খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আর্য জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। স্থানীয় নগরসভ্যতাকে পরাজিত করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঋগ্বেদের সূক্তগুলোতে এই সংঘর্ষের ছায়াপাত আছে। অনার্যদের অনেকেই ভয়ে, ভক্তিতে কিংবা লোভে আর্যদের হয়ে কাজ করেছিল। লঙ্কাযুদ্ধে রামের পক্ষের বানর সেনা, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব- সবাই দেশীয় মানুষ। যাহোক, ভারতে প্রবেশের পর থেকে কয়েক শতকব্যাপী চলে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক জিজ্ঞাসার আকরগ্রন্থ বেদ গঠনের কাজ। সেই সুদীর্ঘ সময় ভারতীয় ইতিহাসে বৈদিক যুগ বলে পরিচিত।
প্রাক আর্য যুগের সিন্ধু সভ্যতা ছিলো কৃষিপ্রধান। স্বভাবতই কৃষিপ্রধান সভ্যতা মাতৃপ্রধান হবে। অন্যদিকে আর্যদের প্রধান বৃত্তি পশুপালন। পশুর মধ্যে আবার গরু অন্যতম। শিকার ও পশুপালনের খাতিরে গড়ে ওঠা গোত্রতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হয়। উত্তরাধিকার অনুযায়ী উভয় সংস্কৃতিতে সংঘর্ষ ছিল স্বাভাবিক। গঙ্গা নদীর নাম বেদ সংহিতার একেবারে শেষের দিকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ আর্যরা অনার্যদের বিতাড়িত করে ক্রমেই পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছে। তাছাড়া অথর্ববেদ ছাড়া কোথাও ধানের আলোচনা নেই; আছে যবের আলাপ। এভাবে তাকালে এক নয়া বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়; যার প্রধান দলিল বেদ নিজে।
জাতিভেদ
যে জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আজ ভারতবর্ষ ব্যাকুল; বৈদিক যুগের শুরুতে তার সৃষ্টি হয় নি। আর্য বনাম অনার্য সংঘর্ষের শেষে পরাজিত অনার্যরা আর্যদের দাসে কিংবা পালিয়ে দস্যুতে পরিণত হয়। দস্যু বলার কারণ, তারা সময় আর সুযোগ পেলেই হারানো সম্পদ অধিকারের জন্য চেষ্টা চালাতো। ফলে তখন অব্দি কেবল দুটো জাত ছিলো- আর্য এবং অনার্য।
পরবর্তীতে জ্ঞানতাত্তিক বিকাশের সূচনা ঘটলো। তৈরি হলো একটা শিক্ষিত শ্রেণী। লেখার চর্চা না থাকায় শিক্ষা বলতে মুখে বর্ণিত জ্ঞানকেই নির্দেশ করা হতো। এজন্যই বেদের আরেক নাম শ্রুতি। বেদের গঠন, শিক্ষা এবং চর্চায় একটা অংশ নিজেদের ব্যাপৃত করে। ক্রমে কর্মকাণ্ডের চেয়ে জ্ঞানকাণ্ড জনপ্রিয় হতে থাকে; আর আধিপত্য বাড়তে থাকে সেই শিক্ষিত শ্রেণীর। এরাই পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত হয়। বেদের পঠন পাঠন এবং চর্চাকে তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখে। এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় শাসক শ্রেণী। কারণ শাসকের পার্থিব শক্তির সাথে ধর্মীয় বৈধতা যোগ করতে পারা তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রাহ্মণরা সেই যোগ করার ক্ষমতা ধারণ করতে সক্ষম। ফলে সেই শাসক আর বীরদের নিয়ে গঠিত হয় সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণী ক্ষত্রিয়।
বিদ্যান ব্রাহ্মণ আর বীরত্বপূর্ণ রাজশক্তি মিলে সমাজের অল্প অংশই; অধিকাংশ এই চক্রের বাইরে। তারা জ্ঞানচর্চাতেও নেই, নেই রাজশক্তিতেও। তারা বণিক, শ্রমিক এবং কৃষক। বসবাস করতো সমাজের নিচতলায়। সেখানে না ছিলো স্বীকৃতি আর না উঠে দাঁড়াবার শক্তি। তবে তারাই সেই সমাজব্যবস্থার আর্থিক বুনিয়াদের আদি ভিত্তি। তাদের নাম হয় বৈশ্য। এভাবে কেবল আর্য অংশই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অনার্যরা ততদিনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে শূদ্র হিসেবে। আগে ব্রাহ্মণ নির্ধারিত হতো কর্মের দ্বারা। পরবর্তীতে তা বংশীয় পদবীতে গিয়ে ঠেকে। অনুরূপ বাকি শ্রেণীগুলো জন্মের নিয়ামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলেও বংশীয় তকমা হয়েছে পরবর্তীতে।
রাজতন্ত্র
আর্যরা যাযাবর থাকলেও স্থানীয় নগরসভ্যতার সংস্কৃতিকে রপ্ত করে ভালোভাবেই। গড়ে ওঠে গ্রাম ও শহর। ঋগ্বেদে সুশাসক নগরপতির উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগে যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল; তার ভালো প্রমাণ পাওয়া যায় বেদে। ঋগ্বেদে রাজার উদ্দেশ্যে রচিত দুটি সূক্ত ১০/১৭৩ এবং ১০/১৭৪। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজা নির্বাচিত হতেন। তবে পুরুষানুক্রমে যে রাজারা রাজত্ব করে গেছেন, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ৭/৮ সূক্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। দেবযান নামে এক রাজার কথা বলা হয়েছে, যার পুত্র দিবোদাস এবং নাতি সুদাস রাজা ছিলেন। নহুশ নামে আরো এক রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় ৭/৬/৫ তে। তিনি করও গ্রহণ করতেন। নহুশের পুত্র যযাতিও রাজা ছিলেন।
প্রাচীন গোত্রতান্ত্রিক সমাজ পরিচালিত হতো পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। ছোট ছোট গোষ্ঠীর জন্য নির্বাচিত হতো সর্দার ও মোড়ল। উচ্চতর সংগঠনের শাসন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব পড়তো সভার উপর। বেদে বিভিন্নভাবে এই সভার প্রসঙ্গ এসেছে। আসলে অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে ট্রাইবগুলো যতই যুদ্ধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে; ততই বিলুপ্ত হয়েছে ট্রাইবাল গণতন্ত্র। তারই ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে রাজশক্তি। প্রাধান্য পেয়েছে যুদ্ধের দেবতা ইন্দ্র। রাজশক্তির উত্থানের সেই চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় মহাভারতে।
ধর্মের প্রভাব
সেই যুগে গৃহপালিত পশু, ঐশ্বর্য, বীর পুরুষ, দীর্ঘ জীবন, প্রভূত; শষ্য প্রভৃতির জন্য ঋষিগণ দেবতার নিকট মন্ত্রের মাধ্যমে প্রার্থনা করতেন। দেবতা আর মানুষের সম্পর্ক ছিলো সরল। বৈদিক ধর্ম স্বভাবত যজ্ঞনিষ্ঠ। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজা ও দেবতার মধ্যে সংযোগকারী হিসাবে আবির্ভূত হতেন। অনিবার্য যুদ্ধাদির ঘোষণা ও বিজয় প্রার্থনার উপর নির্ভর করতো বলেই বিশ্বাস ছিলো। ফলে পুরোহিতগণ কেবল ধর্মের কেন্দ্রেই ছিলেন না; ছিলেন রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে।
ঋগ্বেদের দেবদেবীদের পুজায় যখন কোনো দেবতার স্তুতি করা হয়; তখন তাকে ক্ষুদ্র বা সসীম শক্তি সম্পন্ন দেবতা হিসাবে স্তুতি করা হয় না। করা হয় সর্বশক্তিমান পরমেশ্বররূপে। এই বৈশিষ্ট্যটা আলোচনার দাবি রাখে। প্রাচীন গ্রীসে দেবতাগণকে ক্ষুদ্র শক্তিসম্পন্ন সসীম ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করা হতো। পরমেশ্বর বা মহাসত্তার রূপে কল্পনা করা হয়নি। এজন্য গ্রীসের দেবতাবাদকে Polytheism বা বহুদেবতাবাদ বলা হয়। যেমন, জিউস গ্রীসের দেবরাজ হিসাবে পরিগণিত। অথচ পৃথক পৃথক দেবতার ব্যক্তিসত্তা অতিক্রমকারী কোনো সর্বব্যাপী পরমসত্তার ধারণা পাওয়া যায় না। বেদের আলোচনায় এইটা বিদ্যমান। ম্যাক্সমুলার এই বৈশিষ্ট্যকে Henotheism বলে আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ যখন যে দেবতার উপাসনা করা হয়; পরমেশ্বর রূপেই হয়। যেমনটা বলা হয়েছে,
একং সৎবিপ্রা বহুধা বদন্তি
অগ্নিং যম মাতারিশ্বানমাহু
অর্থাৎ এক পরম সত্তাকে বিপ্রগণ অগ্নি, যম, মাতরিশ্বা ইত্যাদি বিবিধ নামে অভিহিত করে থাকেন।
বেদের এই দেবতাবাদ বৈদিক ধর্ম ও দর্শনের একত্ববাদের মূল উৎস। আদি স্তরের আর্যগণ প্রকৃতির বিভিন্ন সৌন্দর্য ও শক্তিতে দেবত্ব কল্পনা করেছে। পরবর্তীতে সেই সামগ্রিক চিন্তা মিলিত হয়েছে একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে। অত প্রাচীনকালে ঋষিদের চিন্তা-চেতনার অগ্রগতি বিস্ময়কর।
জীবিকা
বৈদিক যুগের আর্যগণের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিলো গো-পালন এবং কৃষি কাজ। বেদের বিখ্যাত ‘অক্ষ’ সূক্তে দ্যুত ক্রীড়ার নিন্দা এবং কৃষি কাজের প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পাশা খেলো না, কৃষিকাজ করো। কৃষি কাজে বহু সম্মান ও বিত্তলাভ করবে।’ আবার, চারণ ভূমিতে বাঘের খুব উৎপাত হতো। সুতরাং দেবতার কাছে ঋষির প্রার্থনা দেখা যায়, গোধন যেন বাঘের দ্বারা নিহত না হয়। কুপপ্রপাত দ্বারা যেন বিনষ্ট না হয়।
বৈদিক যুগে ছিল প্রচুর বনাঞ্চল। বাঘসহ অন্যান্য হিংস্র জীবজন্তুর মাধ্যমে আক্রমণ তাই নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। গাভী বা বাছুরের গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যাবার সমস্যা তো আছেই। ঋষিরা তাই প্রার্থনা করতেন, দুগ্ধবতী গাভীসমূহ যেন বৎস থেকে পৃথক হয়ে অগম্য স্থানে চলে না যায়। আর্যরা শষ্য উৎপদনের প্রণালিও শিখে ফেলেছিল। ব্যবস্থা ছিলো কৃত্রিম জলসেচের। বেদে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম- উভয় প্রকার জলসেচের কথা আছে। যেমন,
‘যা আপো দিব্য উতবাস্রবন্তি
খানিত্রিমা উতবা যাঃ স্বয়ংজাঃ।
সমুদ্রার্থা যাঃ শুচয়ঃ পাবপস্তা
আপো দেবীরিহ সামবস্তু।।
উপর্যুক্ত মন্ত্রে খনিত্রিমা বলতে কৃত্রিম জলসেচ এবং স্বয়ংজা শব্দে প্রাকৃতিক জলসেচকে বোঝানো হয়েছে।
শিল্প
বৈদিক যুগে স্বর্ণের প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ ছিল। সাধারণ মানুষও স্বর্ণের অলঙ্কার পড়তো। রাজা মাহরাজাগণ নিজের সিংহাসন থেকে রথ অব্দি সোনা দিয়ে তৈরি করতেন। সোনা দিয়ে সজ্জিত হতো দেবতাদের মন্দির। যেহেতু মানুষের অন্যতম পেশা হিসাবে পশুপালন প্রতিষ্ঠিত; পশুর চামড়াও ব্যবহৃত হয়েছে নানা কাজে। চর্মশিল্প ছিলো অনেকেরেই জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। ছিল দড়ি আর সুতার ব্যবহার। অন্যদিকে বৈদিক যুগের শুরুই ছিলো নৃতাত্ত্বিক যুগবিভাগের লৌহযুগের সূচনা। সেখান থেকেই মানুষ শিখেছে লোহার ব্যবহার। নানা রকম যুদ্ধাস্ত্র কিংবা আসবাব নির্মাণে লোহার ভূমিকা ছিল ব্যাপক।
আর্যরা উন্নতমানের জলযান, বিশেষ করে সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক মন্ত্রে। ১০/১৪৩/৪৫ মন্ত্রে সামগ্রিকভাবে জাহাজের কথা আছে। বড় আকারের সামুদ্রিক নৌকাকে বলা হতো সৈরাবতী নৌ। যুদ্ধমুখী জাতি হিসাবে প্রায়শ তাদের লিপ্ত হতে হতো যুদ্ধে। ফলে লোহা, স্বর্ণ ও পাথরের বহু অস্রের নজির মেলে। ইন্দ্রের এক হাজার ক্ষুরযুক্ত বজ্রের বর্ণনা আছে। আছে কুঠার ও ধনুক তৈরির আলোচনা।
সেকালে প্রধান যানবাহন ছিলো রথ। বর্তমানে যা ঘোড়ার গাড়ি নামে পরিচিত; রথ তার আদিপুরুষ। যুদ্ধযাত্রা থেকে দৈনন্দিন ব্যবহারে রথ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাহন হিসাবে ঘোড়া, খচ্চর, গরু কিংবা গাধা যোগ্য হলেও ঘোড়াকে গ্রহণ করা হতো উত্তম হিসাবে। রথ তৈরি তাই সেকালে সম্মানজনক পেশাতে পরিণত হয়েছিল। সুনির্মিত রথের বর্ণনা রিগ্বেদের নানা মন্ত্রে উদ্ধৃত আছে।
খাদ্য ও পানীয়
সেকালের খাদ্য আর পানীয় নিয়ে ঋগ্বেদ হতে বেশ তথ্য পাওয়া যায়। ৫/৮৫/৩ সূক্তে যবের কথা উল্লেখ আছে। বেদের প্রথম দিকে ধানের কথা না থাকলেও শেষ দিকে অথর্ববেদে উল্লেখিত হয়েছে। খাদ্য হিসেবে মাংশের বহুল প্রচলন ছিলো। বৃষের মাংস, মহিষের মাংস কিংবা অজের মাংস খাওয়া হতো ১/১৬২/৩)। শতপথ ব্রাহ্মণে ষাঁড়, পুং ছাগল কিংবা বন্ধ্যা গাভী বলি দেবার কথা এসেছে। গরুর দুধ এবং তা থেকে উৎপন্ন ঘি ছিল প্রিয় তালিকায়। ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেছেন, ‘অশ্নামি প্রবামহমংসলং চেৎভবতি ’ অর্থাৎ গোমাংশ যদি কোমল হয়; তবে এনে ভোজন করবো।’ ৩/২/২১
পানীয়দের মধ্যে মধু, সুরা ও সোমরস ছিলো প্রধান। শৌণ্ডিক যখন ছিলেন, তখন সুরার ব্যবহারও ছিল। তবে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে সোমরসের প্রশংসা এবং সুরার নিন্দা করা হয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। সোমলতার রস ঘিয়ের মতোই দেবতাদের প্রিয় পানীয় বলে স্বীকৃত। তাই একটা সমগ্র অধ্যায়েই দেখি সোমের প্রশস্তিতে ভরা। সোম শুধু উত্তেজক না, তা আয়ু বর্ধন করে এমন ধারণা ছিলো (৮/৪৮/১১)। অথচ সরস্বতীর নদীর মতোই তা অন্তর্হিত হয়ে গেছে। এত প্রিয় লতা কীভাবে হারিয়ে গেলো, বোঝা যায় না।
শিক্ষাব্যবস্থা
তৎকালীন সমাজে পুরুষ সন্তানের বাল্যকাল কেটে কৈশোরে পদার্পণ করলেই উপনয়ন হতো। উপনয়ন হলো গুরুর গৃহে যাবার প্রস্তুতি। মায়ের গর্ভে সন্তানের প্রথম জন্ম; দ্বিতীয় জন্ম এই উপনয়ন। ফলে উপনয়ন পরবর্তী পুরুষ সন্তানদের নাম হতো দ্বিজ বা দ্বিতীয় জন্মলাভকারী ব্যক্তি। উপনয়ন দীক্ষার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা শতপথ ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীর বেদ পাঠে অধিকার জন্মাতো।
বিদ্যার্থীকে বিনয় আর কুণ্ঠার সাথে শিক্ষকের সামনে উপস্থিত হতে হতো। চলতো বেদ পাঠ ও আনুষঙ্গিক নিয়ম নীতির শিক্ষা। শিক্ষার্থীকে কেন ভিক্ষা করতে হতো, তা নিয়ে শতপথ ব্রাহ্মণে একটা ব্যাখ্যা আছে। এতে করে ভেতর থেকে লজ্জা আর অহংকার সরে গিয়ে বিনয়ের ভাব জন্মায়। প্রথমেই যেন নিরাশ হয়ে ফিরতে না হয়; তার জন্য সর্বপ্রথম আচার্যপত্নী এবং নিজের মায়ের কাছে ভিক্ষা চাইতে হয়। বেদের ছাত্রদের ভিক্ষা সংগ্রহ চলতো মূলত অনার্যপাড়ায়। সাধারণত দেবরোষে পড়ার ভয়ে কেউ ভিক্ষা দিতে অস্বীকার করতো না।
বৈদিক যুগে গোটা শিক্ষাজীবনই গুরুগৃহে কাটাতে হতো। এই মেয়াদ কখনো বারো বছর অব্দি। পঠিত হতো সাহিত্য, ব্যাকরণ, ধর্মীয় আচারাদি, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ এবং বেদাঙ্গ। অবশ্য পরবর্তীতে আরো বিষয় সংযুক্ত হয়। শিক্ষাজীবন শেষে সমিধ বা বিশেষ প্রক্রিয়ায় গঙ্গাস্নান করতে হতো। স্নান শেষ করে গৃহে ফিরে আসা বিদ্যার্থীকে বলা হতো স্নাতক। আর শিক্ষা শেষে ঘরে ফিরে আসাকে বলতো সমাবর্তন। আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং সমাবর্তন শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়।
আমোদ-প্রমোদ
আধুনিক যুগের মতো তখন খেলাধুলার এত প্রচলন ছিলো না। তথাপি ঘোড়া দৌড় এবং রথ চালনা চলতো। পাশা খেলা ছিল অন্যতম ঘরোয়া খেলা হিসাবে পরিচিত। পাশা কতটা সর্বনাশা ছিলো; তা প্রমাণিত হয় মহাভারতে যুদ্ধিষ্ঠিরের সব হারানোর আখ্যানে।
আর্য যুগে ললিত কলার প্রচলন ছিলো। সোমরস নিষ্কাশনের সময় পুরোহিতরা গানযুক্ত মন্ত্র উচ্চারণ করতো। ঋক সংহিতায় ঠাণ্ডা, কর্করি, দুন্দভি, শততন্ত্রী, বান, বংশী প্রভৃতি নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে। বীণা ও বান- দুটি তার যুক্ত বাদ্য যন্ত্র। বান বাজানোকে মনে করা হতো কুশলী বাদ্যকারের কাজ। সাধারণ নাচের সময় বাজানো হতো আখটি করতাল। পিচোলা ও ঔদুস্বরী নামক দুই প্রকারের বীণার দেখা মেলে সেই সময়ে।
সংহিতার কয়েকটি মন্ত্রে নাচের কথা আছে। সাধারণত বাঁশদণ্ড নিয়ে নাচের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অনুরূপ নাচ প্রচলিত। বাঁশের লাঠির শব্দ ও নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের সাথে পা ফেলে সাওতাল মেয়েরা আজও নাচে। ঋক সংহিতার সংবাদ সূক্তগুলো নাটকের উৎসস্বরূপ।
শেষের আগে
আজকের দিনের মতো সেই সময়েও অপরাধ প্রবণতা ছিল। সমাজে সাধু লোক যেমন থাকে অসাধুও থাকে। ঋক সংহিতায় ডাকাত, চোর, মদ্যপায়ী, দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত ব্যক্তির উল্লেখ আছে। তারা যে সমাজে নিষিদ্ধ, তারও আলোচনা আছে। আর্য সমাজে দত্তক ব্যবস্থাও ছিল। তবে অধিকাংশ দত্তক পুত্র বড় হয়ে নিজের পিতা মাতাকে ছেড়ে চলে যেত। ফলে এই প্রথা খুব একটা সুখকর ছিল না। সমাজে ছিল স্বার্থান্ধ আর উদার ব্যক্তিও।
যাযাবর আর্যদের জীবনযাত্রা বিচিত্র। স্থায়ী সভ্যতাকে পরাজিত করে তার উপর কেবল নিজেদের আধিপত্যের পতাকা ওড়ায়নি। নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে বদলে নিয়েছে ধর্মচিন্তা, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির স্রোত। নতুন সমাজ ব্যবস্থায় অনার্যদের অবস্থা বোঝাতে সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ মহাভারতে বিবৃত একলব্যের পরিণতি। উপরন্তু খোদ আর্যরাই ভাগ হয়ে গিয়েছিল কয়েকটি ধারায়। সময় আর স্বার্থান্বেষীর খপ্পরে পড়ে দানা বেধেছে অনেক কুসংস্কার। তথাপি সমস্ত বৈচিত্র্য নিয়েও সত্য; শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই ভূমিকে তারা নিজের করে নিয়েছে।