পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মজার মজার কতই না জাদুঘর! বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এসব জাদুঘর যেমন বৈচিত্র্যময়, ঠিক তেমনি আমাদের চিন্তা-ভাবনার খোরাকও জোগায় এগুলো। এরকমই দুটি জাদুঘর হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত মুখোশ জাদুঘর, আরেকটি হচ্ছে উত্তর ইংল্যান্ডের কাম্বারল্যান্ডের কেসউইক গ্রামের পেনসিল জাদুঘর। জীবনে যদি এমন দারুণ কোনো অভিজ্ঞতা আপনি নিতে চান, তাহলে বিশ্বের এসব মজার মিউজিয়াম থেকে একবার ঘুরে না আসলেই যেন নয়। চলুন তাহলে এ দুই মিউজিয়াম সম্পর্কে একটু বিশদভাবে জানার চেষ্টা করি।
মুখোশ জাদুঘর
প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যগত অংশ হলো মুখোশ। নিজের পরিচিতি গোপন করার প্রয়োজনে মূলত মুখোশের প্রচলন শুরু হয় সেই প্রাচীনকাল থেকেই। পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে এটি। মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকেই মুখোশের সৃষ্টি। শুধু কি তা-ই? মুখোশ এখন প্রতিবাদ প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবেও প্রতীকী রূপ গড়ে নিয়েছে আমাদের মাঝেই। তেমনি এক বৈচিত্র্যময় এবং মজার জাদুঘর রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার হাহো নামের পুরনো এক গ্রামে, যার বিষয়বস্তু শুধুমাত্র এই মুখোশ।
কোরিয়াতে মুখোশ সংস্কৃতির রয়েছে এক উজ্জ্বল পদচারণা। কোরিয়ার ভাষায় মুখোশকে বলে ‘টাল’। দ্বাদশ শতক থেকেই মুখোশের ব্যবহার চলে আসছে কোরিয়ায়। কোরিয়রা যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে নিজেকে ও ঘোড়াকে মুখোশে মাধ্যমে আচ্ছাদিত করতো। ঐতিহাসিক কোনো বিষয়বস্তুকে মনে রাখার জন্য ডেথ মাস্ক ব্যবহার করতো তারা। কোরিয়ার সংস্কৃতিতে এই মুখোশ ব্যবহার হয় পূজো, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, নাচ, রাজসভা, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানে। অশুভ শক্তির প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে তারা মুখোশ ব্যবহার করতো। আর বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে দক্ষিণ কোরিয়ার হাহো নামের পুরনো এ গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে মুখোশের এক আশ্চর্য জাদুঘর যা বিশ্বের অন্যান্য জাদুঘর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ইউনেস্কো একে ওয়াল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
হাহো জাদুঘর শুধু কেবল মুখোশের জাদুঘর বললে ভুল বলা হবে, এই জাদুঘরে মুখোশের কিভাবে বিবর্তন ঘটলো, এর ব্যবহার কিভাবে শুরু হলো তা ধারাবাহিকভাবে অত্যন্ত সুনিপুণ আঙ্গিকে দর্শনার্থীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এখানকার সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে বংসান, গ্যাংনিয়ং, ছেয়ং প্রভৃতি ধরনের মুখোশ। এদের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন কোরিয়ার ঐতিহ্যের অন্তর্গত ‘হাহো’ মুখোশও।
জাদুঘরে রয়েছে মুখোশ নাচ ও মুখোশ নাচের ইতিহাস। মুখোশ-নাটিকা কোরীয়দের মধ্যে খুবই প্রচলিত। গ্রামের দিকে এই ধরনের নাটিকায় অভিনেতারা মুখোশের আড়ালে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। অন্য দেশের মুখোশের থেকে এই ধরনের কোরীয় মুখোশের রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। হাহো মুখোগুলোর বিভিন্ন অংশ এমনভাবে জোড়া লাগানো থাকে যে, শরীরের প্রতিটি নড়াচড়ায় মুখোশের অংশগুলোও পরিবর্তিত হয়। যেমন: মুখোশের চোয়াল দু’দিকে সরু সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে। মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিলেই সুতোয় টান পড়ে। ফলে চোয়ালের অংশ জোড়া হয়ে গিয়ে মনে হয়, যেন সে হাসছে। আবার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিলেই ঠিক উল্টোটা। যেন রাগ ঠিকরে বেরোচ্ছে। এমনকি চোখের ভ্রু নাচানোর ব্যবস্থাও আছে। মূলত কাঠের উপর খোঁদাই করে বিভিন্ন রঙের ব্যবহারে তৈরি করা হয় এই মুখোশ।
মিউজিয়ামে কোরিয়ার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মুখোশের সংগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও আরো অন্তত ৩০টি দেশের মুখোশ রয়েছে।
গোটা মিউজিয়াম জুড়ে রয়েছে ৩টি বড় এক্সিবিশন রুম। সবচেয়ে বড়টিতে রয়েছে কোরীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানের মুখোশ। দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে দেশ-বিদেশের নানা ধরনের মুখোশ। রয়েছে লাইব্রেরি ও রিসার্চের রুম। এছাড়াও মিউজিয়ামের সাথেই রয়েছে একটি গিফট কিউরিও শপ, যেখানে পেয়ে যেতে পারেন নানা ধরনের মুখোশ। পছন্দ হলেই কিনে নিতে পারেন। মিউজিয়াম খোলা থাকে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত। প্রবেশ মূল্য কোরীয় মুদ্রায় ২,০০০ won। তবে ছ’বছরের কম বয়সী ও বয়স্কদের কোনো টিকিট কাটতে হয় না। দেখেই আসুন না একবার, আপনার ভালো লাগবেই। সন্দেহ নেই।
পেনসিল মিউজিয়াম
ছোট্ট বয়সে আমাদের সকলেরই লেখালেখির হাতেখড়ি শুরু হয় চক দিয়ে। একটু বড় হলেই হাতে তুলে দেয়া হয় কাঠ পেনসিল। এই পেনসিলের মধ্য দিয়েই মূলত আামদের হাতের লেখার মূল গড়ন তৈরি হয়েছে। কিন্তু জানেন কি এই পেনসিলের রয়েছে অত্যাশ্চর্য এক জাদুঘর? শুনতে অবাক লাগলেও এই মজার জাদুঘর গড়ে উঠেছে খোদ ইংল্যান্ডে।
উত্তর ইংল্যান্ডের কাম্বারল্যান্ডের কেসউইক গ্রামেই এই পেনসিলের জাদুঘরটি অবস্থিত। প্রতি বছর প্রায় আশি হাজারেরও বেশি দর্শক ঘুরতে আসেন এই পেনসিল জাদুঘর। এই জাদুঘর তৈরির কাহিনীও বেশ মজার।
পনেরো শতকের দিকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাম্বারল্যান্ডের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সব ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। প্রচুর গাছপালা উপড়ে নষ্ট হয় রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি। সে সময় উপড়ে পড়া গাছের গুঁড়ির মাটির নিচে এক অদ্ভুত কালো রঙের পদার্থ চোখে পড়ে সকলের। এভাবেই প্রথম আবিষ্কার হয় গ্রাফাইট। যখন এলাকার অধিবাসীদের গোচরে এলো যে, এটি ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু ঘষলে কালো দাগ লেগে যায়, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় এর ব্যবহার। স্থানীয় রাখাল বালকেরা তাদের খামারের ভেড়া চিহ্নিত করার কাজে এই গ্রাফাইট ব্যবহার করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সেই গ্রাফাইট থেকেই তৈরি হতে থাকে পেনসিল।
১৮৩২ সালে প্রথম পেনসিল তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর এই কারখানার বহুবার মালিকানা বদল হয়। ১৮৫ বছরের সেই পেনসিল কারখানা কিন্তু এখনো টিকে রয়েছে বহাল তবিয়তে। কারখানাটিতে ছোটদের লেখার পেনসিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের রং পেনসিল তৈরি হয়ে আসছে বছরের পর বছর।
আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে কাম্বারল্যান্ডের পেনসিল কারখানার তত্ত্বাবধানেই কেসউইক গ্রামে তৈরি হয় একটি পেনসিল জাদুঘর। কাম্বারল্যান্ডের পেনসিল কারখানার টেকনিক্যাল ম্যানেজার বারবারা ম্যুরে এই মিউজিয়াম তৈরির ধারণাটি দেন। পরবর্তীতে কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার ধারণাটিতে সহমত পোষণ করে জাদুঘরটি তৈরির উদ্যোগ নেন। মিউজিয়ামটিতে রয়েছে ভিডিও থিয়েটার ও প্রদর্শনী, যেখানে দেখা যাবে ১০০ বছরের পুরোনো পেনসিল তৈরি ও প্যাকেজিং প্রণালী। তাছাড়া রয়েছে আরও প্রাচীন যন্ত্রপাতি যা দিয়ে সে সময় কর্মীরা নিপুণভাবেই পেনসিল তৈরি করতেন।
মিউজিয়ামটি সম্পূর্ণ ঘুরে দেখানোর জন্যে রয়েছে গাইডের সুব্যবস্থা। প্রথম পেনসিল তৈরি হয়েছিল কিছু গ্রাফাইটের কঞ্চিতে তার দিয়ে বেঁধে। পরে উদ্ভাবনী কৌশলে গ্রাফাইট পুরে দেওয়া হয় কাঠের টুকরোর ভেতর। আজকাল পেনসিলের পেছনে যে রাবার লাগানো থাকে তা সর্বপ্রথম তৈরি করেছিলেন জোসেফ রেচেলডর্ফার নামের এক ব্যক্তি। এছাড়াও মিউজিয়ামটিতে রয়েছে ড্রয়িং জোন যেখানে প্রতি সপ্তাহে নামীদামী শিল্পীদের আঁকার ওয়ার্কশপ আয়োজিত হয়ে থাকে। এমনকি ছাত্রদের শেখানোর জন্য আছে এডুকেশনাল ট্যুর। এই ট্যুরের খরচ মাত্র এক পাউন্ড। মিউজিয়ামের টিকিট মূল্য সাড়ে তিন পাউন্ড। মিউজিয়ামটি নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত প্রায় সারা বছরই খোলা থাকে।