কখনও কি লক্ষ্য করেছেন, মা শব্দটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় মোটামুটি একইভাবে উচ্চারিত হয়? বিশ্বের মোটামুটি অর্ধেক মানুষ ম্যান্দারিন, হিন্দি, ইংরেজি বা আরবি ভাষায় কথা বলে। আর এ ভাষাগুলোতে মা শব্দটি উচ্চারিত হয় ‘মা’ অথবা ‘মামা’ হিসেবে। এর বাইরেও বাংলায় মা, আম্মা বা আম্মু; ফরাসী, ইতালিয়ান, নরওয়েজিয়ানসহ অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষায় মামা, হিব্রুতে উম্ম বা আম্ম – এরকম বিশ্বের প্রায় সব ভাষায়ই মা শব্দটির উচ্চারণ খুবই কাছাকাছি।
একই কথা বাবা শব্দটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলায় বাবা, আব্বা বা আব্বু; ইংরেজিতে পাপা, পপ বা ড্যাডি; আরবিতে বাবা অথবা আব, ফরাসী ও নরওয়েজিয়ান ভাষায় পাপা, ইতালিয়ান ভাষায় বাবো। অর্থাৎ অধিকাংশ ভাষায়ই মা শব্দটির উচ্চারণ হয় ম অথবা ন জাতীয় নাসিকা ধ্বনি দিয়ে। যেমন মা, মামা, কিছুক্ষেত্রে নানা। অন্যদিকে বাবা শব্দটি উচ্চারিত হয় প, ব অথবা ড/দ/ট/ত জাতীয় ধ্বনি দিয়ে। যেমন বাবা, পাপা ডাডা, দাদা ইত্যাদি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? যেখানে বিশ্বের দুই প্রান্তের দুটি ভিন্ন ভাষার প্রায় অধিকাংশ শব্দই সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাদের বর্ণ, প্রতীক, ব্যাকরণের নিয়মাবলি, সবই ভিন্ন, সেখানেও কেন মা ও বাবা শব্দ দুটির উচ্চারণ প্রায় একই রকম হয়ে থাকে? যদি শুধুমাত্র একই ভাষাবংশ থেকে উৎপত্তি লাভ করা আধুনিক ভাষাগুলোর মধ্যে এ মিল লক্ষ্য করা যেত, তাহলে কারণটা সহজেই ব্যাখ্যা করা যেত। যেমন অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষা যেহেতু প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা থেকে এসেছে, তাই এসব ভাষায় কিছু কিছু শব্দ যদি একইভাবে উচ্চারিত হয়, তাহলে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক না।
কিন্তু বাস্তবে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সম্পর্কই নেই, এরকম ভাষাগুলোতেও এ মিল লক্ষ্য করা যায়। যেমন আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষায় মা ও বাবাকে বলা হয় মামা ও বাবা, ফিলিপিন্সের তাগালগ ভাষায় বলা হয় নানেয় ও তাতেয়, ফিজিয়ান ভাষায় বলা হয় নানা ও তাতা। চেচেন ও ককেশীয় ভাষায় বলা হয় নানা ও দা। এমনকি চীনের ম্যান্দারিন ভাষা, যা ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেখানও বলা হয় মামা ও বাবা। আমেরিকার আদিবাসীরাও শব্দ দুটোকে প্রায় একইভাবে উচ্চারণ করে। এস্কিমোদের ভাষায় বলা হয় আনানা ও আতাতা, লুইজিয়ানা ও টেক্সাসের আদিবাসীদের কোয়াসাতি ভাষায় বলা হয় মাম্মা ও তাতা এবং এল সালভাদরের আদিবাসীদের পিপিল ভাষায় বলা হয় নান ও তাতাহ।
ভাষাবিদদের ধারণা, বর্তমানে প্রচলিত ভাষাগুলোর সবগুলো যদি না-ও হয়, অন্তত অর্ধেক ভাষা একটিমাত্র আদিভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তাই সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মা-বাবা শব্দদুটো বিশ্বের প্রাচীনতম শব্দ এবং সেগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এর সম্ভাব্যতা তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, সেক্ষেত্রে মা-বাবা ছাড়াও আরও কিছু সার্বজনীন শব্দও প্রায় অবিকৃতভাবে টিকে থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে একই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু শব্দের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও মা-বাবার মতো সার্বজনীন মিল খুব কম শব্দেই পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ পানি শব্দটির কথা বিবেচনা করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় শব্দটি বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। বাংলায় পানি বা জল, ইংরেজিতে ওয়াটার, আলবেনিয়ান ভাষায় উজি, আরবি ভাষায় মা’, ম্যান্দারিন ভাষায় শুই, জাপানীজ ভাষায় মিজু, কোরিয়ান ভাষায় মূল, রুশ ভাষায় ভোদা, ড্যানিশ ভাষায় ভ্যান্ড, ফিনিশ ভাষায় ভেসি, ফরাসী ভাষায় ইয়েউ, ইতালিয়ান ভাষায় অ্যাকোয়া। অর্থাৎ পানির মতো জীবন ধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান, যার সাথে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের জন্মের পর থেকেই পরিচিতি ঘটে, সেটিও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে প্রায় সকলের শব্দের ক্ষেত্রেই, একমাত্র ব্যতিক্রম বাবা ও মা।
কিন্তু কেন এই ব্যতিক্রম? এর উত্তরটি নিহিত আছে শিশুরা কীভাবে কথা বলতে শেখে, তার মধ্যে। জন্মের পর শিশুর প্রথম উচ্চারিত ধ্বনি হয় সাধারণত তার ক্রন্দনের শব্দ। এবং স্বাভাবিকভাবেই এটি হয় ‘আ’ স্বরবর্ণটির মতো। কারণ এই ধ্বনিটি শিশু তার স্বরযন্ত্রের কোনো কসরৎ ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে। স্বরবর্ণের পর শিশু প্রথম যে ব্যঞ্জনবর্ণটি উচ্চারণ করতে শেখে, তা হলো ‘মা’। কারণ শিশুকে দুধ পান করানোর সময় তার ‘আ’ চিৎকার যখন বাধা পড়ে, তখন তা ‘মা’ এর মতো শোনায়। বাধা পড়ার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে প্রথম উচ্চারিত শব্দটি ‘মামা’ বা ‘আম্মা’ও হতে পারে।
বিখ্যাত ভাষাবিদ রোমান জ্যাকবসনের মতে, শিশুর এভাবে কথা বলতে শেখাটা নিছকই অর্থহীন। কিন্তু তার আশেপাশের মানুষেরা সেটাকে এভাবে দেখে না। তারা শিশুর প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গির মধ্যেই অর্থ খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। যেহেতু অধিকাংশ সময়ই শিশুর সবচেয়ে কাছাকাছি উপস্থিত থাকেন তার মা, তাই প্রথম উচ্চারিত মা, মামা বা আম্মা শব্দটিকে তিনি তার প্রতি শিশুর সম্বোধন হিসেবেই কল্পনা করে নেন এবং পরবর্তীতে শিশুর সাথে কথোপকথনের সময় নিজেকে সেই প্রথম শব্দ মা বা মামা হিসেবে উপস্থাপন করেন।
রোমান জ্যাকবসনের মতে, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ভাষার উৎপত্তি ঘটলেও সেখানে ঠিক এভাবেই মা এর প্রতিশব্দ আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এ কারণেই অন্য অনেক শব্দ সময়ের সাথে সাথে বিকৃত হয়ে গেলেও মা শব্দটি প্রায় অবিকৃত থাকে, কারণ এখানে উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরেই যাওয়া হোক, অথবা যত বেশি সময়ই অতিবাহিত হোক, প্রতি প্রজন্মেই নতুন করে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং মা শব্দটি পুনর্জন্ম লাভ করে।
‘মা’ অথবা এর প্রতিশব্দ উচ্চারণ করতে শেখার পরপরই শিশু দ্বিতীয় যে শব্দটি উচ্চারণ করতে শেখে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়ে থাকে প অথবা ব জাতীয় ধ্বনি। এ সময় শিশু দুই ঠোঁট দিয়ে মুখ গহ্বর থেকে বায়ু নির্গমনের সময় শুধুমাত্র বাধা না দিয়ে একটু চেপে ধরে এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বায়ু নির্গমন করতে শেখে। ফলে ‘পা’, ‘বা’, ‘পাপা’, ‘বাবা’ এ জাতীয় শব্দগুলোর উৎপত্তি ঘটে। যেহেতু মায়ের পরেই শিশুর দ্বিতীয় আপন ব্যক্তি বাবা, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই শব্দটিকে বাবার প্রতিশব্দ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
সবক্ষেত্রে যে শিশু ‘মা’ উচ্চারণের পরেই ‘বা’ বা ‘পা’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে শেখে এমন নয়। কখনও কখনও সে জিহ্বার গোড়াকে উপরের তালুর সাথে লাগিয়ে ‘দা’ বা ‘তা’ও উচ্চারণ করে। ফলে কিছু কিছু ভাষায় তাতা, দাদা, ডাডা প্রভৃতি দিয়ে বাবাকে বোঝানো হয়। কিছু কিছু ভাষায় অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের সম্বোধনমূলক শব্দও অনেকটা একইভাবে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন বাংলায় দাদা, নানা, মামা, চাচা ইত্যাদি।
তবে শুধু মা-বাবা না, আরও দুটি শব্দের ক্ষেত্রেও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এরকম মিল দেখা যায়। শব্দ দুটি হলো ‘আমি’ এবং ‘তুমি’। ভাষাবিদ জোহানা নিকোলসের মতে, ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ার অধিকাংশ ভাষায় ‘আমি’ শব্দটির উচ্চারণ ‘ম’ এর কাছাকাছি এবং ‘তুমি’ শব্দটির উচ্চারণ ‘ত’ এর কাছাকাছি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলায় আ’মি’, ‘তু’মি বা ‘তু’ই। পুরাতন ইংরেজিতে মি (me), দৌ (thou)। ফরাসি ভাষায় মোই (moi), তোই (toi)। স্প্যানিশ ভাষায় মি (me), তু (tu)।
এর বাইরেও অনেক দূরবর্তী ভাষায়ও শব্দ দুটির উচ্চারণে আশ্চর্যজনক মিল দেখা যায়। যেমন রাশিয়ান ভাষায় বলা হয় মেনিয়া (menja) ও তেবিয়া (tebja)। ফিনিশ ভাষায় বলা হয় মিনা (minä) ও সিনা (sinä)। এমনকি, সাইবেরিয়ার ইউকাগির ভাষায়ও বলা হয় মেত (met) এবং তেত (tet)। নিকোলসের মতে, মা-বাবার মতোই আমি-তুমি শব্দগুলোরও উৎপত্তি হয় একইভাবে, এবং এর ফলেই সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় মোটামুটি একইভাবে উচ্চারিত হয়।
ভাষা যেহেতু গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানের মতো নিখুঁত সূত্র মেনে চলে না, তাই এগুলোর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিশ্বের বেশ কিছু ভাষা আছে, যেখানে মা-বাবা, কিংবা আমি-তুমি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। কিন্তু তারপরেও যে বিপুল সংখ্যক ভাষায় এদের উচ্চারণ পরস্পরের খুবই কাছাকাছি, তা মোটেও অগ্রাহ্য করার মতো না। ভাষাবিদরা বিভিন্ন ভাষার ক্রমবিবর্তন সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারলেও কোনো একটি শব্দ ঠিক কী কারণে ওভাবেই উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়েছে, সেটা অধিকাংশ সময়েই ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কিন্তু মা-বাবা শব্দ দুটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে তারা বেশ ভালোভাবেই রহস্যের সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন।
ফিচার ইমেজ- videoblocks.com