পানি মানেই অপার সম্ভাবনা। মহাশূন্যে একের পর এক অভিযান পাঠানো হচ্ছে। তল্লাশি চলছে গ্রহ থেকে গ্রহে। মিলে গেলেই পাতাতাড়ি গুটিয়ে নোঙর করবে মানব সভ্যতা। পানি মানেই অনন্ত রহস্য। অবশ্য বিজ্ঞান যথারীতি হাউড্রোজেন আর অক্সিজেনের ২:১ আনুপাতিক মিশ্রণ নিয়ে হিসাবে কষবে। কিন্তু ধর্ম দেখে আরো বড় কিছু। মানব অস্তিত্বের পরম অর্থ।
পানি সমস্ত সৃষ্টির ভিত্তি। সকল সংস্কৃতিতেই সৃষ্টির শুরুর সাথে কোনো না কোনোভাবে পানি জড়িত। কোনোকিছু পানিতে মিশে যাওয়ার অর্থ আদিম অবস্থায় ফিরে যাওয়া। প্রতিবার পানির সাথে যোগাযোগ তাই যেন নতুন জন্ম। কখনো জীবের প্রাণদায়ী, কখনো আরোগ্যকারী কিংবা কখনো অমরত্ব দানকারী অমৃত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে পানি। নব্যপ্রস্তর যুগ এবং মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শনে পানিকে লেখা হতো /// এই সংকেত দিয়ে। পানি আর চাঁদের সংকেতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতো উর্বরতা। সুমেরিয় সভ্যতা পানি বলতে মাঝে মাঝে শুক্রাণুকে ইঙ্গিত করেছে। মেসোপটেমিয়ায় উর্বরতাকে প্রকাশ করতে চিত্রিত হয়েছে পানির মধ্যে মাছ।
সৃষ্টিতত্ত্ব
অস্তিত্বের সকল অবস্থাতেই পানি জীবনের উৎস ও বৃদ্ধির নিয়ামক। ভারতীয় পুরাণ মতে, আদিম পানির উপরে ভাসমান ছিলেন নারায়ণ। নাভি থেকে বেড়ে উঠে মহাজাগতিক পদ্ম। তার কেন্দ্রেই জন্ম নেন খোদ ব্রহ্মা। বর্ণনাভেদে আখ্যানের তারতম্য দেখা যায়; কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই পানি উপস্থিত। এই আদিম পানি প্রতিকায়িত করে সৃষ্টিপূর্ব নীরবতা। নারায়ণের নাভি সেখানে মহাবিশ্বের কেন্দ্র, যেখান থেকে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু। (মহাবিশ্বের কেন্দ্রধারণা নিয়ে পড়ুন এখানে।)
ব্যবিলনের সৃষ্টিতত্ত্ব আদিম বিশৃঙ্খলা অর্থে পানির বর্ণনা দিয়েছে। সেখানে দেবতা আপসু মিঠা পানি এবং তিয়ামাত লোনা পানির ব্যক্তিরূপ। মিশরীয় পুরাণে আদিম পানির বর্ণনা দেয়া হয়েছে নু নামে। অসীম পানি নু থেকেই জন্ম লাভ করেন আদিদেবতা আতুম বা রা। বাংলাদেশের গারো উপকথায় সৃষ্টি প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে পানির নিচ থেকে মাটি উত্তলনের প্রসঙ্গ আছে। আবার নর্স পুরাণ অনুসারে, মিদগার্দ বা মানুষের জগৎকে পরিবেষ্টন করে আছে সমুদ্র। একটু ভিন্ন হলেও বাইবেলের জেনেসিস থেকে উদ্ধৃত করা যায় এই প্রসঙ্গে।
“শুরুতে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। প্রথমে পৃথিবী সম্পূর্ণ ছিল শূন্য; কিছুই ছিল না। কেবল অন্ধকারে আবৃত জলরাশি আর সেই জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল ঈশ্বরের আত্মা।” (বাইবেল- আদিপুস্তক-১:১)
পানিতে পবিত্রতা
পানিতে ডুব দেয়ার অর্থ সত্তার সমস্তটা দ্রবীভূত করে ফেলা। অতীত জীবনকে থামিয়ে দেয়া। সামাজিক বন্ধন, পুরোনো পাপ এবং ব্যক্তিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মৃত্যুবরণ। পানি থেকে পুনরায় উঠা মানে নতুন করে জন্মলাভ। নবজাতকের মতো প্রকৃত এবং কালিমামুক্ত জীবনের সূচনা। যেমনটা এযেকিয়েলতে লেখা আছে, “আমি তোমার প্রতি পানি অবতীর্ণ করবো; তুমি পাপমুক্ত হবে।” জরাথুস্ত্রবাদের ইয়াসনাতে পানিকে বলা হয়েছে “যা নারী ও পুরুষকে পবিত্র করে।” (ইয়াসনা- ৬৫)
গোসল মানুষকে অপরাধ থেকে মুক্ত রাখে। সংরক্ষণ করে মানসিক অবক্ষয় এবং শারিরীক রোগব্যাধি থেকে। এজন্যই প্রতিটি ধর্মের আচারাদির আগে পানি দিয়ে পবিত্র হতে হয়। অর্থাৎ ঈশ্বরের কর্মে নিযুক্ত হবার আগে কিংবা ঈশ্বরের ঘরে প্রবেশের আগে মানুষকে ঐশ্বরিক হতে হয় পানি দ্বারা। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে উর্বরতার দেবীদের উদ্দেশ্যে পানিতে আচার পালন করতে দেখা যায়। তাতে ফসলে আধিক্য আসবে বলে বিশ্বাস। ফ্রিজিয়ান দেবী সিবেলের গোসল পালন করা হয় ২৭শে মার্চ। খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতকে ক্যালিমেকাসের বর্ণনায় দেবী এথেনার আচারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ক্রিট এবং ফিনিশীয় সভ্যতায় দেবীদের জন্য এই আচার ছিল খুবই প্রচলিত।
বাপ্টিজম
পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনকে খ্রিষ্টধর্ম আরো ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। জন দ্য বাপ্টিস্ট মানুষকে পানি দ্বারা পবিত্র করতেন। আত্মাকে মুক্ত করতেন পুরাতন জীবন থেকে। তার ভাষ্য ছিল, “আমি তোমাদের পানি দিয়ে পরিশুদ্ধ করবো; কিন্তু শীঘ্রই আমার চেয়ে মহান কেউ আসছেন। তিনি তোমাদের পরিশুদ্ধ করবেন স্বর্গীয় আত্মা আর আগুন দ্বারা।” একইভাবে ইহুদি এবং স্যাবাইনদের মধ্যেও আছে পানির ব্যবহার।
ব্যাপ্টাইজের রূপক অর্থ মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হওয়া। খ্রিষ্টিয় বিশ্বাস অনুসারে যীশু খ্রিষ্ট জেরুজালেমে ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের পর পুনরুত্থিত হয়েছেন। বাপ্টিজমের তর্জমা তফসির করতে পরবর্তী খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব সামনে এনেছে নতুন মাত্রা। রচিত হয়েছে অজস্র গ্রন্থ। বেশিরভাগেই পানির পবিত্র করার ক্ষমতায় নতুন জীবন প্রাপ্তির ধারণা প্রোথিত। টারটুলিয়ানের দাবি অনুযায়ী,
“সৃষ্টির প্রথম পাটাতন পানি। হতে পারে ভিন্ন উপাদান দিয়ে গঠিত। কিন্তু পানি যদি না থাকতো; এদের কোনো তাৎপর্য থাকতো না। যে পানি ইহজীবন দিচ্ছে; তা স্বর্গীয় জীবনের জন্যও চাবির মতো।”
পানির দেবত্ব
প্রাচীন গ্রীসে নদী ও লেককে কেন্দ্র করে পূজা-অর্চনা প্রচলিত ছিল। পসানিয়াসের বর্ণনায় সে রকম একটি স্থান আর্কেডিয়ার লাইকাইয়স পর্বতের পাশে। দেবতা লাইকায়স প্রবল খরায় আগমন করেন আশির্বাদ হয়ে, তারপর বৃষ্টি নামান। ধূসর পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠে নতুন বসন্তে। মহাকবি হোমারের লেখায় দেখা যায় পানিতে জীবিত ঘোড়া উৎসর্গ করার নজির। কাজটা পসাইডন এবং অন্যান্য সমুদ্র দেবতাদের সন্তুষ্টি ও সমর্থন পাবার জন্য। হেসিয়োড অবশ্য যেকোনো নদী পার হবার সময়েই এই উৎসর্গের কথা বলেছেন। হেলেনিক নদী দেবতারা অনেকটাই ষাড়ের আকৃতিতে উপস্থাপিত হতেন; তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একেলোয়াস। প্রবাহিত পানি আর ঝর্ণার জন্য ছিল জলপরীর ধারণা। নার্সিসাসের আখ্যান এবং ওডিসিয়াসের অভিযাত্রায় দেখা মেলে সেই সব জলপরীদের।
নর্স মিথোলজিতে সমুদ্রের দেবতা এগির। তার স্ত্রী রেন গোটা সমুদ্রের উপর জাল বিছিয়ে রাখেন। ডুবে মরা মানুষেরা তার কাছে যায়। পানিতে নিক্ষেপ করা মানে তার কাছে উৎসর্গ করা। এগির এবং রেনের নয় কন্যা মূলত সমুদ্রের নয়টা অবস্থাকে প্রকাশ করে। পানিকে জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে উপকথা প্রচলিত আছে ইন্দো-ইউরোপীয় অন্যান্য ঐতিহ্যেও। ভারতীয় বিশ্বাসে নদী গঙ্গা পাপ মোছনকারী বলে স্বীকৃত।
জলজ সত্তা
সমুদ্রের তলদেশে থাকে, সেই বিশ্বাসের কারণেই মাছ, সাপ, ড্রাগন এবং ডলফিন বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন বলে প্রতিকায়িত হয়েছে। পানি, বৃষ্টি, বন্যা এবং আর্দ্রতার সাথে যুক্ত থেকে তারা পৃথিবীকে উর্বর করে তোলে। ড্রাগন মেঘের মধ্যে বসবাস করে। প্রাচীন চীনা লেখালেখিতে আকাশে বিদ্যুৎ চমক আর বৃষ্টির সাথে ড্রাগন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। চুয়াং জুর মতে, ড্রাগন এবং সাপ নির্দেশ করে ছন্দময় জীবনকে।
রাজ্যে কোনোপ্রকার বিশৃঙ্খলা কিংবা দুর্যোগে নিপতিত হলে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সেই গুণাবলি রাজার আছে বলেই তিনি রাজা। এইজন্যই প্রাচীন চীনে সম্রাটদের পাশে ড্রাগন উৎকীর্ণ করা হতো। প্রশ্ন হতে পারে চীনা পুরাণে ড্রাগন আকাশকেন্দ্রিক হলো কেন? তার কারণ চৈনিক সংস্কৃতির বড় অংশ তখন নদী থেকে দূরে অবস্থিত। উর্বরতার ভার প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতো মেঘ। যাহোক, ড্রাগনের মিথ প্রচলিত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও।
প্রাচীন ভারতে পল্লভ বংশের কোনো এক পূর্বপুরুষ নাগিন বিয়ে করেছিল বলে প্রচলিত। ছোট নাগপুরের রাজারা পুণ্ডরিক নামে নাগের বংশধর। বস্তুত উপমহাদেশে প্রচলিত সাপ সংক্রান্ত বিশ্বাস আর আচারে কোনো না কোনোভাবে পানি যুক্ত। ঋষি অগস্ত্যের জন্মকথায় পানির তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার জন্যই আরেক নাম পীতাব্দি। মহাভারত অনুসারে, রাজা শান্তনুকে বিয়ে করে দেবী গঙ্গা নদীসত্তা ছেড়ে উঠেই পৃথিবীতে বসুগণের মা হিসাবে আগমণ করেন।
মহাপ্লাবন
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ধর্মেই মহাপ্লাবনের আখ্যান প্রচলিত। (মহাপ্লাবন নিয়ে পড়তে ক্লিক করুন এখানে) যাহোক, মহাপ্লাবনের কাহিনী তুলে ধরে মানবজাতিকে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া। গোটা ইহলৌকিক ব্যবস্থা, সৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে পুনরায় সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার শুরু। চাঁদ যেমন ক্ষয় এবং বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। এইজন্যই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বসবাস করা গোত্রগুলো নিজেদের মহাপ্লাবন পরবর্তী বংশধর বলে মনে করে।
পানি সৃষ্টিপূর্ব আদিম অবস্থা। সুতরাং মহাপ্লাবনে সমস্ত সৃষ্টি পানিতে ডুবে যাওয়ার অর্থ সৃষ্টির আদিমে পৌছানো। বেশিরভাগ উপকথাতেই মহাপ্লাবন হয়েছে মানবজাতির পাপের কারণে। পৃথিবী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে। প্লাবন সেই পাপ ধুয়ে মুছে দিয়ে প্রস্তুত করে নতুন বাসযোগ্য পৃথিবী। উতনা পিশতিম, জিশুদ্র, আত্রাহাসিস এবং নোয়াহ তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
সুধা সঞ্জীবনী
সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতাকে ছাপিয়ে পানি এবার পরম বিস্ময়। সমস্ত রোগ থেকে মুক্ত করে, যৌবনকে স্থায়ী করে, প্রতিহত করে মৃত্যুকে। বিভিন্ন উপকথায় এই সঞ্জীবনী সুধার অবস্থান দেখানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। অবশ্যই তা সকলের জন্য না। ভারতীয় উপকথায় সমুদ্র মন্থন করে দেবতাদের অমৃত পানের ঘটনা মোটামুটি সকলের জানা। বিশেষ নদী এবং ঝর্ণা এভাবে বিশেষ অবস্থান তৈরি করেছে বিশ্বাসে। ‘ফাউন্টেইন অব ইয়ুথ’-এই উপকথায় ভর করে আধুনিক সময়েও নির্মিত হয়েছে বহু গল্প-সিনেমার প্লট।
পানি অমৃতের রূপে দান করে জীবন, শক্তি এবং অমরত্ব। বিভিন্ন বিশ্বাসে যে স্বর্গের ছবি অঙ্কন করা হয়েছে; তাতে রাখা হয়েছে এই সঞ্জীবনী সুধা। গিলগামেশ, আলেকজান্ডার, পন্স ডি লেয়ন- কে বুঁদ হয়নি সেই চিরযৌবনের সুধার খোঁজে? এখন অব্দি ভারত এবং ফ্রান্সের কিছু অঞ্চলে রোগ নিরাময়কারী নদী এবং ঝর্ণার কথা বিশ্বাস করা হয়।
অবশেষ
সেই হিসাবে দেখলে মানব অস্তিত্ব ভঙুর। দফায় দফায় মেরামত করতে হয়। গড়ে তুলতে হয় নয়া পরিস্থিতিতে নয়া অস্তিত্ব। পুনর্গঠনের সেই কাজটা করে দেয় পানি। মানুষ পাপে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে, সমস্ত সম্ভাব্যতা, জীবন আর মানবতা ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ফেরার পথ অবরুদ্ধ হয় না। পানি তাকে দেয় নতুন করে পবিত্র হবার সুযোগ; সুযোগ নতুন করে জন্মাবার।
পানির তাই কেবল বৈজ্ঞানিক উপাদান না; এক আধ্যাত্মিক অবলম্বন। ধার্মিকের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে জড়িত ওতোপ্রোতভাবে। আজ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে হয়তো উপকথাকে অবজ্ঞা করা যাবে। কিন্তু এটাও সত্য, হাজার বছর ধরে এইসব বিশ্বাসই মানুষকে পানির কাছে রেখেছে। মুক্ত রেখেছে শারিরীক আর মানসিক অপবিত্রতা থেকে। তৈরি করেছে শক্ত এবং বাসযোগ্য সমাজব্যবস্থার সিঁড়ি। যাতে পা দিয়ে ভবিষ্যতের উত্থান।