দীপক রাগে যদিবা বহ্নিশিখা ছড়িয়েও পড়তো, মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি আনতেও ভুলতেন না তিনি। বিভিন্ন ‘রাগ’ এর ওপর তার ছিলো অদ্ভুত এক নিয়ন্ত্রণ, সঙ্গীতশিল্প যেন নিজেকে সঁপে দিয়েছিলো সঠিক নিয়ন্ত্রকের হাতেই। হ্যাঁ, এই নিয়ন্ত্রকই হচ্ছেন তানসেন, সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের একজন। তানসেন রত্ন হয়ে সুশোভিত নয়, সুরারোপিত করে রেখেছিলেন সভাকে। উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তানসেন ছিলেন এক অতুলনীয় মহারথী।
যে নামে তিনি চিরবিখ্যাত, সে নাম কিন্তু প্রথম থেকে ছিলো না। কিছু নামের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পেয়েছি সঙ্গীতজগতে আজ পর্যন্ত রয়ে যাওয়া সেই নাম ‘তানসেন’।
তানসেনের বাবা ছিলেন একজন কবি, কবি মুকুন্দ মিশ্র। তিনি ছেলের নাম রাখেন রামতনু মিশ্র, মতান্তরে তনু মিশ্র। ছোটবেলায় এ নামেই মানুষ তাকে ডাকতো।
সঙ্গীত দিয়ে তিনি নাকি আন্দোলন জাগাতেন বৃক্ষ ও পাথরে, এই সঙ্গীতই ছিল তার তীব্র শক্তির উৎস। তার এই সঙ্গীতের জন্যই হেলে পড়েছিলো বিহাটের গ্রামের সেই শিবমন্দিরটি– অন্তত তার ভক্তরা তাই জানে এবং মানে।
তানসেনকে নিয়ে সিনেমা
১৯৪৩ সালে সঙ্গীতশিল্পী তানসেনকে নিয়ে বলিউডে ‘তানসেন’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন জয়ন্ত দেশাই। এতে তানসেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কে এল সাইগল। পন্ডিত ইন্দ্র রচিত গানে সিনেমাটির সম্পূর্ণ সঙ্গীত প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ।
ছেলেবেলায় তানসেন
চারশ বছরেরও আগে গোয়ালিয়র নামক এক গ্রামে বাস করতেন বেশ স্বচ্ছল বিত্তবান এক কবি ও তার স্ত্রী, নাম তার মুকুন্দ মিশ্র। সব রূপকথার রাজাদেরই যেমন থাকে, মুকুন্দ মিশ্রেরও ছিল সেই একই সমস্যা। বুঝতেই পারছেন কী হতে পারে তা? ঠিক ধরেছেন, তাদের কোনো সন্তান ছিল না এবং এ নিয়ে নিঃসন্তান দম্পতির দুঃখের কোনো শেষ ছিল না। এক বন্ধুর পরামর্শে মিশ্র দম্পতি গেলেন তখনকার বিখ্যাত দরবেশ হযরত মোহাম্মদ গাউসের কাছে। গাউস মুকুন্দ মিশ্রের হাতে বেঁধে দিলেন এক পবিত্র সুতো আর এই আশীর্বাদ করলেন যে অতিসত্ত্বরই তাদের এক পুত্রসন্তান হবে। কিছুদিনের মধ্যেই গাউসের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল। জন্ম নিলেন তানসেন। পিতা তার জন্য নিযুক্ত করলেন শিক্ষকদের। কিন্তু ছেলের তো পড়াশোনায় মন নেই, তার মন পড়ে থাকে জঙ্গলে, যেখানে সে নিত্য-নতুন পশুপাখির সুর নকল করে! হ্যাঁ, এই ছিল তার প্রিয় খেলা।
হরিদাসের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা
একদিন হলো কী, জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক গানের দল। দুষ্টু তানসেন তাদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য শুরু বাঘের মতো করে ডাক! সে ডাক এতোই সত্যি মনে হচ্ছিল যে গায়কেরা অনেক ভয় পেয়ে গেলেন। তখন তানসেন তাদের সামনে আসলো, দলের নেতা তো তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি অনেক প্রশংসাও করলেন তার গর্জনের! এই দলনেতাটি আর কেউ নয়, ছিলেন তখনকার বিখ্যাত এক সঙ্গীতশিক্ষক হরিদাস। হরিদাস তানসেনকে তার শিষ্য করে নিতে চাইলেন। মুকুন্দ মিশ্রকে গিয়ে এ ব্যাপারে অনেক বোঝালেনও তিনি। তানসেনের মা অনেক মন খারাপ করলেন ছেলেকে এত দূর পাঠাবেন বলে, তবে শেষপর্যন্ত হরিদাসের সঙ্গে তানসেন বৃন্দাবন গেলেন সঙ্গীতশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশে।
১০ বছর ধরে একনিষ্ঠভাবে সঙ্গীতশিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন তানসেন। হরিদাসও তার মতো শিষ্য পেয়ে ঢেলে দিলেন তার সকল বিদ্যা। ভিত্তি নিয়মগুলো থেকে শুরু করে সিদ্ধহস্তে তানপুরা বাজানো, সা রে গা মা পা থেকে শুরু করে সঙ্গীতের নানা রাগ আয়ত্ত করলেন তানসেন। তিনি শিখলেন কীভাবে সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ বদলে দেয় মানুষের মনের অবস্থা! প্রকৃতি ও মানবমনের সাথে সঙ্গীতের নিগূঢ় সম্পর্ক অনুভব করতে লাগলেন তানসেন। একটি রাগ কীভাবে কাউকে আনন্দে পর্যবসিত করতে পারে আর পরক্ষণেই বিপরীত একটি রাগ কীভাবে চোখে জল এনে দিতে পারে- এ সবকিছু যেন তানসেনের নখদর্পণে এসে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, ইতিহাসের পাতায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গুরু-শিষ্যের মধ্যে হরিদাস-তানসেনের নামও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে!
আরও এক গুরুর সাহচর্য
তানসেনের বাবা অসুস্থ হবার খবর শুনে তানসেন বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসলেন বাড়িতে। মুকুন্দ মিশ্র মারা গেলেন এবং মৃত্যুশয্যায় তানসেনকে বলে গেলেন হযরত গাউসের কাছে গিয়ে সঙ্গীতশিক্ষা গ্রহণের জন্য। বাবার মৃত্যুর পর তানসেন মায়ের সেবায় নিয়োজিত হলেন এবং কিছুদিন পর তার মা-ও মারা গেলেন। পিতৃ-মাতৃহীন তানসেন এখন গাউসের কাছে যাবেন মনস্থির করলেন. কিন্তু তার আগে বর্তমান গুরু হরিদাসের সম্মতি তো লাগবে! হরিদাস তানসেনকে বললেন যে তার দরজা সবসময়ই তানসেনের জন্য খোলা থাকবে এবং সে গাউসের কাছে বিদ্যার্জনের জন্য যেতে পারে।
তানসেন গাউসের কাছে গিয়ে সঙ্গীতশিক্ষা আরও ঝালিয়ে নিতে লাগলেন। তিন বছর ধরে তিনি গাউসের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। গাউস তানসেনকে গোয়ালিয়রের অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতবিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, সঙ্গীতজগতে তানসেনের চেনাজানা বাড়তে থাকে গাউসের মাধ্যমে। গোয়ালিয়রের রাজার সাথেও গাউস তাকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং একসময় তারা বেশ ভাল বন্ধু হয়ে উঠেন।
পরিবারজীবনে তানসেন
রাজপ্রাসাদে যাতায়াত করতে করতে রাজার এক পরিচারিকার প্রেমে পড়লেন তানসেন। মেয়েটির নাম ছিল ‘হুসানী’, যার অর্থ ‘সুন্দরী’। তারা দু’জনে বিয়ে করলেন, তানসেন ধর্মান্তরিত হলেন। পড়ে তানসেন আরও একবার বিয়ে করেন এবং সবমিলিয়ে তার পাঁচ সন্তান ছিল।
খ্যাতির প্রথম ধাপ
মোহাম্মদ গাউস মারা যাবার আগে তার সকল সম্পত্তি তানসেনের নামে দিয়ে গেলেন এবং পরিবার নিয়ে তানসেন সেখানেই বাস করতে লাগলেন। একদিন রেওয়া থেকে এক দূত এসে বললো যে রাজা রামচন্দ্র তানসেনকে তলব করেছেন। খ্যাতির প্রতি এটিই ছিল তানসেনের প্রথম যাত্রা। রাজা তানসেনের সঙ্গীতপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ আরও বহু মহামূল্যবান পুরষ্কারে তাকে ভূষিত করলেন।
তানসেন নিজেই যখন উপহার!
একবার সম্রাট আকবর রেওয়াতে বেড়াতে এলেন এবং রাজা রামচন্দ্র তানসেনের গান দিয়ে সম্রাটের মনোরঞ্জন করলেন। এতে অবশ্য রাজা রামচন্দ্রের লাভের চাইতে ক্ষতিই হলো বেশি! কারণ আকবর চেয়ে বসলেন খোদ তানসেনকেই! যদিও রামচন্দ্র তানসেনকে হারাতে চাচ্ছিলেন না, তারপরও মহাপরাক্রমশালী সম্রাটের সাথে রাজা আর কী করে পারবেন? নিমরাজি হয়েই রাজ উপহার হিসেবে তানসেনকে পাঠালেন আকবরের সভায়। আর সে সভায় গিয়ে তানসেনের খ্যাতি যেন আকাশ ছুঁতে লাগলো! এতদিন যেন ঠিক ক্ষেত্র পাননি তানসেন, আকবরের সভা তাকে সেই ক্ষেত্রটি দিল। শোনা যায়, তানসেনের রেওয়াজকক্ষে সাতটি সরস্বতীমূর্তি ছিল আর তিনি যখন সা রে গা মা পা ধ্বনি দিয়ে গলা সাধতেন, একেকবার একেকটি সরস্বতীমূর্তি থেকে ধ্বনিগুলো আসছে বলে মনে হতো!
রাতের বেলা তানসেন আকবরকে এক সুমধুর রাগের মাধ্যমে ঘুম পাড়াতেন এবং সকালে আরেক অপূর্ব রাগ গেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে আকবরকে ঘুম হতে জাগাতেন। সম্রাট আকবরের দৈনন্দিন ছকে তানসেনের নাম গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তাই সম্রাটের সভার নবরত্নে তানসেন থাকবেন, এ কোনো অদ্ভুত কথা ছিল না!
কথিত আছে তানসেন যখন গাইতেন, সকল পশুপাখি তখন তার গান শুনতে চলে আসতো! প্রকৃতির সাথে এমনই সুরের বন্ধনে নিজেকে বেঁধেছিলেন তানসেন! সম্রাটের যখনই অশ্ব কিংবা হস্তী আরোহণ করবার সময় আসতো, তখন তানসেনই তাদের গান গেয়ে শান্ত করতেন এবং সম্রাট নিরাপদে তাতে আরোহণ করতেন।
হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের এক যাদুকর তানসেন, দিনে দিনে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো সম্রাট আকবরের রাজসভা এবং তার বাইরেও। সফলতা যেখানে চূড়ান্ত, সেই সফলতা থেকে ঈর্ষাকাতর ব্যক্তিদেরকে দূরে রাখা যায় না। তানসেনের ক্ষেত্রেও রাখা যায়নি। অন্য সভাসদেরা তানসেনের খ্যাতি-জনপ্রিয়তায় যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন আর ফন্দি আঁটতে লাগলেন কী করে তানসেনের জনপ্রিয়তা ধুলিস্যাৎ করে দেওয়া যায়। তো তারা করলেন কি, এক গুজব ছড়িয়ে দিলেন তানসেনের নামে। তানসেন তার সুরমহিমা দিয়ে একটি নিভে যাওয়া প্রদীপেও আলোকসঞ্চার করতে পারেন- এই ছিলো গুজবটি। গুজবটি পুরোপুরি গুজব ছিলোও না। তানসেন তা করতে পারতেন, কিন্তু যে রাগ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রদীপে আলো আসতে পারে, সেই রাগ গেয়েই এতো বেশি তাপ উৎপাদিত হয় যে তাতে গায়ক নিজেই জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবেন! এই তো চেয়েছিলো তানসেনের শত্রুরা। এক ঢিলে দুই পাখি সাবারের মতো তানসেনের খ্যাতির সাথে সাথে খোদ তানসেনকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া।
তানসেন যখন দ্বিধায় ভুগছেন, সমাধান নিয়ে এলেন তার সুযোগ্য কন্যা। তিনি তানসেনকে বললেন রাগ মেঘমল্লারের কথা, যেদিন রাজসভায় তানসেন সুরের পরীক্ষা দেবেন দীপক রাগ গেয়ে। তার অব্যবহিত পরেই তার কন্যা গ্রামের দিকতায় গিয়ে শুরু করবেন রাগ মেঘমল্লার, বৃষ্টি নেমে আসবে, শীতল হবে ভূমি। যেই ভাবা সেই কাজ, তানসেন কন্যাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন রাগ মেঘমল্লারের। তানসেনের কন্যাও তারই মতো সঙ্গীতপ্রেমী ও পারদর্শী ছিলেন, তাই শিখে নিতে বেশিদিন লাগলো না তার।
অবশেষে এলো সেই দিন, আজ সভাসদ ও স্বয়ং সম্রাট আকবরের সামনে পরীক্ষায় নামলেন তানসেন। দীপক রাগে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠতে লাগলো চারিদিক, সব জিনিসপত্র যেন মোমের মতো গলে যাচ্ছিলো। সভায় থাকা দায় হয়ে উঠেছিলো সবার। তেলে ভর্তি হাজারো প্রদীপ জ্বলে উঠলো সভাজুড়ে, অদ্ভুত কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তানসেন, রক্ষা পেলো তার খ্যাতি। কিন্তু এদিকে যে তানসেনের শরীরের তাপ বাঁধ মানছে না! শরীর যেন জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে তানসেনের, পূর্ব পরিকল্পনা মতো তার কন্যা গ্রামের দিকে বাজাচ্ছেন মেঘমল্লার রাগ। তিনি দৌড়ে গেলেন সেদিকে, অবিরত জলধারায় শান্ত হলো তাপ ও দীপক রাগের বিভীষিকা। প্রাণে ও খ্যাতি উভয়েই সেদিন বেঁচে রইলেন এই প্রবাদপুরুষ, তবে দীর্ঘ দুমাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় ছিলেন। অনেক বছর আকবরের সভা আলোকিত করবার পর আনুমানিক ১৫৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল অথবা ১৫৮৯ সালের ৬ মে তিনি যখন মারা যান, আকবর তখনও তার পাশে ছিলেন।
তানসেনের সমাধি
গোয়ালিয়র গ্রামে তানসেনের সমাধি নিয়েও কিছু মিথ চালু আছে তার ভক্তদের মধ্যে! বক্রপাথরে তৈরি সমাধিটির খুব পাশেই রয়েছে একটি তেঁতুল গাছ। তানসেনের ভক্তরা মনে করে যে কোনো গায়ক যদি এই তেঁতুল গাছটির একটি পাতা খেয়ে তানসেনের সমাধি স্পর্শ করে, তবে সে তানসেনের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হবে! অদ্ভুত হলেও সত্যি যে তানসেনের মৃত্যুর এত বছর পরও হিন্দুস্তানী এমনকি আন্তর্জাতিক সঙ্গীতেও তানসেন এত প্রবলভাবে বেঁচে আছেন!
তানসেন সমারোহ
তানসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে প্রতি ডিসেম্বরে ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে ‘তানসেন সমারোহ’ অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের বহু সঙ্গীতজ্ঞ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তানসেনের পাশাপাশি তার গুরু হরিদাস ও হযরত মোহাম্মদ গাউসকেও এই সমারোহে স্মরণ করা হয়।
তানসেন শুধু একজন গায়কই নন, ছিলেন একজন কবি। তিনি বহু গান বেঁধেছেন ও সেগুলোকে গেঁথেছেন বিভিন্ন সুরে। গোয়ালিয়র গ্রামে আজও তার সমাধির পাশে বড় উৎসব হয় এবং দেশ-বিদেশের সঙ্গীতপ্রেমীরা সেখানে এসে তানসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।