শিল্প যখন পথেঘাটে সস্তায় বিকোয়, তখন শিল্পীর মর্যাদাও সস্তায়ই চুকে যায়। প্রতিদিন ধুলোমাখা পথে যে রিকশাগুলো ছড়িয়ে থাকে এদিক-ওদিক, তার পেছনটায় কী থাকে দেখেছেন তো? ঐ যে রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা আয়তাকার পাতগুলো, ঐ যে রিকশা সাজিয়েছে ওরা বহু কারুকাজে- ওগুলোই রিকশাচিত্র বা রিকশা আর্ট।
আপনি রিকশায় উঠবেন, গন্তব্যস্থলে যাবেন, রিকশা থেকে নেমে দর কষাকষি করবেন- এটুকুই সম্পর্ক রিকশার সাথে। তার পেছনের ঐ ছবিগুলোকে খুব শিল্পমন নিয়ে দেখার অবকাশ হয়তো আপনার নেই, কার-ই বা থাকে! চোখে পড়ে, মনে ধরার সময় থাকে না, এমনই অবস্থা আজ আমাদের দেশের রিকশা আর্টের। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে উঠা সাত তলা ভবনের ভিড়ে উঠানওয়ালা পুরনো বাড়ির চিলেকোঠাটির মতোই রিকশা আর্টও বেঁচে আছে। পথযাত্রীদের প্রতিদিনের অলক্ষ্যে, রিকশাচালকদের প্রতিদিনের ঘামে খুব বিশ্বস্ত একটি সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে- ‘রিকশা আর্ট’।
রিকশা আর্ট কী?
বহমান ঐতিহ্য বলা হয় একে, রিকশা যেমন পথে বয়ে চলে তেমনি এর সাথে রিকশা আর্টও। নব্য রোমান্টিকতার একটি ধারা হয়ে রিকশা আর্ট জন্ম নিয়েছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে। খুব কঠিন করে ‘ত্রিচক্রযানচিত্র’ও বলা চলে, কিন্তু সবসময় সবকিছুর বাংলাটা তো আর চলে আসে না ভাষায়। তাই ঐ ‘রিকশা আর্ট’-ই অপেক্ষাকৃত পরিচিত নাম।
রিকশা আর্ট মানেই যে শুধু রিকশার পেছনে আঁকা থাকবে তা কিন্তু নয়। যদিও শুরুটা এ থেকেই, মূলত উজ্জ্বল রঙে আঁকা সুস্পষ্ট সাবলীল ও প্রাণবন্ত গঠনকে রিকশা আর্ট বোঝানো হয়। এর একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা গঠন আছে যা থেকে এটি যদি রিকশায় না এঁকে আপনার ঘরের দেয়ালেও আঁকা হয়, খুব সহজেই চেনা যাবে এটি রিকশা আর্ট!
কোন ঘরানার সদস্য এই রিকশা আর্ট?
কিন্তু এর নিজস্ব একটি স্বাতন্ত্র্য থাকার পরও রিকশা আর্ট চিত্রকর্মের ঠিক কোন অংশের সদস্য সে সম্পর্কে কোনো হদিস নেই। অবশ্য হদিস তারই পাওয়া যায় যা নিয়ে ঠিকঠাক সন্ধান করা হয়। রিকশাচালক থেকে শুরু করে রিকশা শিল্পী- এই শ্রেণীটি অতো বেশি চোখে পড়ার মতো নয়। তাই আজ যদি আপনি প্রশ্ন তোলেন রিকশা আর্ট কোন ঘরানার চিত্রকর্ম? প্রশ্নের উত্তরটা সহজ হবে না।
ঠিক একই প্রশ্ন তুলে নিজের নামকে রিকশা আর্টের সাথে জড়িয়ে ফেলেছেন যে মানুষটি তিনি হলেন জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিক। তার ‘বাংলাদেশি আর্টস অফ দ্য রিকশা’ প্রবন্ধে এর অলঙ্করণ নিয়ে আলোচনা করেন ও নিজেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজেন এবং শেষ পর্যন্ত রিকশা আর্টের মধ্যে মিশে থাকা বহুমুখী জীবনকে উপলব্ধি করে একে আর তিনি একমুখী ছাঁচে ফেলতে পারলেন না। ‘গণমানুষের চিত্র’– এই বলেই রিকশা আর্টকে অভিহিত করেন তিনি।
অভিজাত শিল্পে রিকশা আর্ট নেই, আমাদের লোকজ শিল্প রিকশা আর্টকে নিজেদের বলেনি। এটি গ্রামীণ নয়, আর আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিকে গ্রামীণ ছাঁচে ফেলে দেবার কারণেই রিকশা আর্ট ঠিক সেখানে জায়গা করে নিতে পারেনি। করে নেবেই বা কেন, গ্রামে তো আর রিকশার প্রাচুর্য নেই! ঢাকা নাকি রিকশার শহর, তাই ঢাকার অলিতে গলিতে কিংবা রাজপথে রিকশা আর্টের দেখে মেলে অহরহ। অভিজাত নয় লোকজ কিংবা গ্রামীণ নয়, রিকশা আর্ট মিশে আছে নাগরিক জীবনের সাথে, এটি আদতেই নাগরিক শিল্প। কিন্তু নাগরিক জীবনও কি লোকজ সংস্কৃতির বাইরের কিছু?
কেমন রঙে রাঙে রিকশা?
উজ্জ্বল রঙই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফ্লুরোসেন্ট নীল, সবুজ, লাল, হলুদ, গোলাপি- এই রঙগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। হালকা রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে। খুব দূর থেকেও চোখে ধরা পড়তে পারে সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙগুলো।
অঞ্চলভেদে রিকশা আর্টের রকমফের
যে অঞ্চলের রিকশা, সে অঞ্চলের মত-বিশ্বাস-জীবনযাপন এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে রিকশা আর্টেও। এটি যেহেতু রিকশা মালিকের ইচ্ছেমতন ঠিক হয়, সেহেতু রিকশা মালিক বাংলাদেশের কোন অঞ্চল থেকে এসেছেন সেটি অবশ্যই তার রিকশার পেছনে থাকা ছবিতে প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস, সামাজিক চিত্র, ধর্মীয় মতাদর্শ সবমিলিয়ে রিকশা আর্টের রকমফের নির্ধারিত হয়। কখনো তাই বাঘ-সিংহ-হাতি-ময়ুর হয়ে ওঠে রিকশা আর্টের চরিত্র তো কখনো বা শুধুই রঙ-বেরঙের লতাপাতায় ছেয়ে ওঠে এই নাগরিক শিল্প। সিনেমহলের বেশ ভালো চলাফেরা রয়েছে রিকশা আর্টে! নামকরা নায়ক-নায়িকা বা সিনেমার পোস্টারের ছবি এঁকে সিনেমার রঙে রাঙানো রিকশা আর্টও কম নেই বাংলাদেশের পথে-ঘাটে।
ভেজাল মিশলো রিকশা আর্টেও
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে খাতা-কলমের চেয়ে বেশি কম্পিউটারের কী-বোর্ড, সিনেমাহলের চাইতে বেশি হোম থিয়েটার, গ্রামোফোন কিংবা রেডিও তো হারিয়ে গিয়েছে সেই কবে! রিকশা আর্ট, শহুরে জীবনে রঙের মিশেলে তার আদিরূপ আর ধরে রাখতে পারেনি। এখন সেই অবহেলিত চিত্রশিল্পীদের চাইতে কোনো ছবি পোস্টার হিসেবে প্রিন্ট করিয়ে রিকশার পেছনে বেশ ভালো করে আটকে দিলেই নাম পেয়ে যাচ্ছে রিকশা আর্ট! খাঁটি যে চিত্রকর্ম একসময় জেগে উঠেছিলো নব্য রোমান্টিকতার ধারা হয়ে, তাও আজ ভেজাল মিশিয়েছে নিজের মধ্যে।
কেমন আছেন রিকশা শিল্পীরা?
দেশ-বিদেশের বড় বড় প্রদর্শনীতে হয়তো ঐতিহ্য হিসেবে ভালোয় দাম পায় রিকশা আর্ট। কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে শেকড়ের যে রিকশাশিল্পীরা, তারা তো আর সেই দামের ছোঁয়াও পান না! জীবিকা চালিয়ে জীবন বাঁচাতে দিনে দু’টো কিংবা তিনটের বেশি ছবি আঁকা যায় না। প্রতি ছবিতে খরচ যদি হয় ৫০-৬০ টাকা তো দাম পাচ্ছেন ৩০০/- বা বড়জোর ৩৫০/- । এর চেয়ে বেশি হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবে এর চেয়ে কমে, এমনকি ২০০ টাকা দরে পুরান ঢাকায় রিকশা আর্ট কিনতে পাওয়া যায়। তাই তারা বাধ্য হয়ে অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন, বাপ-দাদার জীবিকা ছেড়ে দিয়ে এখন একটি দামি পেশায় যেতে চাইছেন। এখানে শ্রম যত সস্তায় বিকোয়, তার চাইতে বেশি সস্তা বস্তু হয়ে যায় শিল্প! শিল্পের পেছনে থাকা শ্রমকে মূল্য দেয়ার চিন্তা করতে পারে না নাগরিক জীবন কিংবা জীবিকা।
তবে কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে রিকশা আর্ট?
কম পারিশ্রমিক পেয়ে এবং চাহিদা কমে যাবার জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন শিল্পীরা। তারা এমন কোনো বিত্তবান সমাজেরও অন্তর্ভুক্ত নন যে শুধু শিল্পের খাতিরে বয়ে চলবেন এই বোঝা। তাদের নিজের পেট চালানো যখন দায় হয়ে পড়ছে তখন এই পথ থেকে সরে যাওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে করছেন আজকের রিকশা আর্টের সাথে জড়িত শিল্পীরা। হয়তো খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের, বিশেষ করে এর রাজধানী ঢাকার বহমান ঐতিহ্যের একটি বিশেষ অংশ- ‘রিকশা আর্ট’ বিলুপ্ত হয়ে যাবে শিল্প ও শিল্পীর প্রতি অবহেলার খাতিরে।
বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তবে তা সরকারিভাবে নয়, কিছুটা ব্যক্তিগতভাবে। ‘Rickshaw art in Bangladesh’ নামে একটি ওয়েবসাইট একটি রিকশা আর্টের বিক্রয়ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। এতে একেকটি ছবির দাম রাখা হয়েছে আকারভেদে ইউএস ডলার ৮০/১০০/২০০ এরকম, যা প্রচলিত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি। এটি মূলত রিকশা আর্টকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে এবং শিল্পীদের ভালো অঙ্কের টাকা আয় করানোর উদ্দেশ্যে চালু হয়েছে। পুরান ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গার বেশ কয়েকজন শিল্পী এতে কাজ করছেন। জনপ্রিয়তার অতটা তুঙ্গে না হলেও এটি রিকশা আর্টের জন্য বহির্দেশের সাথে সাথে দেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠার একটি আশাস্বরূপ।
শিল্প বেঁচে থাকুক, পথে-ঘাটে চলতে চলতে পুনরায় বেঁচে উঠুক রঙে রাঙানো রিকশা আর্টও।
তথ্য ও ছবি উৎস
১. newspapers71.com/450169/তিন%20চাকার%20চিত্রকর
২. en.wikipedia.org/wiki/Rickshaw_art_in_Bangladesh#Background
৩. rickshaw-paint.net/artist/
৪. kathmanduandbeyond.com/rickshaw-art-bangladesh/kushtia-bangladesh-3/
৫. kathmanduandbeyond.com/rickshaw-art-bangladesh/