“অন্যকে জানার নাম বুদ্ধি; নিজেকে জানার নাম প্রজ্ঞা
অন্যকে আয়ত্তে রাখা- শক্তি; নিজেকে আয়ত্তে রাখা- সত্যিকার ক্ষমতা।
যদি বুঝতে পারো তোমার পর্যাপ্ত আছে,
তবে তুমি যথার্থ ধনী।
কেন্দ্রকে আকড়ে ধরো,
নিজের সমস্তটা দিয়ে গ্রহণ করে নাও মৃত্যুকেই,
দেখবে তুমি অমর।”
(তাও তে চিং, অনুচ্ছেদ- ৩৩)
আখ্যানের শুরু খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচশত বছর আগে। প্রাচীন চীনের প্রকৃতিবাদের মধ্য থেকে উঠে আসে আনকোরা এক জীবনদর্শন- তাওবাদ। বৈশিষ্ট্যগতভাবে একে বরং ধর্ম আর দর্শনের সমন্বয় বলা যেতে পারে। প্রথম দিকে লোকজ বিশ্বাস হিসাবে থাকলেও তাং সাম্রাজ্য (৬১৮-৯০৭)-এর আমলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। সম্রাট শুয়াংচং (৭১২-৭৫৬ খ্রি.) তো রীতিমতো এগিয়ে যান কয়েক ধাপ সামনে। রাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে বাধ্যতামূলক করে দেন তাওবাদের গ্রন্থ রাখা। পরবর্তীতে বহু শতাব্দী ব্যাপী সেই আধিপত্য অক্ষুন্ন ছিল।
বর্তমানেও চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত পাঁচটি ঐতিহ্যের মধ্যে একটি তাওবাদ। জীবনবোধটি জোর দেয় প্রকৃতির প্রবাহমানতার মাঝে নিজেকে ছেড়ে দেবার উপর। আরো সহজভাবে, মহাবিশ্ব এক অপূর্ব ভারসম্যের মধ্যে আছে। চিরন্তন শক্তি তাওয়ের মাধ্যমে চালিত হচ্ছে প্রকৃতির প্রত্যেকটি বিষয়- জন্ম-মৃত্যু, উত্থান-পতন সব। সেই চিরন্তন ভারসম্যতায় নিজেকে চালানোই তাওবাদের কেন্দ্রবিন্দু।
একজন বৃদ্ধ-শিশু
তাওবাদের প্রবক্তা হিসেবে লাওজুর নাম আসে সবার আগে। তিনি ছিলেন সমসমায়িক চু প্রদেশের রাজকীয় লাইব্রেরির তত্ত্বাবধায়ক এবং প্রকৃতিবাদী দার্শনিক। জীবনাচারের কারণে খ্যাতি ছিলে ‘বৃদ্ধ-শিশু’ বলে। বিশ্বাস করতেন, মহাজগতের প্রতিটি বস্তুই ভারসম্যমূলক নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে। মানুষকে একবারের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লালসার ঊর্ধ্বে উঠে আসতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে সামষ্টিক মঙ্গলকে। তবেই সামাজিক সুখ সম্ভব। বস্তুত মানুষ আর রাষ্ট্রের প্রতিনিয়ত দুর্নীতি ডেকে এনেছিল ক্রমবর্ধমান দুর্ভোগ আর দুর্দশা। লাওজু তা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঐতিহাসিক সিমা চিয়ান (১৪৫- ৮৬ খ্রি.পূ.)-এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।
“মানুষের আচরণ পরিবর্তনের চেষ্টায় ব্যর্থতা লাওজুকে হতাশ করে দেয়। নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নেন নির্বাসনে যাবার। পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে চীন ত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সীমান্তরক্ষীদের প্রধান ইন সি তার পথ আটকে দাঁড়ায়। ইন সি চিনতে পেরেছিল দার্শনিককে। দাবি করলো চিরতরে জনপদ ত্যাগ করার আগে সাধু যেন কিছু উপদেশ দেন। তার জন্য সঠিক জীবন যাপনের পাথেয় হিসেবে। অনেক ভেবে রাজি হলেন লাওজু। সীমান্তরক্ষীর পাশে একটা পাথরের উপর বসলেন। লিখে ফেললেন তাওবাদের মহাগ্রন্থ তাও তে চিং। শেষ হলে ইন সির হাতে তুলে দেন গ্রন্থটি। তারপর পশ্চিমের কুয়াশায় চিরতরে হারিয়ে যান লাওজু। ইন সিই পরে তা অনুলিপি ও প্রচারে ভূমিকা রাখে।”
ইতিবৃত্ত এক নজরে
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দী। শতধা বিভক্ত রাষ্ট্রগুলো একটা আরেকটার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। জীবনদর্শন প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রকৃতিবাদের উপর। সেই দৃষ্টিকোণে পৃথিবী সৃষ্টির মূল উপাদান পাঁচটি- আগুন, মাটি, পানি, কাঠ এবং ধাতু। এদের একত্রে বলা হতো উ-শিং বা পাঁচ মহামূল। জগৎ পরিচালনার জন্য ইন-ইয়াং এবং চি তো আছেই। মতবাদগুলো সামগ্রিকভাবে তাও ধর্মের ভিত্তি প্রস্তুতিতে কাজ করেছে। রবিনেট অবশ্য চারটি উপাদানকে শনাক্ত করেছেন।
১) তাও তে চিং এবং চুয়াং জি- এর মতো দার্শনিক লেখা
২) জীবনে প্রকৃত সুখ লাভের তরিকা
৩) অমরত্বের প্রচেষ্টা
৪) নিগূঢ়বাদ ও তন্ত্রচর্চা
(Taoism: Growth of a religion, Page-25)
পূর্ব উপকূল থেকেই চীনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনা। খণ্ড খণ্ড রাজ্য একত্রিত হবার সাথে সাথে ঘটতে থাকে সাংস্কৃতিক বিস্তার। খ্রিষ্টের জন্মের পরবর্তী দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে সাংগঠনিক রূপ লাভ করতে থাকে। প্রথম দিকের অন্যতম এক উপদল থিয়ানশি। সেখানকার গুরু চাং তাওলিং দাবি করেন, তার কাছে লাওজু আবির্ভূত হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে থিয়ানশি উপদলটি ২১৫ সালে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে রাজা চাও চাও-এর অধীনে। লাওজুকে দেয়া হয় স্বর্গীয় পুরুষের মর্যাদা।
হান রাজবংশের সময়ে (২০৬-২২০ সাল) বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত লেখা সংগৃহীত হয়। ভারসম্যপূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রূপ লাভ করে তাওবাদ। অবশ্য আচার পালনের কেন্দ্র ছিল শু (বর্তমান সিচুয়ান) প্রদেশ। প্রথম দিকে সন্ন্যাস জীবনকেই বেছে নিয়েছিল সবাই। রাজনৈতিক বিষয়াদিতে আগ্রহ দেখা যায়নি খুব একটা। গুরু চুয়াংজির জীবনই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। লাওজু এবং চুয়াংজির পরে পরিণত হতে থাকে মতবাদটি। আর আইনগুলোকেও তাওচাং বা বিধিবদ্ধ ধর্মীয় আইন আকারে প্রকাশ করা হয়। অস্তিত্ব নিয়ে চুয়াংজির একটা কথা খুব জনপ্রিয়।
“একবার স্বপ্নে দেখলাম আমি প্রজাপতি। উড়াউড়ি করছি এখান থেকে ওখানে। সমস্ত সচেতনতা জুড়ে কেবল প্রজাপতি হিসাসেবেই উৎফুল্লতা। প্রকৃত প্রজাপতি। জানি না, আমি চুয়াংজি। হঠাৎ জেগে উঠলাম। যথার্থভাবে ‘আমি’-তে। এখন সত্যিই জানি না কোনটা সত্য। আমি কি তখনকার মানুষটাই যে প্রজাপতিকে স্বপ্নে দেখছে? নাকি আমি এখনকার প্রজাপতিটা যে স্বপ্ন দেখছে, সে মানুষ? মানুষ আর প্রজাপতিতে একটা অত্যাবশ্যকীয় ফারাক আছে। একেই বলে রূপান্তর।”
সতেরো শতকের আগে অব্দি বেশ কয়েক দফায় তাওবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। জনৈক ইয়াং শির কাছে স্বর্গীয় খবর আসে ৩৬৪ থেকে ৩৭০ সালের মধ্যে। দানা বাঁধতে থাকে শাংচিং আন্দোলন। তাওবাদের একটি উপদল হিসেবে তাদের অগ্রগতি ছিল ঈর্ষনীয়। শাংচিং-রা রাজনৈতিক সমাদর পায় তাং সাম্রাজ্যের সময়েই (৬১৮-৯০৮ সাল)। সম্রাটদের দাবি ছিল মহামতি লাওজু তাদের পূর্বপুরুষ। চতুর্থ শতকের শেষ এবং পঞ্চম শতকের গোড়ার দিকে কো চাও ফুর মাধ্যমে তাওবাদের অন্য আরেকটি উপদল লিংপাও-এর ভিত্তি স্থাপিত হয়। ৯৬০ থেকে ১২৭৯ সাল অব্দি বিস্তৃত ছং সাম্রাজ্যের আমলে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। বেশ কয়েকজন সম্রাট সক্রিয়ভাবে মতবাদের প্রচার প্রচারণায় কাজ করেছেন।
সময়ের সাথে দুইটি মূল ধারায় বিভাজিত হয়ে পড়ে- চুয়ানচেন তাওবাদ এবং চেংয়ি তাওবাদ। দ্বাদশ শতাব্দীতে চুয়াংচেন উপদল স্থাপিত হয়। পরবর্তী দুই শতকব্যাপী এর বিস্তার ঘটে। উত্তর চীনের ইউয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ বলে স্বীকৃত হয় চুয়ানচেন। দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিস খান অব্দি এই মত ও তার সাধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মুক্ত করেছিলেন করভার থেকে। অবশ্য ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের দিকে বৌদ্ধধর্ম এবং কনফুশীয় মতবাদের জয়যাত্রায় তাওবাদের জোর কমে আসে। বিশ শতক অব্দি পোহাতে হয় হরেক কিসিমের ঝড় ঝাপটা। বর্তমানে চীনের পাঁচটি স্বীকৃত ধর্মের একটি তাওবাদ।
বিশ্বাস নির্দেশিকা
তাওবাদের পেছনে ইন-ইয়াং ধারণার প্রভাব বেশ শক্তিশালী। প্রভাব বলা হচ্ছে কারণ, ইন-ইয়াং-এর ইতিহাস আরো অনেক বেশি পুরাতন। চীনা পুরাণে এর জন্ম মহাবিশ্বের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। ইন এবং ইয়াং দুই আদিম বিপরীত শক্তি। দুইয়ের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতেই বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও প্রবাহ। অবশ্য তাদের সাথে অন্য একটি নিয়ামক জীবনীশক্তি ‘চি’ আছে। জগৎ চিরন্তন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধাবিত। আজ যা আছে; কাল তা ‘নাই’ তে পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতির সব কিছুতে তাই ‘চি’-এর মধ্য দিয়ে ইন আর ইয়াং এর চিরন্তন খেলা। খ্রিষ্টিয় ট্রিনিটির বাইরে যেন অন্য এক ট্রিনিটি। ইন-ইয়াং প্রতীকের মধ্য দিয়েই জীবনের ভারসম্যতা প্রকাশ পায়। নারী-পুরুষ, আলো-অন্ধকার, সক্রিয়তা-নিষ্ক্রিয়তা সবকিছুতেই চি, ইন এবং ইয়াং।
একইভাবে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনজন উপাস্যের ধারণা দেখা যায় তাওবাদের মধ্যে। ইউচিং বা সর্বশ্রদ্ধেয় আদিস্রষ্টা, শাংচিং বা সর্বশ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় বাহক এবং থাইচিং বা সর্বশ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞপুরুষ। প্রথম জন সকল সৃষ্টির কেন্দ্র। সৃষ্টিজগতের সূচনা ঘটে তার হাতে। সেই সাথে পবিত্র গ্রন্থসমূহের আদিলেখক। শাংচিং-এর অবস্থান দূতের মতো। তিনি স্বর্গীয় বার্তা নিয়ে উপদেবতা কিংবা মানুষের কাছে আগমন করেন। প্রায়শ হাতে মাশরুম আকৃতির রাজদণ্ড দেখা যায়। তৃতীয় জন থাইচিং মানুষের মাঝে আসা সক্রিয় এবং পূর্ণ অবতার। হাতে থাকে পাখা। অবতারের আবার অনেক ধরণ হতে পারে; তাদের মধ্যে একজন গুরু লাওজু। তিনজন উপাস্য তিনটি শক্তিকে প্রতীকায়িত করে। যথাক্রমে সৃজনীশক্তি, জীবনীশক্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তি।
তাওবাদ অনুসারে, মানুষ প্রকৃতপক্ষেই ভেতর থেকে ভালো। শুধু সেই ভালোত্বকে জাগিয়ে তুলতে হয় মন্দত্বকে ছাপিয়ে। সঠিক নির্দেশনা এবং শিক্ষা প্রদান করা হলে যে কাউকে মহৎ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সম্ভব মহাবিশ্বের চিরায়ত সঙ্গীতের সাথে তাল মেলাতে সক্ষম করে তোলা। পুরো বিষয়টা পশ্চিমা দার্শনিক এপিকটেটাস এবং মার্কাস অরেলাসের লগোস তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। লগোস মন্দ হতে পারে না। পরিস্থিতি অনুধাবনে মানুষের অক্ষমতাই তাকে মন্দ বলে প্রতিপন্ন করে। শুদ্ধ জীবন যাপনের মানে মেনে নিতে পারার মানসিকতা। যেকোনো পরিস্থিতি এবং পরিবর্তনকে সহজভাবে গ্রহণ করা। গুরু চুয়াংজি মতে-
“জুতা জুতসই হলে পায়ের উপস্থিতিই টের পাওয়া যায় না। বেল্ট জুতসই হলে বুঝাই যায় না- কোমর আছে কি না। হৃদয় তার জুতসই অবস্থায় থাকলে ‘কার জন্য’ কিংবা ‘কার বিরুদ্ধে’- এসব মনে থাকে না। তাড়া নেই তো জবরদস্তি নেই। প্রয়োজন নেই তো আসক্তিও নেই। তাহলেই তুমি সজ্ঞানে আছো। তখনই তুমি সত্যিকারে মুক্ত।”
দুঃখের অন্যতম উৎস জগতের পরিবর্তনশীলতাকে গ্রহণ করতে না পারা। তাওবাদের পথ আত্মসমর্পনের পথ। মহাজাগতিক ইচ্ছার কাছে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে সমর্পন করার রাস্তা। বিশ্বজগতের বিরাজমান ভারসম্যের মাঝে নিজের ইচ্ছাকে আরোপ করতে গেলে নষ্ট করার চেষ্টাই হয় শুধু। সমস্ত কিছু ঘটে তাও কে অনুসরণ করে। তাও যেহেতু স্বাভাবিক; সবকিছুই স্বাভাবিক।
“সফলতা বিপজ্জনক ব্যর্থতার মতোই,
আর প্রত্যাশা ভীতির মতোই ফাঁপা।
সফলতা আর ব্যর্থতাকে সমান বিপজ্জনক বলার কারণ কি জানো?
মইয়ের উপরের ধাপেই যাও কিংবা নিচের ধাপে-
তোমার অবস্থান নড়বড়ে।
দুই পা মাটিতে রাখলেই কেবল রাখতে পারবে ভারসম্য;
মহাবিশ্বকে নিজের মতো করে দেখো
বিশ্বাস রাখো যা যেভাবে আছে;
ভালোবাসো পৃথিবীকে, যেমনটা নিজেকে বাসো
তবেই পারবে সব কিছুর যত্ন নিতে।”
সত্যিকার সাধু কোন কিছু না করেই সবকিছু করেন। একে বলা হয় উ-ওয়েই বা কিছু না করে করা। এভাবে চেষ্টা চলে সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় ফেরার। সেখানে চাপিয়ে দেয়া কোন প্রকার কৃত্রিমতা নেই; আছে শুধু সম্ভাবনা। তাওবাদে তা পরিচিত চি-রেন বা চু-চান নামে। মানুষ মহাবিশ্বেরই ছোট্ট প্রতিরূপ; অথবা মহাবিশ্ব নিজেই এক বৃহৎ শরীর। জগতকে বুঝার এই পদ্ধতির কারণেই তাও দর্শন চীনে প্রভাবশালী বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।
আচার ও উৎসব
ধর্মীয় আচারগুলো প্রকৃতিকে অনুধাবনের উপর প্রোথিত। দৃশ্যমান জগৎ এবং বিভিন্ন প্রতীকের ভাষাকে পাঠ করার প্রচেষ্টার উপর। তথাপি বৌদ্ধ এবং কনফুশীয় আচার-রীতির প্রভাব রয়েছে বেশ বড় অংশ জুড়ে। প্রতিটি উৎসব এবং মন্ত্র সংক্ষেপে সতর্কতার সাথে পালন করতে হয়। উৎসব পালিত হয় গ্র্যান্ড মাস্টারের তত্ত্বাবধানে। যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে কয়েকদিন কিংবা সপ্তাহব্যাপী। আচারগুলো পূর্বপুরুষের গ্রাম, শহর, সংঘকে সম্মান জানাতে তৎপর। গ্র্যান্ড মাস্টার আগুনে সুগন্ধি পোড়ানোর সময় আহবান করেন প্রাচীন সফল আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে। প্রতিটি পদক্ষেপের পূর্ব শর্ত পবিত্রতা। প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌড়ে স্থানগুলো দেবতা আর আত্মার সমাবেশে পূন্যভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
পবিত্র ট্রিনিটির অবতার রূপে আগমন করেছিলেন লাওজু। উপাসনা করা হয় তারও। বিভিন্ন শাখা আবার বিভিন্ন ছোট দেবতাকে গ্রহণ করেছে উপাস্য হিসেবে। দেবতারা সব বিশ্বজগতের বিভিন্ন নিয়ামকের সাথে জড়িত বলে গণ্য। আগে প্রাণী কিংবা ফল উৎসর্গ করার রীতি প্রচলিত ছিল। গুরু চাং তাওলিং উৎসর্গের রীতিকে কেবল প্রত্যাখ্যান করেই থেমে থাকেননি। উৎসর্গপন্থী গুরু এবং মন্দিরগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। বর্তমানে মন্দিরগুলো কোনো ধরনের পশুবলি বা প্রাণীহত্যা থেকে মুক্ত। তবে চিং জি বা জস পেপার পুড়ানোটা এক ধরণের উৎসর্গের রূপ নিয়েছে।
বিশেষ বন্ধের দিনগুলোতে র্যালি বের হয় রাস্তায়। বাজি, ফুল এবং ঐতিহ্যবাহী সংগীতের মধ্য দিয়ে কাটে গোটা দিন। সিংহ নাচ, ড্রাগন নাচ, কুংফু প্রভৃতির ভেতর দিয়ে মিলে আদিম আর বর্তমান আত্মা। ই-চিং কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী নিয়েও কাটে সময়।
পবিত্র গ্রন্থাবলি
তাও তে চিং তাওবাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। আপাতভাবে ধর্মগ্রন্থ না; বরং একগুচ্ছ দার্শনিক কবিতার মাধ্যমে জীবন যাপনের নির্দেশিকা। তাও তে চিং শব্দের অর্থ গুণ এবং পথের পুস্তক। ব্যক্তি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তিতে থাকার সহজ ইঙ্গিত। লেখক হিসেবে লাওজুর নাম প্রতিষ্ঠিত। আপাত বিরোধীভাবে উদ্ধৃত হলেও গেঁথে রাখা ভিন্ন এক বোধ। বইটির শুরুর লাইনদ্বয় দারুণ জনপ্রিয়।
“তাও ক তাও ফেই ছাং তাও, মিং ক মিং ফেই ছাং মিং”
অর্থাৎ যে তাওকে মুখে প্রকাশ করা যায়; তা চিরন্তন তাও না। আর যে নামকে নামে আবদ্ধ করা যায়; তা চিরন্তন নাম না।
গ্রন্থের মূল উপজীব্য প্রকৃতির প্রবাহমানতায় নিজেকে ছেড়ে দিতে শেখা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থটিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে লেখা নিয়ে তাওবাদের অপর একটি গ্রন্থ চুয়াং জি; প্রণেতার নামও চুয়াং জি। প্রথম সাত অধ্যায় তিনি নিজেই লিখেছেন। পরবর্তী অধ্যায়গুলো ছাত্র ও সমমনাদের অবদান। এখানেও মূল আলোচনা ব্যক্তিকে প্রাকৃতিক নিয়ম ও আইনের সাথে ভারসম্যপূর্ণ হিসাবে প্রস্তুতকরণ।
খ্রিষ্টপূর্ব ১১৫০ অব্দের দিকে রচিত ই-চিং। যদিও তাওবাদ জন্মের বহু আগে; তথাপি গ্রন্থটিকে গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ মর্যাদায়। ইন-ইয়াং তত্ত্ব এবং সৃষ্টি সম্পর্কিত বিশ্বাসের একটা বড় অংশ এসেছে এখান থেকে। তাওচাং নামে আরো একটা বই গড়ে উঠেছে চিন, তাং এবং সাং রাজবংশের সময়কালে। বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটককে অনুসরণ করে তিনভাগে বিভাজিত তা। প্রথমত চেন বা সত্য, দ্বিতীয়ত শুয়ান বা রহস্য এবং তৃতীয়ত শেন বা স্বর্গীয়। এছাড়া অন্যান্য কিছু উপদেশ এবং নীতিকথা সম্বলিত লেখাও পাওয়া যায় তাওবাদ চর্চার ক্ষেত্রে।
শেষের আগে
তাওবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইন-ইয়াং। জড়াজড়ি করে থাকা দুই বিপরীত শক্তি। চীন এবং তাইওয়ানে মন্দিরগুলোর ছাদে চীনামাটি নির্মিত বিভিন্ন রঙের ড্রাগন এবং ফিনিক্স রাখা হয়। তারাও ইন এবং ইয়াংকেই প্রতীকায়িত করে। ২০১০ সালের শুমারি অনুযায়ী চীনের মোট জনসংখ্যার ১৩% নিজেদের তাওবাদী বলে দাবি করেছিল। এশিয়ার বাইরে সুদূর ব্রাজিলেও তাওবাদের শিকড় ছড়িয়েছে। তার প্রমাণ সাও পাওলো এবং রিও ডি জেনিরোতে গড়ে উঠা তাও মন্দির। তাও সাহিত্য এবং চিত্রকলা যে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে তা আধুনিক কাল অব্দি পরিব্যপ্ত।
কনফুশীয় মতবাদের আচার সর্বস্বতা এবং কড়াকড়িকে শুরু থেকেই বিরোধিতা করে তাওবাদ। তার স্থানে স্থাপন করে স্বাভাবিকতা ও স্বতস্ফুর্ততা। শুধু চীন না; প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কোরিয়া, জাপান কিংবা ভিয়েতনামের সংস্কৃতিতেও তাওবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। চীনে বৌদ্ধধর্মের বিকাশের পথ তৈরি করেছে তাওবাদ। গ্রহণ যে করেনি; তা কিন্তু না। সন্ন্যাস, নিরামিষভোজ কিংবা মদবর্জনের মতো নিয়মগুলো বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই তাওবাদে ঢুকেছে।