শুধু এশিয়াতে নয়, সমগ্র বিশ্বে চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের খ্যাতি রীতিমত প্রশ্নের উর্ধ্বে। চীনের নাম উচ্চারিত হলেই দেশটির একাধিক বিষয় মানুষের মনে আসতে পারে। চীনের মহাপ্রাচীর, খাবার, চিত্রকলা, মার্শাল আর্ট, সাম্প্রতিক অর্থনীতির তুলনাহীন সমৃদ্ধি- তালিকা তৈরি করতে গেলে হয়তো বিশাল এক বইয়ের আকার হয়ে যাবে।
চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুধু যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে তা-ই নয়, এর বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন সময় অন্য সংস্কৃতির মানুষ মহান মেনে নিয়ে একাত্ম হতে চেয়েছে। সঙ্গীত, চিত্রকলা ও মার্শাল আর্টের মতো চীনের চীনের থিয়েটারও বেশ সমৃদ্ধ। চীনের এমনই এক মঞ্চশিল্প হচ্ছে ‘কুনকু’ থিয়েটার।
‘কুনকু’ চীনের প্রাচীন থিয়েটার স্টাইলের মধ্যে অন্যতম। স্থানভেদে এর নামের উচ্চারণও ভিন্ন হয়ে থাকে। অনেক জায়গায় এটি ‘কুইনচু’ নামেও উচ্চারিত হয়। এটি বেশ প্রাচীন শিল্প হলেও সময়ের সাথে সাথে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। ব্যতিক্রমী ও বর্ণীল কস্টিউম, মঞ্চনাটক, দলীয় সঙ্গীত, নাচ, জমকালো বাদ্য, কবিতার মাধ্যমে গল্প উপস্থাপন, সংঘাতের দৃশ্যে মার্শাল আর্টের সরব উপস্থিতি- সব মিলিয়ে এই থিয়েটার যেকোনো সংস্কৃতিপ্রেমীর মন জয় করার জন্য যথেষ্টের চেয়েও বেশি।
‘কুনকু’র ইতিহাস বেশ প্রাচীন। চীনের ইতিহাসের লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী, ১৫৩০ সালে ওয়েই লিয়ানফু নামক জনৈক বিদ্যান প্রশাসকের হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হয়। তবে ১৫৬০ সালের আগে এটি থিয়েটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। সে বছর বিখ্যাত চীনা নাট্যকার লিয়ান চেনয়ু তার একটি নাটকের জন্য থিয়েটার হিসেবে এর প্রথম ব্যবহার করেন। তারপর থেকে ‘কুনকু’ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। একসময় এটি অফিসিয়াল মেলোডি বা ‘কাওয়ান চিয়াং’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এসময় থেকে এ থিয়েটারে নাটক নির্মাণের জন্য কবি, সুরকার, চিত্রকর ও নির্দেশকের যৌথ ভূমিকার সাহায্য নেওয়া হতো। এরপর প্রায় ২০০ বছর ‘কুনকু’ থিয়েটার তার সমৃদ্ধি দেখেছে।
আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে ‘কুনকু’ থিয়েটার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় থেকে এ থিয়েটার ‘বেইজিং অপেরা’ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। চীনের সম্রাট চিয়ানলুং এর পৃষ্ঠপোষোকতায় ‘বেইজিং অপেরা’ ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। ফলে ট্র্যাডিশনাল ‘কুনকু’ থিয়েটারের সীমা সংকুচিত হয়ে যেতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো, ১৯০০ সাল নাগাদ এই ঐতিহ্য হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ট্রেডিশনাল ‘কুনকু’ থিয়েটারের বিশালতা কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়। একটি ছোট নাটক, সীমিত পরিসরের গানের দল ও বাদ্যের আয়োজনে তৈরি হওয়া নতুন ‘কুনকু’ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের কিছু উৎসাহী থিয়েটারপ্রেমীর কারণে এ থিয়েটার বিলুপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
বিশ শতকের ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই থিয়েটার বেশ বড় হুমকির মুখে পড়ে। চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট সরকার একে সমাজতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে এই বর্ণীল ঐতিহ্য শাসকদের রোষানলে পড়ে। পার্টি ক্যাডারদের হাতে কলাকুশলীদের অনেকে নিহত হন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে হংকং ও তাইওয়ানে পালিয়ে যান। সত্তরের দশকের শেষের দিকে চীন সরকার কিছুটা উদার হলে ‘কুনকু’ থিয়েটার আবার প্রাণ ফিরে পায়।
বর্তমানে চীনে ৬টি বড় ‘কুনকু’ থিয়েটার গ্রুপ আছে। এসব গ্রুপে সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-৭০০ অভিনেতা, গায়ক, বাদক ও অন্যান্য কলাকুশলী আছে। এদের প্রত্যেকের নিজ নিজ পারফর্মারদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য আলাদা আলাদা কেন্দ্র রয়েছে। এসব থিয়েটার গ্রুপের চারটি আছে জিয়াংশু ও ঝেজিয়ান প্রদেশে। অন্য দুটি গ্রুপের কার্যালয় হুনান ও বেইজিং অঞ্চলে আছে। দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় এ থিয়েটারের কার্যালয় আছে। তার মধ্যে নিউ ইয়র্কের ‘কুনকু’ থিয়েটার বেশ প্রসিদ্ধ। এটি সাংহাই অঞ্চল থেকে আগত থিয়েটার গ্রুপের কলাকুশলীরা উত্তর আমেরিকায় প্রথম শুরু করেছিলেন।
‘কুনকু’ থিয়েটারের প্রাণ বা অন্তর্বস্তু তিনটি। এগুলো হচ্ছে বক্তব্য, সঙ্গীত ও নাচ। এ থিয়েটারের বিশেষ ধাঁচের শৈল্পিক উপস্থাপনের জন্য প্রতি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নাচ ও গানে বেশ ভালো দক্ষতা আয়ত্ত্ব করতে হয়। এর সঙ্গীত ও বক্তব্য মোটা দাগে দু’ভাগে বিভক্ত। উচ্চ সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন যেসব কবিতা অর্কেস্ট্রার সাথে সুর দিয়ে গাওয়া হয়, তাকে ‘আরিয়াস’ বলা হয়। অন্য ভাগে সুর দেওয়া গান ও বক্তব্য বাদে কিছু কথা জপ করার মতো সমবেতভাবে বলা হয়। অনেক সময় মঞ্চে একজন অভিনেতা গান করেন এবং আরেকজন অভিনেতা জপ করার মতো বলতে থাকেন। দুইয়ে মিলে এক অসাধারণ শিল্পের সুললিত ব্যঞ্জনা মঞ্চে ফুটে ওঠে।
এ থিয়েটার মঞ্চে পরিবেশিত করার নিয়মকে ‘চু পাই’ বা ‘কু পাই’ বলা হয়। কবিতার লাইনগুলো মঞ্চের সঙ্গীতের সাথে সুন্দরভাবে মেলানোর জন্য যথাযথ নিয়ম মানা হয়। কবিতার প্রতিটি লাইনের একেকটি শব্দ উচ্চারণের প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গানে সুর দেওয়া হয়। এখানে কিছু মজার বিষয় আছে। চীনা ভাষার উচ্চারণ প্রক্রিয়া অন্যান্য ভাষার মতো নয়। সুরের ওঠানামার সাথে এই ভাষার শব্দের উচ্চারণে পরিবর্তন আসে। নিয়ম অনুসারে গানের প্রতিটি শব্দই এক একটি ‘মেলোডি’। গান পরিবেশনের সময় প্রত্যেকটি ‘মেলোডি’ নিজের গুণে ফুটে ওঠে।
‘কুনকু’ থিয়েটারে আধুনিক মান্দারিন চীনা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। এমনকি আঞ্চলিক কুনশাং বা সুঝৌ ভাষাও ব্যবহৃত হয় না। এ থিয়েটারের ভাষা মঞ্চের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা কৃত্রিম ভাষা (মধ্যযুগের বাঙলা ব্রজবুলি কবিতার মতো)। এ থিয়েটারের স্ক্রিপ্ট সাধারণত কবিরা লিখতেন। এটি লেখার সময় লাইন, শব্দ ও অন্ত্যমিল মিলিয়ে বেশ জটিল শৃঙ্খলা মেনে চলা হয়। এই শৃঙ্খলা ইংরেজি বা বাংলা সনেট লেখার চেয়েও বেশ কঠিন। গান ও কবিতার উপস্থাপন ছাড়াও নাচ এই থিয়েটারের এক অপরিহার্য অঙ্গ। নাচের বিশেষ ধরনের কস্টিউম বেশ উজ্জ্বল ও রঙিন হয়ে থাকে। চরিত্র উপস্থাপনের সময় গান ও সুরের সাথে মিল রেখে নাচে বিশেষ ধরনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহৃত হয়। অভিনেতা বা অভিনেত্রী এসব আলাদা আলাদা বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে সুখ, দুঃখ, রাগ, প্রেম ও বিনয়ের বিভিন্ন মনোভাব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
‘কুনকু’ থিয়েটারের মঞ্চে বিশেষ জাঁকজমক থাকে না। নাচের মুদ্রায় সাবলীল দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য মঞ্চে বাড়তি দৃশ্যের অবতারণা কিছু কম পরিমাণে করা হয়। মঞ্চে আলাদা কোনো পর্দার ব্যবস্থা থাকে না। অভিনেতা বা অভিনেত্রীর পাশে দৃশ্যে সামান্য চেয়ার বা টেবিলের ব্যবস্থা থাকতে পারে। নায়ক-নায়িকার পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত কস্টিউম সাধারণত চীনের ‘মিং’ রাজবংশের সময়কালীন প্রচলিত পোশাকের অনুকরণে তৈরি করা হয়।
এই থিয়েটারের চরিত্রগুলো বেশ সুনির্দিষ্ট। প্রধান চরিত্র সাধারণত তিনটি- ‘দাং’ বা ‘যুবতী’, ‘শেং’ বা ‘যুবক’, ও ‘কুয়াও’ বা ভাঁড়। এছাড়া আরো কিছু পার্শ্ব চরিত্র থাকে। এগুলোর মধ্যে ‘লং শেং’ বা ‘বৃদ্ধ’, ‘লাও দাং’ বা ‘বৃদ্ধা’ ও ‘ঝৌ দাং’ বা ‘তরুণ-তরুণী’ উল্লেখযোগ্য। ‘কুনকু’ থিয়েটারে বাদ্য বাজানোর জন্য অর্কেস্ট্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৬-১০ জন নিয়ে এই অর্কেস্ট্রা তৈরি হয়। বাদ্যের ধরন অনুযায়ী অর্কেস্ট্রা দু’ভাগে বিভক্ত থাকে। তার ও বাতাস চালিত বাদ্যযন্ত্র বাজানো দল ‘ওয়েন চ্যাং’ নামে পরিচিত। হাতের আঙুল বা ছোট কাঠি দিয়ে বাজানো বাদ্য পরিচালনার দল ‘য়ু চ্যাং’ নামে খ্যাত। ‘ওয়েন চ্যাং’ প্রাথমিকভাবে মঞ্চের গানের সাথে বাঁশির সুর দিয়ে থাকে। গানের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে কখনও কখনও ‘জিথার’ (দেখতে অনেকটা গিটারের মতো) বাজানো হয়ে থাকে।
২০০১ সালে ইউনেস্কো চীনের এই অনবদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘মাস্টারপিস অব দ্য ওরাল অ্যান্ড ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করে। ‘কুনকু’ থিয়েটার চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো এর মানবিক সমৃদ্ধির এক অনন্য উদাহরণ।