বেশিরভাগ মানুষই কখনও তাদের প্রিয় সিরামিকের পাত্র যে ভেঙে টুকরো টুকরো করবে না সেটাই স্বাভাবিক। আর, কোনো কারণে প্রিয় পাত্র ভেঙে গেলে তা সানন্দে সম্মানিত করা তো দূরের কথা। তবে জাপানে অনেক সময় এর বিপরীতও হতে পারে। হয়তো কেউ ইচ্ছা করেই নিজের প্রিয় পাত্র ভাঙতে পারে, কিংবা যেন তা কোনোভাবে ভেঙে যায় সেই আশাও করতে পারে! আসলে ভাঙা সিরামিকের পাত্রকে স্বর্ণের গুঁড়া ও বার্নিশের বিভিন্ন উপকরণ যোগে নতুন করে গড়ে তোলা জাপানের ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ, যার দরুন এসব ভিন্ন প্রত্যাশাও কারে কারো মনে সৃষ্টি হতে পারে। এটি অপূর্ণতাকে লুকিয়ে রাখার পরিবর্তে সকলের নিকট বিনা সংকোচে তুলো ধরতে শেখায়, এবং এই ঐতিহ্য মানুষের ভঙ্গুরতার সৌন্দর্যের একটি অনুস্মারক। ভাঙা-গড়ার জাপানি এই সংস্কৃতিই হলো ‘কিন্ৎসুগি’।
কিন্ৎসুগি কী?
কিন্ৎসুগির ‘কিন’ (Kin) অর্থ সোনালি এবং ‘ত্সুগি’ (tsugi) অর্থ সংযুক্তি। এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় সোনার জোড়া বা স্বর্ণের মাধ্যমে সংযুক্তকরণ (Golden joinery)। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ একপ্রকার বার্নিশ উপকরণের সাথে গুঁড়ো সোনা, রূপা বা প্লাটিনাম দিয়ে ভাঙা সিরামিক পাত্র মেরামত করা হয়। মূলত, জাপানি উরুশি বার্নিশ উপাদান ব্যবহৃত হয় এই প্রক্রিয়ায়, যা তৈরি হয় উরুশি গাছের রস থেকে। প্রায় ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে জাপানে এই বার্নিশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি অত্যন্ত টেকসই উপাদান, যা নতুন করে প্রয়োগের পরও অতিশয় আঠালো ও জোরালো থাকে। এই বার্ণিশ উপাদানে গুঁড়ো ধাতু যুক্ত করলে তা সক্রিয়ভাবে বার্নিশের স্থায়িত্ব বাড়ায়।
জনপ্রিয় লোককাহিনীতে জাপানের ‘কিন্ৎসুগি’
কিন্ৎসুগি জাপানের চা উৎসব ‘চানোয়ু’র জন্য ব্যবহৃত সিরামিকের পাত্রগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। সিরামিক পাত্র এই চা উৎসবের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। আর এসব চায়ের পাত্র তাদের মালিকদের জন্য হয়ে ওঠে অত্যন্ত প্রিয় ও প্রয়োজনীয়। ধারণা করা হয়, মুরোমাচি যুগে উৎপত্তি এই কিন্ৎসুগির। আমেরিকান শিল্প সমালোচক ব্ল্যাক গোপনিকের মতে, ১৫ শতকের শেষের দিকে জাপানের ৮ম জেনারেল বা সামরিক একনায়ক শোগুন আশিকাগা ইয়োশিমিতসুরের মাধ্যমে এর সূচনা হয়। তার প্রিয় চায়ের পাত্র দুর্ঘটনাবশত ভেঙে ফেলেন তিনি। তবে সেই পাত্র তার কাছে এতটাই প্রিয় ছিল যে মেরামতের জন্য শোগুন আশিকাগা তা চীনে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই চায়ের পাত্র যখন ফেরত আসে, তখন দেখা যায় সেটি অসুন্দর কোনো ধাতব পদার্থ দিয়ে কোনোরকমে মেরামত করা। সেই পাত্রগুলোর কুৎসিত রূপ পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব তখন দেওয়া হয় জাপানি কারিগরদের। শোগুনের প্রিয় ভাঙা চায়ের পাত্রকে নতুনের মতো সুন্দর করা বা এর চেয়েও দৃষ্টিনন্দন রূপ দেওয়ার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তারা। কুশ্রী ধাতু দিয়ে ভাঙা পাত্র জুড়ে দেওয়ার বিকল্প হিসেবে শুরু হয় তা স্বর্ণ দিয়ে জুড়ে দেওয়ার কাজ। এভাবেই শুরু কিন্ৎসুগির, যা কোনো ক্ষতিকে লুকোতে নয়, বরং তা কীভাবে মেনে নিয়ে নতুন করে চলতে হয় তা শেখায়। পরবর্তীতে এই স্বর্ণ দিয়ে জুড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া এতটাই পরিচিতি লাভ করে যে অনেক জাপানি সংগ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে সিরামিক পাত্র ভেঙে সোনায় মেরামত করাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
কিন্ৎসুগির পেছনের দর্শন
কিন্ৎসুগির সাথে ‘ওয়াবি-সাবি’ নামক জাপানি একটি ধারণা বা দর্শনের মিল পাওয়া যায়। এই ধারণা আমাদের ক্রমাগত সকল অপূর্ণতার মাঝে সৌন্দর্য অনুসন্ধান করতে এবং জীবনের প্রাকৃতিক চক্রকে মেনে চলার অনুপ্রেরণা দেয়। এটি আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা বা আমাদের জীবনের প্রতিটি জিনিসই অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ এবং অপূর্ণ। তাই জীবনের কোনো পর্যায়ে পুরোপুরি পরিপূর্ণতা অর্জন করা অসম্ভব। সর্বোপরি, ভালো-মন্দ সব নিয়েই এই ক্ষণস্থায়ী জীবন। এই দর্শন কিন্ৎসুগির জন্য অনেকাংশেই প্রযোজ্য। ভাঙা পাত্রের প্রতিটি ফাটল বা ভাঙনকে কোনো বস্তুর জীবনের একটি ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। আর ঘটনার ফল, সেটা ভালো কিংবা খারাপ যা-ই হোক, তা জীবন থেকে মুছে না ফেলে সেটা সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাওয়া উচিত। এটাই ফুটে ওঠে কিন্ৎসুগির মাধ্যমে গড়ে তোলা পাত্রে।
ওয়াবি-সাবির সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত সমর্থক সেন নো রিকইউ (১৫২২-৯১) সম্পর্কে একটি গল্পের প্রচলন রয়েছে। জাপানে একবার সফরকালে তাকে একজন নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানায়। সেই দাওয়াতে আয়োজক বার বার তার মূল্যবান চীনা ও প্রাচীন চায়ের পাত্রের দিকে সেনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সেনো হয়ত মুগ্ধ হয়ে যাবেন এত সুন্দর প্রাচীন চায়ের পাত্র দেখে, এবং প্রশংসা করবেন তার মূল্যবান পাত্রের। তবে সেই দাওয়াতের পুরো সময়টাই সেনের সব গল্প ও প্রশংসা বরাদ্দ রয়ে গেল প্রকৃতির জন্য। সেন চলে যাওয়ার পর ক্ষোভে ও হতাশায় তিনি পাত্রটি ভেঙে ফেললে তার পরিবারের সদস্যরা সেটি এক কিন্ৎসুগি কারিগরের মাধ্যমে মেরামত করান। পরবর্তীতে রিকইউ যখন আবার তার বাড়ি আসেন, তখন সেই মেরামত করা পাত্রটি দেখে প্রশংসার একটি জ্ঞাত হাসি দিয়ে বললেন, “এখন পাত্রটিকে চমৎকার লাগছে।“
কিন্ৎসুগি আরেকটি জাপানি দর্শন ‘নো-মাইন্ড’ (মুশিন)-এর সাথেও সম্পৃক্ত, যা মানবজীবনের অসংযুক্তি, পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্যতা এবং ভাগ্যের ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কোনো ক্ষতিকে লুকানোর চেষ্টা নয়, বরং ক্ষতির শিকার কোনো কিছু সুন্দর করে মেরামত করার বা শুধরে নেওয়ার বিষয়টি সকলের দৃষ্টিগোচর করা প্রয়োজনীয় বলে অ্যাখা দেয় এই দর্শন। আক্ষরিক অর্থে ‘মুশিন’-কে ‘নো মাইন্ড’ হিসেবে অনুবাদ করা হলেও এর আসল অর্থ দাঁড়ায় মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান, অসংযুক্ত ও সাম্যে থাকা। এই দর্শনের প্রেক্ষিতে সময়ের সাথে মানুষের জীবনে অস্তিত্বের পরিবর্তনগুলো সিরামিকের ভাঙা ও নতুন করে গড়ার সাথে তুলনীয়। আর অস্তিত্বের এই নান্দনিকতা জাপানে ‘মোনো নো অ্যাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত, যা একটি সহানুভূতিশীল সংবেদনশীলতা বা সম্ভবত নিজের বাহ্যিক রূপের সাথে পরিচিত হওয়াকে বোঝায়।
অপর যে ধারণার সাথে কিন্ৎসুগির যোগসূত্র রয়েছে তা হলো ‘মোতাইনাই’ (Mottainnai)। এর অর্থ- ‘কত অপচয়!’ মোতাইনাই হলো একটি গভীর অনুশোচনা, যা কোনো কিছু নষ্ট করার কারণে হয়। এই দর্শন মানুষকে অপচয় কমাতে এবং পুনঃব্যবহার করতে উৎসাহিত করে। কিন্ৎসুগিতে যা হলো সিরামিকের পাত্রের পুনর্ব্যবহার। প্রতিটি বস্তুই অনন্য, তাই কোনোকিছু সম্পূর্ণভাবে বাতিল না করে সেটাকে পুনরায় মেরামত ও ব্যবহার করা উচিৎ। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ধারণা বা দর্শনের সাথে কিন্ৎসুগির উদ্দেশ্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
কিনতসুগির বিভিন্ন পদ্ধতি
প্রধানত তিন ধরনের কিন্ৎসুগি পদ্ধতি দেখা যায়। একটি হলো ‘ক্র্যাক’ (Crack) পদ্ধতি, যেখানে স্বর্ণের গুঁড়া এবং বার্নিশ উপাদান বা রেজিন ব্যবহার করে ভাঙা টুকরাগুলো ন্যূনতম অংশ আবৃত করে একত্রে সংযুক্ত হয় অথবা অনুপস্থিত টুকরাগুলোর স্থান পূরণ করে। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো ‘পিস’ (Piece) পদ্ধতি, যেখানে স্থান পূরণ করার মতো কোনো সিরামিক খণ্ড পাওয়া যায় না, এবং পুরো অংশই জোড়া লাগানো হয় স্বর্ণ ও বার্নিশ উপাদান যোগে। এর পরেরটি হলো ‘জয়েন্ট কল’ (Joint call), যেখানে ভাঙা স্থান পূরণের জন্য ভিন্ন আকারের একটি বা কয়েকটি টুকরো বসানো হয়, যা জোড়াতালির নকশা বা প্যাচওয়ার্ক প্রভাবের সৃষ্টি করে।
আধুনিক যুগে কিন্ৎসুগি
সময়ের সাথে সাথে কিন্ৎসুগি পদ্ধতি চীন, ভিয়েতনাম এবং কোরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে এই প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে কারিগরদের ‘ক্র্যাকলেগলেজ’ (Crackleglaze) ও ‘গোল্ড লাস্টার’ (Gold lustre)-এর মতো আলংকারিক ফিনিশ ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করে। আমেরিকার সিরামিক শিল্পী ডিক লেহম্যান তার ভ্রমণকালে লক্ষ্য করেন, বর্তমানে জাপানি চায়ের পাত্র বা অন্যান্য সিরামিক পাত্র স্বর্ণের গুঁড়া ছাড়াও শুধু বার্নিশ উপকরণ, রেজিন, তামার গুঁড়া, রূপার গুঁড়া, মাইকা গুঁড়াসহ অন্যান্য আরো ভিন্ন প্রকার উপাদান দিয়ে মেরামত করা হয়।
কোন উপাদান দিয়ে এই মেরামত বা কিন্ৎসুগি করা হবে তা নির্ভর করে কোন উদ্দেশ্য তা ব্যবহৃত হবে সেটার উপর। উদাহরণস্বরূপ, জাদুঘরে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হলে ভাঙা পাত্র সাধারণত আসল স্বর্ণের গুঁড়া রেজিনের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। আর নিত্যদিনের কোনো কিছু মেরামত করতে হলে সোনালি রঙের ইপোক্সি পেস্ট ব্যবহারেই সেরে ফেলা হয়। তবে অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন, কিন্ৎসুগি শুধুমাত্র অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু দিয়ে এবং প্রাচীন সিরামিক পাত্র মেরামতেই ব্যবহার করা উচিত। এটি বর্তমানে একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, বিশ্বজুড়ে অনেক সিরামিক শিল্পীই এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করেন নতুন তৈরি কোনো পাত্রের ত্রুটি লুকানোর জন্য বা শুধু শুধুই সস্তা উপকরণে ভিন্ন মাত্রার ডিজাইন করার উদ্দেশ্যে, যা আসল উদ্দেশ্য বা দর্শন থেকে পুরোপুরি আলাদা।