পাল সাম্রাজ্য (সম্ভাব্য ৭৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ), ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পর প্রতিষ্ঠিত বিস্তৃত একটি সাম্রাজ্য। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলা অঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন শশাঙ্ক। তার রাজত্বকাল সম্ভাব্য ৬০৬-৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ। তার মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে প্রায় ১০০ বছর অরাজকতা চলতে থাকে এবং এই সময়ের মাঝে নির্দিষ্ট বড় কোনো সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। তখন অখণ্ড বাংলা সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট সামন্ত রাজারা ছোট ছোট অঞ্চল শাসন করতে থাকে।
এসময় ভারতবর্ষে সুখ সমৃদ্ধি ছিল না বলা যায়। তাই তখনকার তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো শিল্পের উদাহরণ পাওয়া যায় না। অরাজকতার চরম পর্যায়ে অখণ্ড বাংলার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। সেই রাজা হচ্ছেন বরেন্দ্রভূমির গোপাল। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় পাল সাম্রাজ্য। সময়টা সম্ভাব্য ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ। এর মাধ্যমে অখণ্ড বাংলার অবস্থার উন্নতি হয়।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছিলেন রাজনৈতিক, দার্শনিক, ধর্মীয়, সাহিত্যিক, শিল্প বিষয়ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকাশের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক বিকাশ। এগুলো পরস্পরের ওপর প্রতিক্রিয়া করে। নতুন রাজা ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতবর্ষ দীর্ঘ অরাজকতা ও মৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে মুক্তি পায় তাই অর্থনৈতিক বিকাশও হয়। ফলে আবার ভারতবর্ষে শিল্পের চর্চা শুরু হয়।
প্রেক্ষাপট
কোনো যুগের চিত্রকলা সম্বন্ধে জানতে হলে তার প্রেক্ষাপট জানা জরুরি। শিল্পকলা বা চিত্রকলা তার পরিপার্শ্বিক অবস্থা, উপাদান, ধর্ম ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভারতবর্ষে শিল্পকলা বিকশিত হয়েছিল বৈদিক ও মহাকাব্যিক যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। সে যুগে গড়ে ওঠা ধর্মীয় বিশ্বাস পরবর্তী যুগের শিল্পকলায় প্রতিফলিত হয়েছিল। পাল যুগও এর ব্যতিক্রম নয়। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সম্রাট অশোকের সময় বিভক্ত হওয়া বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস হীনযান ও মহাযান থেকে আরও কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যেমন তন্ত্রযান ও বজ্রযান। ফলে দেখা যায় বৌদ্ধ ধর্মে কেন্দ্রীয় গৌতম বুদ্ধ ছাড়াও আরও দেব-দেবীর আবির্ভাব হতে থাকে।
এসব দেব-দেবীর মধ্যে আছে মৈত্রীয়, মহাকাল, বজ্রপাণি, তারা, মহাপ্রতিসরা, কুরুকুল্লা, চুণ্ডা, বজ্রস্বত্ব, মোঞ্জ ঘোষ প্রমুখ। বৌদ্ধ ধর্মে নতুনভাবে বেড়ে উঠা এই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে পাল চিত্রকলা বিকশিত হতে থাকে। এ সময়ে এসব দেব-দেবীর অংকিত চিত্রসহ পুথি তৈরি হতে থাকে, যা সাধারণত পুণ্য অর্জনের আশায় বুদ্ধ ভিক্ষুরা এসব করাতেন এবং পরবর্তীতে এসবই পাল পুথিচিত্র নামে পরিচিত হয়।
এছাড়াও পাল সাম্রাজ্যের সময় পুরো ভারতবর্ষেই নতুনভাবে হিন্দুত্ব ব্রাহ্মণ্যবাদ জেগে ওঠে। অনেক বৌদ্ধ তখন নেপালে পালিয়ে যায়। কিন্তু পূর্ব ভারতে পাল রাজারা ছিলেন পরধর্ম সহিষ্ণু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এমনকি পাল রাজা ধর্মপাল ও দেবপাল বেশ কিছু বিষ্ণু ও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও পাল রাজা ধর্মপাল ও দেবপাল নালন্দা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এখানে অসংখ্য প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল পরে।
পাল পুথি চিত্রকলা
একজন শিল্পীর চিন্তা বা ধারণাকে রং বা অন্য কিছুর মাধ্যমে কোনো তলে রূপ দান করাকে চিত্রকলা বলা যায়। পাল সাম্রাজ্যে, বৌদ্ধ গ্রন্থ অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন পুথিকে কেন্দ্র করে যে চিত্রকলা বিকশিত হয়েছিল তাকে পাল পুথি চিত্রকলা বলা হয়। এই চিত্রগুলো ছিল অনেকটা বুক ইলাসট্রেশনের মতো। সাধারণত তাল পাতায় দুই পাশে ধর্মীয় পঙক্তি লেখা হতো এবং মাঝখানে গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন কাহিনী এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মে বিকশিত হওয়া বিভিন্ন দেব দেবীর ছবি চিত্রিত করা হতো। এগুলো পুথির সৌন্দর্য ও ধর্মীয় মান বৃদ্ধি করতো।
পাল চিত্র করা হতো তাল পাতায়। প্রথমে তালপাতা প্রস্তুত করে নেওয়া হতো। পূর্ব ভারতে দুই ধরনের তালপাতা পাওয়া যেত, খড়তাড় ও শ্রীতাড়। পুথির ক্ষেত্রে শ্রীতাড় বেশি উপযুক্ত। দৈর্ঘ্যে ৯০ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৭.৫ সেন্টিমিটার। পাতলা, নমনীয় ও কম ভঙ্গুর হওয়ায় এই পাতা বেশি টেকসই ও উপযোগী বলে বিবেচিত হতো। পাতা সংগ্রহের পর মাসখানেক পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। তারপর সেখান থেকে তুলে শুকিয়ে সংখ দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হতো। এরপর সমান করে কেটে নিয়ে ছিদ্র করে পুথি বাধার উপযোগী করা হতো।
লিপিকর পাতার দৈর্ঘ্যের সমান্তরালে পাঁচ থেকে সাত পঙক্তি লিখতো। যে পুথিতে চিত্র অংকিত হতো, সেখানে চিত্র অংকনের জন্য লিপিকর ফাকা জায়গা ছেড়ে যেত। সাধারণত পুথির মাঝখানে চিত্র অংকিত হতো। কিছু পুথিতে মাঝখানে ও দুই পাশে তিনটি করে চিত্রিত অংশ দেখা যায়। পরবর্তীকালে পুথি বাধার ছিদ্রের অংশেও চিত্রিত হতে দেখা যায়। এ চিত্রকলায় ব্যবহার করা হতো গোয়াস বা ভারী জলরঙ পদ্ধতিতে। হলুদ, চক সাদা, ইন্ডিগো নীল, প্রদীপের শিষের কালি, সিন্দূর লাল, হলুদ ও নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট সবুজ ইত্যাদি রঙের প্রাধান্য থাকতো চিত্রগুলোয়।
বৈশিষ্ট্য
বরেন্দ্র ভূমির দুইজন শিল্পীর নাম ধীমান ও বিটপাল। বিটপাল মূলত ধীমানেরই পুত্র। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারনাথ তার ‘ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ধীমান ছিলেন ‘নাগ’ রীতির অনুসারী। উত্তর ভারতের মথুরা ছিল নাগ উপাধিধারী রাজাদের একটি অন্যতম কেন্দ্র।
প্রাচীনকালে শিল্পকর্মের চর্চা হতো বংশ পরম্পরায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়, একটি বংশের এক প্রজন্ম যেভাবে শিল্পচর্চা করেছে, তার ছাপ পরবর্তী বংশ পরম্পরাতেও থেকে যায়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে পাল চিত্রকলা। পাল চিত্রকলা রীতি ও বৈশিষ্ট্য বিচারে সর্বাগ্রে চলে আসে তার ছন্দময় রেখা ও রঙের মাধ্যমে আলো ছায়া ও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত সাবলীল শারীরিক গঠন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেন ভারতীয় ধ্রুপদী যুগের বাঘ, অজন্তা ও বাদামী গুহার চিত্রকলার নতুন আত্মপ্রকাশ।
তাছাড়াও পাল যুগে চিত্রিত পুথিগুলো ছিল সে যুগের সমকালীন ভাস্কর্যের সহযোগী। চিত্রিত পুথিতে দেব-দেবীর রূপ নির্মাণ অনেকটা এমন ছিল যে শিল্পী যেন সেই যুগের ভাস্কর্যগুলোকেই তালপাতার ঐ ক্ষুদ্র আয়তনে রং ও রেখার মাধ্যমে রূপদান করেছেন।
পাল যুগে অংকিত পুথি চিত্রগুলোতে দেখা যায়, গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও গৌতম বুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ ধর্ম। পরবর্তীতে হীনযান, মহাযান হয়ে তন্ত্রযান ও বজ্রযান বিশ্বাসে বিভক্ত হয়ে পড়া বিভিন্ন দেব-দেবীর চিত্র। পাল পুথি চিত্রগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার। যেমন কমলা ও হলুদ এদের মধ্যে প্রধান।
চিত্রগুলোতে রেখার ব্যবহারে ছন্দময়তা বা গতিশীলতা লক্ষ করা যায়। রেখার বঙ্কিমতা পাল পুথি চিত্রে, নারী চরিত্রগুলোকে বেশ ইন্দ্রিয়পরায়ণ করে তুলেছে। উদর পাতলা কিন্তু কোমর প্রশস্ত, এটি যেন পাল সময়ের নির্মিত বিভিন্ন দেবী ভাস্কর্য এবং ভারতবর্ষের পূর্ববর্তী সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত যক্ষি ভাস্কর্যকেই সমর্থন করে।
তালপাতায় একধরনের অমসৃণ টেক্সচার থাকে, তবে শিল্পীরা এতে চিত্রিত করার আগে সংখ দিয়ে পাতাকে ঘষে মসৃণ করে নিতেন। ফলে চিত্র মসৃণই হতো। ফিগার চিত্রণের ক্ষেত্রে শিল্পীরা রিয়ালিজম ও ন্যাচারিলিজমের ব্যবহার পরিত্যাগ করেছেন যা সমসাময়িক ইউরোপীয় চিত্রকলায় দেখা যায়। এর পরিবর্তে চিত্রগুলোকে বেশ ছন্দময়তা বা গতিশীলতা দান করেছেন রেখার মাধ্যমে।
পরিশেষে
মানুষ, ধর্ম এবং বিশ্বাস; শিল্পকলার আলোচনায় এই বিষয়গুলোই বার বার চলে আসে। প্রাচীনকালের মানুষ, সভ্যতা ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীরা তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে পরিচয় দেয় তাদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন শিলালিপি, শিল্পকর্ম, স্থাপত্য ও চিত্রকলার মাধ্যমে। পালযুগে এসে আমরা যে চিত্রকলার নিদর্শন পাই তা নিঃসন্দেহে বাংলার চিত্রকলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাদের শিল্পকলার দিকে তাকিয়ে আজকের যুগের তুলনা করলে ভাবনা চলে আসে- আমারা কী ছিলাম, কোথা থেকে এসেছি আর আমাদের পূর্বপুরুষরা কী করেছে।