মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা এক টুকরো চটের উপর কয়েকটি বই সাজিয়ে যে মেলার সূচনা করেছিলেন, সেই মেলা আজ পুরো জাতির দর্পণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফুটপাতে চটের উপর যে মেলা শুরু হয়েছিল, সেই মেলায় আজ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শত শত বর্ণিল স্টল, দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের ঢল এবং দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান হিসেবে এটি নিজের অবস্থান গড়ে নিয়েছে। এই মেলার একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছি এখানে।
উত্তাল দেশ এবং চটের উপর শুরু
বাংলাদেশে তখন যুদ্ধের যন্ত্রণা চলমান। অনেক বিশিষ্ট লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিককে শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করতে হয়েছিল। দেশের জন্য ভালো কিছু করার অপরাধে তাদের সকলের কারাবাসের শাস্তি হয়েছিল। তারা পালিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। নিয়মিতভাবে তারা একত্র হতেন জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের কলকাতাস্থ অস্থায়ী বাসায়। লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের এই আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সাহাও। নিয়মিত উপস্থিত থেকে থেকে দেশের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে তাদেরকে উৎসাহ দিতেন। নির্বাসিত এই লেখকদের বই প্রকাশ করার দায়িত্ব তিনি নিজেই নিলেন। সে সময় চিত্তরঞ্জন সাহার ভূমিকায় এবং অন্যান্যদের সহায়তায়‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ নামে কলকাতায় একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।[1] এই সংস্থাটিই পরবর্তীতে ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’তে পরিণত হয়।[2] স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে তখন ধীরে ধীরে তাদের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়।
সময় অতিবাহিত হয়, অন্ধকার আর কালিমার ঘোর কেটে যায়। তখন সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। শিশু বাংলাদেশের উপর তখনো প্রসব পরবর্তী রক্ত লেগে আছে। চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতা থেকে সেই লেখকদের বই নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বর্ধমান হাউজের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর শরণার্থী লেখকদের ৩২টি বই নিয়ে বসে যান বিক্রি করতে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রাথমিক উপাদান ছিল এই বইগুলো। সেজন্য বইয়ের ইতিহাসের পাশাপাশি দেশের ইতিহাসেও এদের গুরুত্ব অনেক।
চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত এই চর্চা একাই চালিয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে বই বিক্রি করার এই আইডিয়াতে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য প্রকাশনীরা এখানে বই সাজানোতে যুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালে কিছু প্রকাশক এসে একাত্ম হয় এবং আরো দুই বছর পর ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমী এর সাথে সংযুক্ত হয়। বইয়ের এই মেলার সাথে বাংলা একাডেমীর এই সম্পৃক্ততা মেলাকে অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে যায়। বাংলা একাডেমীর সক্রিয়তার ফলেই সেই বইমেলা আজকের এই গৌরবময় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। আশরাফ সিদ্দিকীর সক্রিয় ভূমিকার বাংলা একাডেমি সম্পৃক্ত হয় মেলার সাথে। আরো পরে ১৯৭৯ সালে ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’ও যুক্ত হয় মেলার সাথে।[3] উল্লেখ্য এই সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। এর মাধ্যমে একটা ত্বরিত অনুমান করা যায় একুশে বইমেলার পেছনে চিত্তরঞ্জন সাহার অবদান আসলে কত ব্যাপক ছিল।
আরো গভীরে
বইমেলার স্থপতি হিসেবে সবাই এক বাক্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সাহাকেই জানে। কিন্তু ইতিহাসের গভীর শেকড়ে প্রবেশ করলে আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য বের হয়ে আসবে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে বইমেলার বিস্তৃত ইতিহাস নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। ঐ প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশে বইমেলার ইতিহাস যেভাবে তুলে ধরেছেন তা অনেকটা এরকম-
বাংলাদেশে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। তবে এটা ছিল বিচ্ছিন্ন আয়োজন। ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহার হাতে শুরু করা বইমেলার মতো নিয়মিত ছিল না। সে সময়ে মেলার কথা মাথায় আসে সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। এর আগে তিনি কাজ করতেন বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমিতে সে সময় প্রচুর ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ ছিল। সে সময় Wonderful World of Books নামে একটি বই হাতে আসে সরদার জয়েনউদদীনের। এই বইটি পড়তে গিয়ে চমৎকার দুটি শব্দের সাথে পরিচিত হন তিনি। শব্দ দুটি হচ্ছে ‘Book’ ও ‘Fair’। আরে, আসলেই তো! বইয়েরও তো মেলা হতে পারে। জগতে কত হাবিজাবি জিনিসের মেলা হয়, সেখানে বই কী দোষ করলো? তিনি বইটি পড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বইয়ের মেলার একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেলে তা একটি জাতির জন্য কতটা ইতিবাচক হতে পারে।
এই বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর নীচতলায় বইয়ের ছোটখাটো একটি মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই আয়োজনের বইগুলো ছিল শিশুতোষ। শিশুতোষ হবার কারণ, ঐ সময়ে তিনি ইউনেস্কোর অধীনে শিশু-কিশোরদের গ্রন্থ বিষয়ক একটি কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এটি ছিল ১৯৬৫ সালের ঘটনা। রেকর্ড অনুসারে এটিই বাংলাদেশে বই বিষয়ক প্রথম মেলা। আর এর মূলে ছিলেন সরদার জয়েনউদদীন।
এরপর ১৯৭০ সালে তিনি আরেকটি বইমেলার আয়োজন করেন নারায়ণগঞ্জে। সেখানে এই আয়োজনে সাহায্য করেছিল নারায়ণগঞ্জ ক্লাব নামে একটি সংস্থা। সেখানের মেলায় বইয়ের বেচাকেনা বেশ ভালোই হয়েছিল। ভালো বেচাকেনার পেছনে অবশ্য একটি কারণও ছিল। সরদার জয়েনউদদীন সেবার বইমেলায় একটি গরুকে বেঁধে দেন। গরুর গায়ের উপর লিখেন ‘আমি বই পড়ি না’। গরুর গায়ের উপর ‘বই পড়ি না’ দিয়ে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্নভাবে সকলকে এরকম একটি বার্তা দিয়েছিলেন যে, যে সকল মানুষ বই পড়ে না তারা আদতে নিরেট গরুসদৃশ প্রাণী। এই যে তিনি একটি ডার্ক-হিউমার তৈরি করেছিলেন, তাতে লজ্জা পেয়ে অনেকেই বই কিনতে আগ্রহী হয়েছিল।[4]
বাংলাদেশে বইমেলার একটি সংস্কৃতি তৈরি করতে সরদার জয়েনউদদীনেরও শক্তিশালী একটি ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯৭২ সালেও একটি বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। সেটি বাংলা একাডেমির ভেতরেই হয়েছিল। ইউনেস্কোর উদ্যোগে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সালকে বিশেষ বর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হয়। যেমন ২০০৯ সালটি ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ বর্ষ। তেমনই ১৯৭২ সালটি ছিল আন্তর্জাতিক গ্রন্থ বর্ষ। আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে এই গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন তিনি। বইমেলা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের সাথে বাংলা একাডেমীর সংযুক্তি তখন থেকেই।
তবে বিশেষ এই বইমেলার ঘটনাটি ছিল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে। ততদিনে চিত্তরঞ্জন সাহা সহ অন্যান্যরা বইমেলার আয়োজন করে ফেলেছেন। হতে পারে সেটা বাংলা একাডেমির সীমানার বাইরে, কিন্তু তাদের হাতে মেলার শুরু হয়ে গিয়েছিল ফেব্রুয়ারিতেই। শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ অনুসারে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বই সাজিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহাই প্রথমে বই নিয়ে বসে যান নি। প্রথম এর শুরু করেন স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স-এর রুহুল আমিন নিজামী। তখনকার সময়ে রাশিয়ান বইয়ের খুব প্রচলন ছিল। রাশিয়ায় ছাপা প্রগতি ও রাদুগা প্রকাশনীর বই বেশ চলতো। উচ্চ সাহিত্যমানের এই বইগুলো ছিল বেশ স্বল্প মূল্যের। তাই চলতোও বেশি। সেসব বই নিয়েই বসেছিলেন রুহুল আমিন নিজামী। উনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে আসেন মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা।
নামকরণ ও সুস্পষ্ট রূপ
বইমেলা অনেকদিন ধরেই চলছিল, কিন্তু তার নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট কোনো রূপ ছিল না। ‘বাৎসরিক বইমেলা’ বা ‘ঢাকার বইমেলা’ এরকম পরিচয় ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে একুশের চেতনার সাথে বইমেলাকে স্থায়ীভাবে মুড়িয়ে নেয়া হয়। তৎকালীন সময়ে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন মনজুরে মওলা। তিনি ১৯৮৩ সালে এই বইমেলাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমালা’ হিসেবে আয়োজন করার চেষ্টা করেন। দুর্ঘটনাবশত এটি এক বছর পিছিয়ে ১৯৮৪ সালে চলে যায়। তখন ক্ষমতায় ছিল স্বৈরশাসক এরশাদ। সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিল তৈরি হলে স্বৈরাচারী সরকার মিছিলের মাঝে ট্রাক তুলে দেয়। এতে দুজন ছাত্র প্রাণ হারায়। এই দুর্ঘটনার রেশ ধরে ঐ বছর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আয়োজন করা সম্ভব হয় নি। তবে এরপর থেকে গ্রন্থমেলা নিয়মিতই হয়ে এসেছে।
মেলার সময় ও স্থানের পরিসর
প্রথম দিকে মেলা খুব স্বল্প সময়ব্যাপী হতো। এক সপ্তাহ। ১৫ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলা একাডেমির বইগুলোর উপর বিশেষ ছাড় থাকতো। পরবর্তীতে মেলা ১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। মোট ২১ দিন। মাঝে একসময় ২১ দিন থেকে কমিয়ে ১৪ দিনেও আনা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবীর মুখে পরের বছরই সেটি ২১ দিন পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়।[5] পরবর্তীতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা যখন শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রকাশকদের দাবীর মুখে ২১ দিন থেকে বাড়িয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। সেই হিসেবে এই মেলা ২৮ দিন ব্যাপী হয়। অধিবর্ষে সেটি ২৯ দিন ব্যাপীও হয়। ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালে দাবী উঠেছিল মেলার সময়ের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে যেন ২৬ শে মার্চ পর্যন্ত করা হয়। যদিও এটি আমলে নেয়া হয় নি।
স্থানের ইতিহাসও সময়ের ইতিহাসের মতোই ক্রমস্ফীতমান। একটা সময় ছিল মেলা সবসময় বাংলা একাডেমীর ভেতরেই হতো। একদম শুরুতে স্বল্প কিছু প্রকাশক ছিল। চুন দিয়ে মাটিতে ও দেয়ালে বিভাজক তৈরি করে প্রকাশকদের স্থান আলাদা করে দেয়া হতো। এখন সেই দিন অতীত। অনেক অনেক প্রকাশকের সমাগম হয় একুশে বইমেলায়। ২০১২ সালে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা ছিল ৪২৫।[6] প্রচুর প্রকাশক ও প্রচুর লোকসমাগমের কারণে বাংলা একাডেমিতে স্থানের সংকুলান হচ্ছিল না। এসব দিক বিবেচনা করে ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির অদূরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মেলাকে স্থানান্তরিত করা হয়।[7] এর ফলে মেলা বেশ সম্প্রসারিত হয়।
পুরষ্কার
বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তিনটি পুরষ্কার প্রদান করে থাকে। ১. চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার; ২. সরদার জয়েনউদদীন স্মৃতি পুরস্কার; ৩. পলান সরকার স্মৃতি পুরস্কার। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে গ্রন্থমেলার অন্যতম কাণ্ডারি চিত্তরঞ্জন সাহার নামে প্রথম পুরষ্কারটি প্রবর্তন করা হয়েছে। আগের বছর প্রকাশিত সেরা মানের বইয়ের জন্য সেরা প্রকাশককে এই পুরস্কার দেয়া হয়। আর গ্রন্থমেলার স্টল নির্মাণ ও অঙ্গসৌষ্ঠবের জন্য সেরা স্টলকে ২ নম্বর পুরষ্কারটি প্রদান করা হয়। ৩ নম্বর পুরষ্কারটি নির্ধারিত আছে সেরা ক্রেতার জন্য। মেলায় সর্বাধিক পরিমাণ বই কিনবে যে ব্যক্তি তাকে দেয়া হয় পলান সরকার স্মৃতি পুরষ্কার।[8]
উপসংহার
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি জ্ঞানচর্চার পেছনে অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রভাব ব্যাপক। বইমেলার সময়ে যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় তার অর্ধেক পরিমাণ বইও প্রকাশিত হয় না বাকি ১১ মাসে। বইমেলা এলে প্রকাশনা-ছাপাখানাগুলোতে পা ফেলার অবকাশ থাকে না। এ থেকে বোঝা যায় বাংলার মননে এই মেলার প্রভাব, অবদান ও গুরুত্ব কতটুকু। মেলার সুষ্ঠু পরিচালনা হোক এবং মেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা শূন্যের কোঠায় নেমে আসুক এই কামনাই করছি।