“অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যান্সারে, জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়!”
মান্না দে’র কফি হাউজের সেই অমলের মতো লাকী আখন্দকেও ক্ষমা করেনি দুরন্ত ক্যান্সার। দীর্ঘদিন ধরে যদিওবা জীবনের সাথে লুকোচুরি খেলছিলেন, তারপরও শেষমেশ আর পারলেন না বাংলাদেশের আধুনিক গানের জগতে বিরাজমান এক শিল্পী লাকী আখন্দ।
একইসাথে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন তিনি- শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। অর্থাৎ সংগীতজগতের সাথে সবদিক দিয়েই তিনি জড়িয়ে ছিলেন। ‘হ্যাপী টাচ’ ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন লাকী আখন্দ।
প্রথমজীবনে তিনি
লাকী আখন্দ ১৯৫৬ সালের ১৮ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাতলা খান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সেই তিনি তার বাবা এ কে আবদুল হকের কাছ থেকে সংগীত বিষয়ে হাতেখড়ি নেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সংগীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন লাকী। তার সাথে ভাই হ্যাপি আখন্দও তখন সঙ্গীতচর্চা করতেন, প্রায় একসাথেই পথচলা ছিল তাদের। নিজে যা-ই শিখতেন, হ্যাপিকে শিখিয়ে দিতে চাইতেন তিনি। আর তাই ভাইয়ের সাথে আবেগীয় জায়গা থেকে অনেক বেশি কাছে ছিলেন লাকী।
নাম নিয়ে যত বিড়ম্বনা!
নাম রাখা হয়েছিল এ. টি. আমিনুল হক। মা বদলে এ. টি. এম. আমিনুল হাসান করলেন। ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটেও এ নামই আছে। তবে বাধ সাধলো ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়! যুদ্ধের সময় ভারতে তার ছদ্মনাম ছিল লাকী আনাম, কারণ মা-বাবা দেশে থাকেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার গান বাজে। আর্মিরা কোনোভাবে আসল পরিচয় জানলে তাদের মেরে ফেলতে পারে। তাই ফিরে আসার পর পূর্বপুরুষের পদবি নিয়ে নিজের নাম রাখলেন লাকী আখন্দ। আর এ নামেই তিনি হয়ে উঠলেন দেশবিখ্যাত এক শিল্পী, হারিয়ে গেল পিতৃ-মাতৃপ্রদত্ত নামখানা!
অঞ্জন দত্তের চোখে লাকী আখন্দ
ওপার বাংলার জীবনমুখী গানের কান্ডারী অঞ্জন দত্তের সাথে লাকীর একটা মজার ঘটনা আছে। সেই প্রথমবার তাদের দেখা, ১৯৯৮ সালে ঢাকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটরিয়ামে অঞ্জন দত্তের গানের শো’তে। নিমা রহমান ছিলেন তাদের পরিচয়ে মধ্যস্থতাকারী, নিমা রহমানই অঞ্জনকে বলেন এখানে একসময়ের খুব জনপ্রিয় এক গায়ক আছেন। কিন্তু অঞ্জন দত্ত তার গান কখনো শোনেননি। সেই ‘একসময়ের জনপ্রিয় গায়ক’ই ছিলেন লাকী আখন্দ। একেবারে Vice-Verca’র মতো কাহিনী হলো! লাকীও কখনো অঞ্জনের গান শোনেননি।
তো এবার পালা এলো অঞ্জন আর লাকীর একসাথে গান গাইবার। কী গান গাইবেন তারা? কেউই যে কারো গান শোনেন নি! তারপরও মঞ্চ মাতলো, শ্রোতারা মুগ্ধ হলো তাদের দ্বৈততায়। ফিরে গিয়ে অঞ্জন দত্ত তার ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ (১৯৯৯) অ্যালবামে ‘লাকী আখন্দ’ নামে একটি গান রাখেন যার কয়েকটি লাইন ছিলো এমন,
“দু’জনে থাকে দু’টো দেশে
দুজনেই গান বেঁচে খায়
গানে গানে কোনো এক মঞ্চে
হঠাৎ দেখা হয়ে যায়…
মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান,
সেদিনের সেই জলসায়…
একাকার হয়ে যায় ঠিকানা কলকাতা কিংবা ঢাকায়…”
হঠাৎ দেখা, একটু কথা আর অনেকখানি গান মিলে তাদের প্রথম সাক্ষাৎটা অঞ্জন দত্ত কলকাতা ফিরেও গেঁথে নিয়েছেন তার গানে গানে।
গান নিয়ে যা ভাবতেন লাকী
সাহিত্যে যেমন বেদনা আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তেমনি তার জন্য ছিল সঙ্গীত। একসময় সংসারে অভাব ছিল, অপ্রাপ্তির দুঃখ ছিল। আর তার মতে এই দুঃখই গানের মাধ্যমে তার কন্ঠে, তার সুরে প্রতিফলিত হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “যদি অভাব না থাকত, আমাদের ভেতরে যদি কষ্ট না থাকত, তাহলে আমাদের ভেতরে মিউজিক ঢুকত না”।
গানের মধ্য দিয়ে শান্তি খুঁজতেন তিনি। গানের মধ্যেই পেয়ে যেতেন তার স্বস্তি ও সুখটুকু। যে গান নিয়ে তার ঘর-সংসার, সে গানকে কখনোই ছাড়তে পারেননি তিনি। তাই তো অসুস্থশয্যায় শুয়েও লাকী গিটার ধরেছেন, আঙ্গুলের ছোঁয়ায় সেই চেনা সুর এনেছেন আর গেয়ে উঠেছেন, “ঝড়ের দিনে ভুলেছে যে পথ, আমি জানি জানি তার বেদনা/ তোমার মনের নীরব আশা, সেও তো আমার আছে জানা”। পথভোলা পথিকের যে বেদনা ঝড়ে প্রবল হয়ে ওঠে, সেই বেদনাকে সুর দিয়েছেন তিনি। নীরবতার কন্ঠ শুনে সেই অনুভূতিতে সুর দিয়েছেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রেও ছিলেন লাকী আখন্দ
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাতে লাকী চলে যান স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। সেখানে তার রেকর্ডে গান হয়েছে—‘জন্মভূমি বাংলা মাগো/একটি কথা শুধাই তোমারে।’, ‘ওই চেয়ে দেখ পুব আকাশ/ফিকে হলো, ভোর হলো, ভোর হলো/পথের আঁধার আর নাই’, ‘আমরা গেরিলা, আমরা গেরিলা/মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর’।
সঙ্গীতজগতে তার পদচিহ্ন
১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে প্রকাশ পায় লাকী আখন্দের প্রথম একক অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’ (সেলফ্ টাইটেলড, লেভেলঃ সারগাম-১২০)। বাংলা সঙ্গীতের ক্ল্যাসিক সেই অ্যালবামটির উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলোঃ ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি কি জানি না’ ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’, ‘সুমনা’, ‘তোমার স্বাক্ষর আঁকা’। পরবর্তীতে এর মধ্য থেকে ‘আমায় ডেকো না’ গানটি তিনি শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে উপহার দেন এবং সামিনা চৌধুরী তার একক অ্যালবামে গানটি যুক্ত করেন।
তুমুল জনপ্রিয় গান ‘যেখানে সীমান্ত তোমার – কুমার বিশ্বজিৎ’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে – সামিনা চৌধুরী’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা – হ্যাপী আখন্দ’, ‘কে বাঁশি বাজায়রে – হ্যাপী আখন্দ’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে – হ্যাপী ও লাকী’, ‘নীল নীল শাড়ী পড়ে – লাকী আখন্দ’, ‘পাহাড়ি ঝর্ণা – লাকী ও হ্যাপী’, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ – লাকী আখন্দ’ সহ আরও অনেক শিল্পীর অনেক অনেক জনপ্রিয় গান বাংলা সঙ্গীতের এই কিংবদন্তীর সুরারোপ ও সঙ্গীতায়োজনে করা।
অনেক বেশি গাওয়া কিংবা শোনা গানে, আমরা অনেকে হয়তো জানিইনা- গানগুলো কে গেয়েছে কিংবা কার সুরারোপে, কার আয়োজনে গানটি আমাদের এতো প্রিয় তালিকায় চলে এসেছে। বড়জোর কে গানটি গেয়েছে, তা-ই হয়তো মনে থাকে, কিন্তু সে গানের স্বরেরও পেছনে থেকে যান কিছু নেপথ্য গায়ক। লাকী আখন্দ তাদের একজন।
তিনি স্টেজের সামনের গায়ক ছিলেন অবশ্যই এবং সেজন্যও তিনি জনপ্রিয়। কিন্তু তার নেপথ্যকর্মগুলো বেশিরভাগই ততটুকু স্বীকৃতি পায়নি যতটুকু পেয়েছে তার গাওয়া গানগুলো। তার “আবার এলো যে সন্ধ্যা” গানটি শুনে সান্ধ্যমায়ামাখা বাতাসে দোলা লেগেছে কত মনে, কে জানে! অজান্তে ঘুরে আসবার সেই চির-আহবান, “চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে!” নদী কোথায় থেমে যায়, আদৌ থামে কিনা জানা হয় না, তবু তার এই গানটি যখন-তখন অজানায় ঘুরে আসবার ইচ্ছেকে আজো জোরদার করে তোলে! চোখ বন্ধ করে গানের সুরে ডুবে অনেকেই আজও অজানায় ঘুরে আসতে চান তার প্রিয় মুখটিকে ভেবে, লাকী আখন্দের গানটির মতোই!
সফট্-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক- সবক্ষেত্রেই প্রায় সমান বিচরণ করতেন এই ব্যক্তি। আর তাই সব বয়সের মানুষের মনকে ছোঁয়ার সাধ্যও ছিল তার।
কিছুদিন নির্বাসন অতঃপর ফিরে আসা
১৯৮৭ সালে ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দের মৃত্যুর পরপর সঙ্গীতাঙ্গন থেকে অনেকটাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এই গুণী শিল্পী। মাঝখানে প্রায় এক দশক নীরব থেকে ১৯৯৮-এ ‘পরিচয় কবে হবে’ ও বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবাম দুটি নিয়ে আবারও ফিরে আসেন সঙ্গীতাঙ্গনে। প্রাণের টানে ফিরে আসেন গানের মাঝে গানের এই প্রেমিক। সঙ্গীতভক্ত শ্রোতাদের সৃষ্টির বেদনায় ভাসাতে আবারও দুটি হাত মেলে দিয়ে হাত রাখলেন সেই পুরোনো কীবোর্ডে, কথার পরতে পরতে সাজাতে থাকলেন সঙ্গীতের অপার্থিব স্বরলিপি। আর কথামালাগুলো সুরের উষ্ণতায় মেতে ওঠে নতুন নতুন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
তার শেষ দিনগুলো
২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লাকী আখন্দের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তাকে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে কিছুদিন তার চিকিৎসা করানো হয়। থাইল্যান্ডের পায়থাই হাসপাতালে তার যকৃতে অস্ত্রোপচারও করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর দেশে এসে কিছুদিন থাকার পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে মাসেই আবারও ব্যাংককে গিয়ে ছয়বার কেমোথেরাপি নিতে হয়েছিল তাকে। কেমো শেষ করে ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ দেশে ফেরেন তিনি। বিএসএমএমইউ ও বারডেম হাসপাতালেও মোট নয়বার কেমোথেরাপি নেবার পর চিকিৎসকরা তাকে বাসায় কিংবা পাহাড়ে গিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি তার আরমানিটোলার বাসায়ই ছিলেন।২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল শুক্রবার হঠাৎ করে আবারো অসুস্থ হয়ে যাবার পর তাকে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।