারে। কিন্তু কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা নয়, সে তকমা দেয়ার অধিকারও আমাদের নেই। পুরোটাই যে ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন। ঠিক-বেঠিক নির্ধারণের ঠিকাদারি যে কার, তাই তো অনির্ধারিত!
ফিচার ইমেজ: Soompi