জোয়ান বায়েজ একজন আমেরিকান লোকশিল্পী, গীতিকার ও সামাজিক কর্মী। ‘দ্য নাইট দে ড্রোভ ওল্ড ডিক্সি ডাউন’, ‘দেয়ার বাট ফর ফরচুন’ এবং ‘ডায়মন্ডস এন্ড রাস্ট’ এর মতো বিখ্যাত গানের জননী তিনি। তিনি পৃথিবীর অন্যতম সেরা রাজনৈতিক-শিল্পী, যিনি আজীবন কথা বলেছেন যুদ্ধের বিপক্ষে, শান্তির পক্ষে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
শিল্পী, গীতিকার এবং সামাজিক কর্মী জোয়ান বায়েজ নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে ৯ জানুয়ারি, ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম জোয়ান ছ্যান্ডোস বায়েজ। জন্মের পরই পরিবার নিয়ে তার বাবা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানান্তরিত হন। মেক্সিকান-স্কটিশ বংশদ্ভুত বায়েজ বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের কাছে একদমই অপরিচিত ছিলেন না। কিন্তু তার সঙ্গীত প্রতিভাকে এর কোনোকিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি মূলত লোকসঙ্গীত চর্চা করতেন, ১৯৬০ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি গিটার তুলে নেন হাতে। ভালবেসে ফেলেন এই যন্ত্রটিকে।
দুই বছর পর তার পরিবার ক্যামব্রিজে চলে আসে, ম্যাসাচুসেটসে তার অধ্যাপক বাবা এমআইটি অনুষদের সাথে যোগ দেন। বায়েজ তখন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তার একদমই পছন্দের ছিল না। তিনিই মূলত সেই শহরের লোকসঙ্গীতের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন হ্যারি বেলাফন্ট, ওডেট্টা ও পিট সিগারের মতো শিল্পীরা। খুব শীঘ্রই বায়েজ স্থানীয় ক্লাবের নিয়মিত পারফর্মার হয়ে ওঠেন এবং অবশেষে শিল্পী বব গিবসনের আমন্ত্রণে নিউপোর্ট লোক উত্সবে গান গেয়ে বেশ পরিচিতি লাভ করেন।
সঙ্গীত যাত্রা ও বব ডিলান
১৯৬০ সালে বায়েজ আত্ম-শিরোনামে ভ্যানগার্ড রেকর্ডস থেকে প্রথম অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, ‘হাউস অফ দ্য রাইজিং সান’ এবং ‘মেরি হ্যামিল্টন’ এর মতো গানগুলো ছিল এই অ্যালবামে। প্রেস বিলিং পাওয়ার পর তাঁর অসাধারণ কন্ঠের জন্য তাঁকে ভার্জিন মেরি/ম্যাডোনার প্রতিচ্ছায়া হিসেবে দেখা হতো।
এই দশকের প্রথমার্ধে তিনি ‘ফেয়ারওয়েল’, ‘অ্যাঞ্জেলিনা’ (১৯৬৫) এবং নোয়েল (১৯৬৬) এর মতো আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন। তাঁর আত্মপ্রকাশের কিছুদিন পর তিনি গায়ক/গীতিকার বব ডিলানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। লোকসঙ্গীতে ডিলানের বিস্তার লাভের পেছনে বায়েজের ভূমিকা ছিল অসামান্য। তিনি মঞ্চে ডিলানের গানগুলো গেয়েছেন অসংখ্যবার, এবং তাঁকে একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রদান করেন, যা বায়েজের অ্যাক্টিভিজমের সাথে মিলিত হয়ে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একসময় লোকসঙ্গীতের এই দুই মহারথী প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৫ সালে এ সম্পর্কের অবসান ঘটে, সে বছর এক ট্যুরে ডিলান বায়েজকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অস্বীকৃতি জানাযন। (পরে তিনি অবশ্য এই আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।)
সঙ্গীত, মানবতা ও জোয়ান বায়েজ
১৯৬০ এর দশক আমেরিকার ইতিহাসে একটি ঘটনাবহুল সময়। এ সময় বায়েজ তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের জন্য সঙ্গীতকে ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর সঙ্গীত দিয়ে সবধরনের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মানুষ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিংয়ের একটি বক্তৃতায় তিনি ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি গান। এই গানটি ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ৪০টি গানের একটি নির্বাচিত হয়। একই বছর তাঁর একক ‘দেয়ার বাট ফর ফরচুন’ জায়গা করে নেয় শীর্ষ দশে, এবং ‘ইটস অল ওভার নাও বেবি ব্লু’ গানটিও সেই বছর ব্যাপক সফলতা অর্জন করে।
একজন শিল্পী এবং মানবাধিকার কর্মী হলেও বায়েজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আয়োজিত যুদ্ধবিরোধী সেমিনারে বিনামূল্যে বক্তৃতা প্রদান করতেন এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে কথা বলেছেন সেখানকার মানুষের জন্যও। ১৯৬৪ সালে তিনি তাঁর নিজের কর পরিশোধে অস্বীকার করেন, কেননা তাঁর এই করের অর্থ যুদ্ধখাতে ব্যয় হোক তা তিনি চাইতেন না। সামরিক ব্যয় প্রতিহত করতে প্রায় এক যুগ তিনি কর প্রদান করেননি। ১৯৬৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে প্রদেশ থেকে বায়েজকে একটি সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে দেয়ার জন্য দুবার গ্রেফতার করা হয়।
সত্তরের দশক থেকেই বায়েজ সঙ্গীত এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হতে থাকেন। পশ্চিম উপকূলে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি শাখা স্থাপনে তিনি অভাবনীয় সাহায্য করেন এবং চালিয়ে যেতে থাকেন সঙ্গীতসাধনা। ইতোমধ্যে তাঁর বেশ কয়েকটি অ্যালবাম মুক্তি পায়, একইসাথে কাজ করতে থাকলেন এ অ্যান্ড এম-এর সঙ্গে চুক্তি করে। ‘দ্য নাইট দে ড্রোভ ওল্ড ডিক্সি ডাউন’ এর রিমেক তাঁকে চূড়ান্ত খ্যাতি এনে দেয়, যেটি ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে নেয়।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর বিখ্যাত অ্যালবাম ‘ডায়মন্ডস এন্ড রাশ’। অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকটি শীর্ষ চল্লিশে জায়গা করে নেয়। এটি মূলত বব ডিলানের সাথে তাঁর সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে। এতে রয়েছে ‘উইন্ডস অফ ওল্ড ডেজ’, জনি মিচেলের সাথে ডুয়েট ‘ডিডা’ এবং ‘নেভার ড্রিমড ইউ’ড লিভ ইন সামার’ এর মতো বিখ্যাত গানগুলো। এরপরের ৪ বছরে তাঁর তিনটি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়- ‘গলফ উইন্ডস (১৯৭৬)’, ‘ব্লোয়িং অ্যাওয়ে (১৯৭৭)’, এবং ‘অনেস্ট লুলাবাই (১৯৭৯)’।
আশি এবং নব্বইয়ের দশকে তিনি নিজস্ব ধরনের সঙ্গীত চর্চাই করেছেন। ১৯৮৯ এ ‘স্পিকিং অফ ড্রিমস’ এবং ১৯৯৫ এ ‘রিং দেম বেলস’ নামে দুটি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। নিউ মিলেনিয়ামে তাঁর প্রথম অ্যালবাম হলো ‘ডার্ক কর্ডস অন আ বিগ গিটার (২০০৩)। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাওয়ারি সংস’ অ্যালবামটি। এতে ঐতিহ্যবাহী ফোক ছাড়াও রয়েছে উডি গাথরি এবং বব ডিলানের গান। ২০০৭ সালে তিনি গ্র্যামি লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। লাইভ ও স্টুডিও মিলিয়ে জোয়ান বায়েজের ৪০টিরও বেশি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবন
বায়েজ ১৯৬৮ সালে ডেভিড হ্যারিসকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির এক পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম গ্যাব্রিয়েল। হ্যারিস ভিয়েতনাম যুদ্ধের খসড়া বিরোধী বিক্ষোভে সামনের সারিতেই ছিলেন, যার দরুন তিনি কিছু সময়ের জন্য জেলে ছিলেন। ১৯৭২ সালে হ্যারিসের মুক্তির পর এ দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালে ‘ডেব্রেক’ এবং ১৯৮৭ সালে ‘এ ভয়েজ টু সিং উইথ’ নামে দুটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে পিবিএস জোয়ান বায়েজের জীবনীর উপর নির্মিত ‘হাউ সুইট দ্য সাউন্ড’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। মানুষের দুঃখে যে কন্ঠটি গেয়ে উঠেছে বরাবর, সেটিই জোয়ান বায়েজ, যিনি আজীবন কথা বলেছেন শান্তির পক্ষে, দাঁড়িয়েছেন যুদ্ধের সম্মুখে অস্ত্রের বিপরীতে গিটার হাতে।