বর্তমান এশিয়া মাইনরের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের দিকে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী এক সভ্যতা। ধীরে ধীরে যারা প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্য। আয়তনে বিশাল এবং ক্ষমতায় প্রবল। তাদের প্রভাব এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, সমকালীন হিব্রু ধর্মগ্রন্থ এবং মিশরীয় লিপিতেও নাম দেখা যায়। ইতিহাসে তারা পরিচিত হিট্টাইট বা হিট্টি সভ্যতা নামে। ধর্ম এবং বিশ্বাসের ইতিহাসে তাদের প্রভাব একেবারে উপেক্ষা করা যায় না।
হিট্টিদের ইতিহাস মোটা দাগে দুইটা সময়ফ্রেমে বিভক্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত সময় পুরাতন রাজবংশের যুগ; ১৪০০ থেকে ১২০০ অব্দ পর্যন্ত সময় নতুন রাজবংশের যুগ। মধ্যবর্তী সময়টুকু বিক্ষিপ্ততা ও অন্ধকারের; যা নিয়ে খুব একটা নিশ্চয়তায় আসা যায় না। সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ সম্রাট প্রথম সুপ্পিলুলিউমা (১৩৪৪-১৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার পুত্র দ্বিতীয় মুরসিলি (১৩২১-১২৯৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এর আমল। তারপর থেকেই ধীরে অবক্ষয় এবং সবিশেষ আসিরিয়দের কাছে পতন।
হিট্টিদের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় জীবানাচার নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। কেবল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, প্রাপ্ত লিপি থেকে দৈবধারণা এবং বিভিন্ন উৎসবের রেওয়াজ থেকে সংস্কৃতির ধারণা মেলে। ধারণা পাওয়া যায় বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে।
প্রাচীন এশিয়া মাইনর কৃষি ও পশুপালনে সমৃদ্ধ ছিল। সেই প্রভাব পড়েছে সেখানকার ধর্মচিন্তা এবং আচারে। প্রতিবার প্রার্থনায় সাধারণ মানুষ সম্রাট ও তার পরিবারসহ যে শক্তির প্রভাবে হিট্টির ভূমিতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়, তাদের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতো। সমকালীন লিপিতে ‘সহস্রদেবতা’ বলে উল্লেখ করা হলেও তাদের নাম বা নিদর্শন মেলেনি। অবশ্য নেরিক, হাততুসা এবং সাপিনুয়ার মতো নগরগুলোতে পৃথক বিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সাথে দেখা যায় পার্শ্ববর্তী লুউইয়ান বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রভাব। খ্রিষ্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের দিকে বিচ্ছিন্ন উপাস্যদের বিশেষ সংগঠিত অবস্থায় উপসনা শুরু হয়; যার প্রমাণ ইয়াজিলিকায়ার ধ্বংসাবশেষ। দেবতাদের এমন চক্র বা দল পরিচিত ছিল কালুতি নামে।
সবচেয়ে পরিচিত সূর্যদেবী উরুসিমা। ইন্দো-ইউরোপীয় অধিকাংশ উপকথাতেই সূর্যকে দেবতা বলে চিহ্নিত করা হলেও হিট্টাইট সংস্কৃতিতে এসেছে দেবী রূপে। উরুসিমা কেবল সূর্যদেবী ছিলেন না; ছিলেন ধরণী মাতাও। এইজন্যই প্রাচীন প্রার্থনাতে তাকে হুরিয়ান দেবী খেবাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
“হে আরুন্য নগরের সূর্যদেবী! হে মহিয়সী!! আপনি এই জমিনের রাণী। হাত্তি নগরে আপনি আপনি সূর্যদেবী নাম নিয়েছেন। কিন্তু দারুবৃক্ষের দেশে (হুরিয়া) আপনিই খেবাত।”
সূর্যদেবী উরুসিমার বিয়ে হয় দেবতা তারহান্ত-এর সাথে। তাদের দুইজনের সন্তান তেলিপিনু এবং ইনারা। তেলিপিনু ছিলেন কৃষির দেবতা; অন্যদিকে ইনারা প্রতিরক্ষার দেবী। তাদের বাইরে আছেন চিকিৎসার দেবি কামরুসিপা। ক্রমে হুরিয়ান উপাস্যরা প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে কুমারবি এবং উলিকুম্মি অন্যতম।
হিট্টাইট বিশ্বাসে দেবতা এবং মানুষের মধ্যস্থতায় যাজকশ্রেণির অতটা দাপটের নজির দেখা যায় না। অন্তত মিশরীয় কিংবা মেসোপটেমিয় সভ্যতার মতো প্রভাব অর্জন করতে পারেনি। এখানে দেবতা এবং মানুষকে একে অপরের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এক প্রার্থনায় দেখা যায়,
সমস্ত হাত্তির জমিন শুকিয়ে যাচ্ছে; ফলে কেউ আপনাদের জন্য উৎসর্গ করতে পারছে না। কৃষক মারা গেছে, ফলে দেবতার জমিতে কাজ করার বা ফসল তোলার কেউ নেই। কর্মী নারীটিও বেঁচে নেই, ফলে দেবতাদের জন্য উৎসর্গ দ্রব্য প্রস্তুত করার কেউ নেই। গরু ও মহিষের রাখাল মারা গেছে। খোয়ারগুলোও শূন্য। ফলে উৎসর্গও থেমে গেছে। হে দেবতাগণ, দেখুন। এইখানে আমাদের ঘাড়ে কীভাবে দায় চাপাবেন!
রাজা ছিলেন হিট্টাইট জীবনব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক। তাকে গণ্য করা হতো মহাবিশ্বের অপরিহার্য উপাদান হিসাবে। যার প্রভাব পড়েছিল ধর্মজীবনে। সম্রাট একাধারে দেবতাদের মনোনীত মানুষের প্রতিনিধি। অন্যদিকে মানুষের কাছ থেকে দেবতাদের প্রতি সমস্ত প্রার্থনা ও উপাসনা প্রেরণের বাহক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য খোদ সম্রাটই পরিগণিত হয়েছে সূর্যদেবতা হিসেবে। ইয়াজিলিকায়াতে ধারণা করা হতো রাজা মৃত্যুবরণ করলে দেবতার রূপ গ্রহণ করেন। ফলে সেখানে মৃত সম্রাটের প্রতিও উপাসনা উৎসর্গ করা হতো। প্রায় ক্ষেত্রেই রাণীকে তুলনা করা হতো সূর্যদেবীর সাথে। অর্থাৎ রাজপরিবার নেহায়েত একটা পরিবার না। দুনিয়ায় স্বর্গীয় উপস্থিতি। ফলে রাজপরিবারের সদস্যরাও বছরের বিভিন্ন সময়ে পূজা পেতেন। সেখানে তীব্র না আকারে না হলেও পার্শ্ববর্তী মিশরীয় কিংবা মেসোপটেমিয় ধর্মের প্রভাবও দেখা যায়। দায়িত্ব গ্রহণকালে রাজা আবৃত্তি করতেন-
সূর্যদেবতা ও চন্দ্রদেবতা আমার প্রতি আস্থা রেখেই রাজত্ব দিয়েছেন। দিয়েছেন ভূখণ্ড এবং নাগরিকদের উপর কর্তৃত্ব। আর তাই আমি রাজা হিসাবে এই রাজ্যের ভূখণ্ড এবং নাগরিকদের রক্ষা করবো সমস্ত বিপদ থেকে।
বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা মন্দির ছিল দেবতাদের বাসস্থান। যাজকদের জন্য থাকতো নানা রকম যাগ-যজ্ঞ এবং কঠিন নিয়ম কানুন। দেবতাভেদে উপাসনার রীতি ও সময় ভিন্ন। দেবতার প্রাধান্য হিসেবে তারতম্য হতো মন্দিরের চাকচিক্যেও। মন্দিরের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর সংস্থান করতে পাশেই থাকতো ওয়ার্কশপ এবং স্টোররুম। কিন্তু প্রত্যেক দেবতার মন্দিরের জন্যই বিভিন্ন অনুপাতে নগরের বাইরে ফসলি জমি বরাদ্দ থাকতো। অর্থাৎ মন্দিরের প্রভাব নেহায়েত কম ছিল না। উৎসবের দিনগুলোতে স্থানীয় দেবদেবীরা পেতেন সম্পূর্ণ নতুন রূপ। তার একটা প্রমাণ খ্রিষ্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকে লাপানায় প্রাপ্ত একটা জরিপের মধ্যে।
দেবী ইয়াইয়ার কাঠের মূর্তি। উচ্চতা এক কিউবিট। স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া মাথা। শরীর আর সিংহাসনে প্রলেপ টিনের। কাঠে নির্মিত দুইটা পাহাড়ি মেষ। দেবীর দুই পাশে বসিয়ে রাখা। তাদের শরীরেও টিনের প্রলেপ বসানো। এছাড়া টিনের প্রলেপ দেয়া একটা ঈগলমূর্তি, তামানির্মিত দুটি গামলা এবং ব্রোঞ্জনির্মিত দুটি পানপাত্র। দেবীর নতুন মন্দির। পুরোহিত একজন পুরুষ।
হিট্টাইট দেবতারা যেন এক বিশেষ অভিজাত শ্রেণি। মন্দির ছোট হোক কিংবা বড়। কোনো অবস্থাতেই দেবদেবীদের অযত্নে পড়ে থাকতে হতো না। উপরন্তু তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো খাদ্য। পরিয়ে রাখা হতো মূল্যবাদ কাপড়। আর এ সবই থাকতো যাজকদের প্রাত্যহিক কাজের তালিকায়। উৎসবের মৌসুমে তা পেতো বাড়তি মাত্রা। উপাস্য ভেদে উৎসবের সময় যেহেতু ভিন্ন; তাই সাংস্কৃতিকভাবে বছর জুড়েই লেগে থাকতো আমেজ। তবে বেশিরভাগ উৎসব ছিল কৃষি পঞ্জিকাকে অনুসরণ করে। আরো স্পষ্ট করে বললে ফসল তোলার মৌসুমে। হাত্তুসাতে নতুন বছরের আগমনকে বরণ করা হতো ঝড়ের দেবতাকে উপাসনা দিয়ে।
উৎসবগুলোর গুরুত্ব এতটাই ছিল যে, সেখানে খোদ রাজাকে হাজির থাকতে হতো। ফলে শরৎ এবং বসন্তে সম্রাটকে দুই দফায় ধারাবাহিক দীর্ঘ সফর করতে হতো। কেবল বসন্তেই এই সফরের বিস্তৃতি থাকতো ৩৮ দিন। মাঝে মাঝে রাজার পক্ষ থেকে হাজির থাকতেন রাজপুত্র, রানী কিংবা অন্য কোন প্রতিনিধি। খাবার ও অন্যান্য উপঢৌকনের পাশাপাশি বিশেষ দিনগুলোতে ছিলো নানান উদ্যোগ। থাকতো ঘোড়াদৌড়, মল্লযুদ্ধ এবং পাথর নিক্ষেপের মতো প্রতিযোগিতা। পরিবেশন করা হতো নাচ এবং গান। ধারণা করা হতো, উপাসনায় দেবতারা সন্তুষ্ট হলে কৃষিতে সমৃদ্ধি আসবে। নাগরিক জীবনে আসবে সুখ। রাজার রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং জন্ম নেবে যোগ্য উত্তরসূরী। রাজা জয় লাভ করবেন ভিন্ন রাজ্যের উপর। অর্থাৎ দেবতাদের কোন সন্তুষ্টি লাভে ব্যর্থতা মানেই সেই বছরে দুর্ভোগ।
হিট্টাইট জীবনে ছোটখাটো রোগব্যাধিকেও মনে করা হতো দেবতাদের ক্রোধ। দ্বিতীয় মুরসিলির সময়ে হাত্তিতে মহামারি হয়। তার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় উৎসবে উদযাপনে অনীহা এবং মিশরের সাথে চুক্তি ভঙ্গকে। সাংস্কৃতিক ভাবে পালিত হতো জন্ম, মৃত্যু এবং রাজার সিংহাসনে অভিষেকের মতো ঘটনা। মিশরীয় ও মেসোপটেমিয় সভ্যতার মতো হিট্টাইট সংস্তৃতিও প্রাধান্য বিস্তার করেছিল বিভিন্ন মাত্রার পৌরাণিক আখ্যান।
মানুষের যাবতীয় দুর্ভোগের প্রথম কারণ দেবতাদের ক্রোধ; দ্বিতীয় পাপরাতার। পাপরাতার-এর সহজ অর্থ দূষণ। মানুষ ক্রমাগত খারাপ কাজ করতে থাকলে তার ভেতর দূষিত হতে থাকে। ফলে সে নিজের জন্য নিয়ে আসে দুর্ভোগ। আবার, অন্য কেউ জাদু করলেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই এই দূষণের প্রভাব ব্যক্তির অনিষ্ট; যা দূর করতে উপাসনা এবং পাল্টা জাদুর আশ্রয় নেয়া হতো। পারিবারিক কলহ এবং ব্যক্তিগত সমস্যগুলো থেকেও মুক্তি লাভের জন্য পালিত হতো বিশেষ আচার।
হিট্টাইট ধর্মবিশ্বাসে দেবতা আর মানুষ চিরন্তন চুক্তিতে আবদ্ধ। একদিকে মানুষ ও তাদের প্রতিনিধি হিসেবে শাসকগণ নিজেদের অভাব তুলে ধরতো প্রার্থনার মাধ্যমে। অন্যদিকে দেবতাগণ বিভিন্ন ইশারা ও স্বপ্নের মাধ্যমে জানাতেন নিজেদের ইচ্ছা ও অসন্তুষ্টি। ফলে ভবিষ্যদ্বাণী শোনা ও শোনানোর রীতি পেয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিকতা। কৃষি নির্ভরতার সাথে ক্রমাগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব পড়েছিল মানুষ-দেবতা সম্পর্কে। সেই প্যাটার্ন অনুসারেই গড়ে উঠেছে বিশ্বাস ও উপকথা। পরবর্তী ধর্মবিশ্বাসে যা যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। পরবর্তী রোমান এবং রাশান সাম্রাজ্যের যুগে যে দুই মাথাওয়ালা ঈগলের প্রতীক ব্যবহৃত হতো; তার আদি শিকড় হাত্তুসাতে।