বড়দিন কিংবা ক্রিসমাস বলতে আমরা একমুখ সাদা দাড়ি ভর্তি সান্তা আর তার স্লেজগাড়িকে বুঝি। দেশে দেশে বড়দিনের অন্যতম প্রধান চরিত্রটি অবশ্য সান্তাই। তবে দেশভেদে এই গোলগাল ভালো মানুষটি বাদেও বড়দিনের সাথে এমন কিছু উদ্ভট আর অন্যরকম অনেক পৌরাণিক চরিত্র জড়িয়ে আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। বিভিন্ন দেশে নানা রূপে আছে এরা। বড়দিনে বিভিন্ন দেশে প্রাধান্য পাওয়া এমন পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র নিয়েই এই আয়োজন।
দ্য ইউল গোট
লাল নাকওয়ালা রেইন্ডার নামের বাচ্চা হরিণটিকে তো আপনি নিশ্চয় চেনেন। তবে সুইডিশদের মতে, সান্তার স্লেজগাড়ি টেনে নেওয়ার জন্য সবসময় কিন্তু রেইন্ডার ছিল না। তখন ইউল গোটকেই স্লেজ টানার কাজে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। কে এই ইউল গোট? থরের রথ টানতো যে দুটি ছাগল, তাদের বংশধর এই ইউল। বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে আসতে সান্তাকে সাহায্য করতো ইউল গোট। স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে এখনো বড়দিনে খড়ের তৈরি ইউল গোট বেশ পরিচিত এক চরিত্র। তবে সমস্যা হল, বিশাল এই খড়ের ছাগলে অনেকেই লুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বড়দিনের সময়। এই সমস্যা দূর করতে সম্প্রতি কম জ্বলে এমন খড় ব্যবহার করে ইউল গোট নির্মাণ করতে শুরু করেছে সুইডেনের বাসিন্দারা।
ফ্র্যাও পার্চটা
জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে বড়দিনের একটি নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে গণ্য করা হয় ফ্র্যাও পার্চটাকে। প্যাগান ধর্মাবলম্বী ফ্র্যাও পার্চটা অনেক আগের একটি চরিত্র। এ দুটি দেশে খ্রিস্টধর্ম আসার আগেই তার জন্ম হয়। তবে দেশগুলোর আধুনিক যুগের বড়দিনেও বেশ বড় একটা প্রভাব রেখেছে সে।
হিংস্র চেহারার আগাগোড়া গাউনে মোড়া এক বৃদ্ধা- ফ্র্যাও পার্চটার অবয়ব অনেকটা এভাবেই সাজানো হয়। তার লম্বা গাউনের ভেতরে ধারালো ছুরি লুকানো থাকে। বড়দিনের সময় বের হয় ফ্র্যাও পার্চটা। কোনো ভালো বাচ্চার সন্ধান পেলে তাকে উপহার দেয়, আর কেউ দুষ্টুমি করলে ছুরি বের করে ছুটে যায়। বেশ রোমাঞ্চকর চরিত্র, তাই না?
কাল্লিকান্তজারোই
কেবল সান্তার মত ভালো চরিত্রই নয়, বড়দিনের সাথে জড়িয়ে আছে কাল্লিকান্তজারোই নামের এক পিশাচের নামও। তবে কাল্লিকান্তোজারোইয়ের উপস্থিতি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপেই বেশি। মাটির নিচে বাস করা এই পিশাচেরা বেশ দুষ্ট এবং আকারে ছোট। ইউরোপিয়ানদের মতে, শুধু বড়দিনের ১২ নম্বর দিনেই কাল্লিকান্তজারোইকে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া বাকিটা সময় মাটির নিচে থেকে পৃথিবীকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে এরা।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ওয়ার্ল্ড ট্রি বা বিশাল এক গাছ টিকিয়ে রেখেছে পৃথিবীকে। সারা বছর সেই গাছের শেকড় ওঠানোর কাজেই ব্যস্ত থাকে কাল্লিকান্তজারোইরা। বড়দিনের সময় নিজেদের কাজে হতাশ হয়ে বিরতি নেয় তারা। আর এ সময়েই আবার নিজেকে আগের মতন শক্তপোক্ত করে তোলে ওয়ার্ল্ড ট্রি। ফলে পৃথিবী ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।
লা বেফানা
বড়দিনে উপহার নিয়ে আসা পৌরাণিক সব চরিত্রই চিমনি দিয়ে ঘরে ঢুকতে ভালোবাসে। লা বেফানা এর চাইতে আলাদা কিছু নয়। নিজের লম্বা ঝাড়ু নিয়ে প্রতিটি ঘরে বাচ্চাদের দেখতে আসে এই ডাইনী। লা বেফানার জন্য চিমনির সাথে বাচ্চারা মোজা ঝুলিয়ে রাখে। কোনো বাচ্চা ভালো কাজ করলে তাকে উপহার দেয় লা বেফানা, আর দুষ্টুমি করলে মোজার ভেতরে কয়লা পুরে রাখে- এমনটাই সবার বিশ্বাস।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শিশু যিশু খ্রিস্টকে দেখার আহ্বান এলে লা বেফানা তাতে রাজী হয়নি। অবশ্য পরে তার মন বদলায়। তারপর থেকেই সে যিশুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আর অন্য শিশুদের উপহার দিয়ে যাচ্ছে। ইতালির নানা স্থানে বড়দিনের সময় লা বেফানার জন্য নানারকম খাবার এবং পানীয় রাখা হয়।
গ্রিলা এবং ইউল বিড়াল
বড়দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর নানা স্থানে নানারকম চরিত্র তৈরি হয়েছে। তবে এসব চরিত্রের মধ্যে সবচাইতে নেতিবাচক চরিত্রটি তৈরি করেছে আইসল্যান্ডবাসীরা। ভয়ংকর এই চরিত্রটির নাম গ্রিলা। আইসল্যান্ডের ১৩ শতকের লোককাহিনী থেকে উঠে আসা গ্রিলা বড়দিনের দিন নিজের থলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনো দুষ্টু বাচ্চাকে সামনে পেলে তাকে থলিতে ভরে নেয় সে। তবে কেবল গ্রিলা একা নয়, তাকে এ সময় সঙ্গী হিসেবে সাহায্য করে একটি ইউল বিড়াল।
জোলাকোট্টুরিন নামের এই বিড়ালটি আবার বেশ ফ্যাশন সচেতন। তাই বড়দিনের দিন কারও পোশাক পছন্দ না হলে সে বেশ ক্ষেপে যায়। আইসল্যান্ডে সারা বছর ভালো কাজ করলে বাবা-মা বাচ্চাদের নতুন পোশাক কিনে দেয়। তাই জোলাকোট্টুরিন অপেক্ষা থাকে এবং পোশাক দেখে বাছাই করে কে সারা বছর ভালো কাজ করেছে আর কে করেনি।
দ্য ইউল ল্যাডস
বড়দিনের সাথে জড়িত ইউল ল্যাডস নামের চরিত্রগুলোও এসেছে গ্রিলার কাছ থেকে। আইসল্যান্ডের এই ১৩ জন চরিত্রকে জন্ম দেয় গ্রিলা। বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য গ্রিলাকে সাহায্য করে ইউল ল্যাডসরা। এই ১৩ জনের প্রত্যেকেই প্রচন্ড দুষ্টু এবং একেক কাজে অভ্যস্ত। বড়দিনের ১৩ দিন আগে থেকে ইউল ল্যাডসদের জন্য একটি করে জুতো ঝুলিয়ে রাখে আইসল্যান্ডের বাচ্চারা। কোনো বাচ্চার উপরে সন্তুষ্ট হলে তার জুতোয় মিষ্টি রাখে ইউল ল্যাডস, না হলে পচা সবজি রেখে দেয়। ১৭৪৬ সালে আইসল্যান্ডের অধিবাসী বাবা-মায়েদের উপরে নিষেধাজ্ঞা আসে ইউল ল্যাডসের কাহিনী বলে বাচ্চাদের ভয় দেখানোর ব্যাপারে।
মারি লুইড
একটি ঘোড়ার মাথার কঙ্কাল! ঠিক পড়েছেন। আস্ত ঘোড়ার মাথার কঙ্কালকেই সবাই মারি লুইড বলে জানে। লন্ডনে এমনিতেও নানারকম উৎসবে এরকম কঙ্কালের মাথা ব্যবহার করা হয়। তবে ওয়েলসে ব্যবহার করা হয় ঘোড়ার মাথার কঙ্কাল। বড়দিনের সময় একটি দল মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম বুদ্ধিদীপ্ত কথা ছুঁড়ে দেয় বাড়ির ভেতরের মানুষগুলোকে উদ্দেশ্য করে। তাদের হাতে থাকে কাপড় দিয়ে সাজানো একটি ঘোড়ার মাথার কঙ্কাল। প্রথা অনুযায়ী, এ সময় বাড়ির বাসিন্দাদেরকেও বুদ্দিদীপ্ত কোনো উত্তর দিতে হয়। যদি সেটা করতে গিয়ে বাসিন্দারা হেরে যায় তাহলেই বুঝতে হবে যে, মারি লুইড বাড়িতে প্রবেশ করেছে। আর তার সাথে সাথে খারাপ সময় বাড়িতে প্রবেশ করেছে ঘোড়ার কঙ্কালের বেশ ধরে।
ক্রাম্পাস
ক্রাম্পাস কেবল যে কোনো একটি অঞ্চলের কাছে পরিচিত তা কিন্তু নয়। বর্তমানে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও গল্পের কারণে মধ্য ইউরোপের বড়দিনের চরিত্র ক্রাম্পাসের বিচরণ সবখানে। অনেকেই এখন চেনে এই আধা ছাগল, আধা মানবকে। ফাদার ক্রিসমাসের মূল উৎপত্তি, সেইন্ট নিকোলাসের ভোজের দিন ডিসেম্বরের ৬ তারিখ। আর তার ঠিক আগের রাতটিই পরিচিত ক্র্যাম্পাসন্যাচট নামে।
একদিকে সেইন্ট নিকোলাস যেমন সারা বছর ভালো ব্যবহার করা, ভালো হয়ে থাকা বাচ্চাদের উপহার দেয়, ক্রাম্পাস তেমন করে দুষ্টু বাচ্চাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকে। ক্রাম্পাস নামক শয়তান চরিত্রটির জন্ম খ্রিস্টধর্ম আসার আগেই। প্যাগানদের কোনো এক দানব বলে মনে করা হয় তাকে। এখনো বড়দিনে ক্রাম্পাস সেজে অনেককেই দেখা যায় রাস্তায় নামতে। তাদের হাতে থাকে বার্চের ডাল। সেটা দিয়েই বাজে মানুষদের আঘাত করে তারা।
ফিচার ইমেজ: Tumblr