সঙ্গীতের প্রসঙ্গ আসলেই মুসলিম মানসে একপ্রকার টানাপোড়েন তৈরি হয়। কোরআনে সরাসরি আয়াত না থাকার দরুণ পূর্বেকার আলেমদের মতও বিভাজিত। ইমাম গাজ্জালির মতো কয়েকজন অবশ্য সঙ্গীতের পক্ষে মত দিয়েছেন। বিপক্ষে অবস্থানকারীদের দলও কম ভারি না । তবে দিনশেষে তাদের বিচারে বৈধতা বা অবৈধতা নির্ধারিত হয়েছে গানের বিষয়বস্তুর উপর। যে বিতর্ক এখন অব্দি বিস্তৃত। আর সেই বিতর্কে চাপা পড়ে গেছে মুসলিম স্বর্ণযুগে সংগীতশাস্ত্রের যুগান্তকারী অধ্যায়ের ইতিহাস। সঙ্গীতের সকল দিকে আরবদের চর্চার কাছে এককভাবে অন্যান্য দেশের ইতিহাস সামান্য বলেই মনে হয়।
ইসলামপূর্ব আরবের আল হিরা এবং গাসসান রাজ্য দুটি প্রভাবিত ছিল যথাক্রমে পারস্য এবং বাইজ্যান্টাইন রীতি দ্বারা। সেখানে গ্রীক আর সিরিয় উপাদানের সাথে পিথাগোরিয়ান স্বরগ্রাম মিলে তৈরি করেছিল স্বতন্ত্র অভিযাত্রা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে অন্যতম রাজনৈতিক কেন্দ্র হেজাজে প্রচলিত ছিলে পরিমাপমূলক সঙ্গীত রীতি; যা ইকা নামে পরিচিত। সঙ্গীতজ্ঞ ইবনে মিসজাহ (মৃত্যু আনুমানিক ৭০৫-১৪) প্রবর্তন করেন নিজস্ব মতবাদ। ১২৫৮ সালে বাগদাদের পতন অব্দি এই ধারা অব্যাহত থাকে। ইতোমধ্যে ইসহাক আল মাউসিলি সাবেক স্বরগ্রামে সংস্কার আনেন। যালযালিয়ান এবং খরাসানিয়ানের মতো কয়েকটি ধারা দেখা যায়। সেই সাথে এরিস্টটল, ইউক্লিড, নিকোমেকাস এবং টলেমির লেখা অনুবাদের মধ্য দিয়ে প্রাচীন মতবাদের সাথে যোগাযোগ ঘটে। ধীরে ধীরে তা এমন অবস্থায় উত্তীর্ণ হয় যে; পরবর্তীতে সংস্কৃতিতেও রেখে গেছে ছাপ।
সঙ্গীত চর্চা
সঙ্গীত নিয়ে আরবদের আগ্রহের ধারণা পাওয়া যায় সহস্র এক আরব্য রজনী (আলিফ লায়লা)-তে। ইবনে আবদ রাব্বিহির ‘`ইউনিক নেকলেস’, আবুল ফারাজ আল ইসফাহানির ‘কিতাবুল আগানি’ এবং আল নুওয়াইবির ‘The extreme need’ গ্রন্থগুলো আরব সংগীতের স্পষ্ট ধারণা দেয়। আরব জীবনের সুখ, দুঃখ, কর্মমুখরতা, যুদ্ধ কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও গানের ছিল নিজস্ব স্থান। স্বচ্ছল আরবদের ঘরে নিজস্ব গায়িকার নজির বিরল না। অবশ্য তাদের কাছে যন্ত্রসঙ্গীতের চেয়ে কণ্ঠ সঙ্গীত সমাদৃত ছিল বেশি। গীতি কবিতা বা কাসিদা ছাড়াও কণ্ঠসঙ্গীতের পদ্যরীতির মধ্যে কিত’সা বা খণ্ড কবিতা, গজল বা প্রেমের গান এবং মাওয়াল বিশেষভাবে সমাদৃত। শিল্পী মাত্রই অকটেভের সাথে পরিচিতি থাকা আবশ্যক। আবর যুগপৎভাবে ধ্বনিত হতো চতুর্থ, পঞ্চম এবং অষ্টম মেলোডির সুর; যার আরবি নাম তারকিব।
খলিফার দরবারে গায়কেরা পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। কেবল শিল্পী হিসাবে না; রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যেও। পেশার সূত্রে শিল্পী বিভিন্ন পরিবারে অবাধে গমণ করতে পারতেন। স্পাই হিসাবে অভ্যন্তরীণ কথা বের করে আনার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে!
বাদ্যযন্ত্র বৃত্তান্ত
সামরিক মহড়া এবং মিছিলে উচ্চস্বরের যন্ত্রের ব্যবহার ছিল বেশি। রীডপাইপ (সারনাই), শিঙ্গা (বাক), রণভেরি (নাফির), দামামা (নাকারা) তাদের মধ্যে প্রধান। সামরিক কৌশলের বিশেষ দিক হিসেবে জায়গা করে নেয় এই বাদ্যযন্ত্রগুলো। সামরিক কর্মকর্তার পদের অনুপাতে তার সাথে বাদকদল এবং নাউবায় নিনাদের সংখ্যা নির্ধারিত ছিল। বস্তুত সমরকন্দ থেকে আটলান্টিক অব্দি সঙ্গীতের পরিভাষা প্রাচ্য সঙ্গীত চর্চায় আরবদের প্রত্যক্ষ অবদানেরই প্রমাণ বহন করে।
আরব বাদ্যযন্ত্র বেশুমার। প্রাক ইসলামি যুগে মিযহার ছিল চামড়ার পেটওয়ালা বীণা। ক্লাসিক্যাল বীণা বা উদ কাদিম ছিল অনেকটা বর্তমান ম্যান্ডেলিনের মতো। মুরাব্বা ছিল চ্যাপ্টা আয়াতাকার গিটার। পরবর্তীকালে এটাই কিতারা নামে পরিচিত হয়। সেই সাথে সমাদৃত ছিল তানবুর (প্যান্ডোর), কানুন (সল্টারি) কিংবা কাদিব (ওয়াল্ড)। সঙ্গীতের সূচনা, বিরতি কিংবা সমাপ্তি অংশে ব্যবহৃত হয়েছে নাউবার মতো ছোট ছোট যন্ত্র।
কাঠের বায়ু চালিত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল বিভিন্ন আকারের বাঁশি। তিন ফুট লম্বা নাইবাম থেকে এক ফুট লম্বা শাব্বাবা এবং জুয়াক। তাম্বুরা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে বলা হতো দফ; দেখতে বর্গাকার। থালা আকৃতির চেপ্টা ছোট করতাল পরিচিত সিনজ্ নামে। ধীরে ধীরে বায়ু এবং পানি চালিত অর্গ্যান প্রচলিত হয়। তাদের মধ্যে দুলাব পরবর্তীকালে ইউরোপে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। আরবি সঙ্গীত যন্ত্রের উদ্ভাবনে কয়েকটা নাম সবার আগে সামনে আসে। তাদের মধ্যে আল ফারাবি রাবাব ও কানোনের জন্য, আল যুনাম বায়ুচালিত বাদ্যযন্ত্র যুনামির জন্য এবং যালযাল (মৃত্যু- ৭৯১) উদ আল শাব্বুতের জন্য। আল বাইয়াসি এবং আবুল মজিদ- দুজনেই ছিলেন অর্গান নির্মাতা।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলী
আরবি সাহিত্যের একটা বড় অংশ দখল করে আছে সঙ্গীত বিষয়ক রচনাবলী। গানের ইতিহাস, সংগ্রহ, বাদ্যযন্ত্র, গানের বৈধ দিক, নান্দনিকতা এবং সঙ্গীতজ্ঞদের জীবনী এসব রচনার অন্তর্ভুক্ত। আল মাসউদীর লেখা ‘মুরুজুজ জাহাব ওয়া মায়দানুল জাওয়াহির’ গ্রন্থে প্রাথমিক যুগে আরব সঙ্গীত চর্চার চমকপ্রদ সব তথ্যাবলি সন্নিবেশিত। অন্যদিকে একুশ খণ্ডে রচিত ইসফাহানীর গ্রন্থ ‘কিতাবুল আগানি’ অনেকটা বিশ্বকোষের কাজ করেছে। ইবনে খালদুন এই গ্রন্থকে আরবদের দিওয়ান বলে আখ্যা দেন। সঙ্গীত সম্পর্কে তার আরো চারটি গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায়। মুহম্মদ ইবনে ইসহাক আল ওয়াররাক (মৃত্যু.৯৯৫)-এর দ্য ইনডেক্স গ্রন্থটি সঙ্গীত তত্ত্ব, বিভিন্ন লেখকের নাম এবং সাধারণ রচনাবলীর নির্দেশিকা হিসেবে রচিত।
পশ্চিমের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইবনে আবদ রাব্বিহি (মৃত্যু-৯৪০) ‘দ্য ইউনিক নেকলেস’ গ্রন্থে সঙ্গীতজ্ঞদের জীবনী এবং সঙ্গীতের প্রতি সমর্থন উঠে এসেছে। ইয়াহইয়া আল খুন্দুজ আল মুরসি তার পূর্ববর্তী লেখক ইসফাহানির অনুকরণে লেখেন কিতাবুল আগানি। বাগদাদের পতনের পর সঙ্গীত বিষয়ক বিশিষ্ট লেখকদের প্রায় বিলুপ্তি ঘটে। তাদের স্থলে আবির্ভাব ঘটে ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞের। তারা গানের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি চালাচালি করেন। পরবর্তীতে সঙ্গীতের উপরে উল্লেখ যোগ্য রচনা ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ এবং আল ইবশিহিরের ‘মুসতারাফ’। ইয়েল ইউনিভার্সিটির সংগ্রহশালায় আরব সঙ্গীতের পাণ্ডুলিপি দেখতে একবার ঢুঁ মারতে পারেন।
সঙ্গীত তত্ত্ববিদ
সঙ্গীত তত্ত্বের প্রথম যে লেখক সম্পর্কে আমরা সুনির্দিষ্ট ধারণা পাই; তার নাম ইউনুস আল কাতিব (মৃ. ৭৬৫)। ঠিক তার পরেই আছেন আরবি ছন্দশাস্ত্রের সুবিন্যাসকারী ও প্রথম শব্দকোষ সঙ্কলক আল খলিল (মৃ.৭৯১)। ইবনে ফিরনাস স্পেনে যে মতবাদের প্রবর্তন করেছেন; খুব সম্ভবত তা আল খলিলের। ইবনে ফিরনাসই আন্দালুসিয়াতে সর্বপ্রথম সঙ্গীতবিজ্ঞান শিক্ষা দেন। অবশ্য তিনি অধিক সমাদৃত হয়েছেন আকাশে উড়ার প্রচেষ্টার কারণে। প্রাচীন আরব পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করেন ইসহাক ইবনে মাউসিলি। ‘বুক অব রিদমস্’ নামক গ্রন্থে উঠে আসে তার মতবাদ।
অষ্টম থেকে দশম শতকে সঙ্গীত ও স্বরবিজ্ঞানের উপর লেখা বহু গ্রীক রচনা অনূদিত হয় আরবিতে। পিথাগোরাসের মতবাদ আরবি ভাষায় পাওয়া যায়। প্লেটোর টিমিয়াস অনূদিত হয় ইউহান্না ইবনে বাডরিক (মৃ.৮১৫) এর হাতে। এরিস্টটলের ‘ডি অ্যানিমা’, গ্যালেনের ‘ডি ভসে’ এবং সিমপ্লিসিয়াসের রচনা অনুবাদ করেন হুনাইন ইবনে ইসহাক। এসব থেকে আরবদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে স্বরবিজ্ঞানের ধ্যানধারণা। এরিস্টোজেনাস আরবদের কাছে পরিচিত ছিলেন তার ‘দি প্রিন্সিপল অব হারমোনি’ এবং ‘অন রিদম’ নামক দুটি গ্রন্থের কারণে। সঙ্গীত রচনাতে ইউক্লিডের রচনা হিসেবে ছিল ‘দি ইন্ট্রোডাকশান টু হারমোনি’। ‘গ্র্যান্ড বুক অন মিউজিক’ নামক বৃহদাকার গ্রন্থ আরবিতে প্রচলিত ছিল নিকোমেকাসের নামে; যার অনুবাদকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবিত ইবনে কাররা (মৃ.৯০১)।
আরব পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম নাম আল কিন্দী। সঙ্গীত তত্ত্বের উপর তার রচনার সংখ্যা সাত। সেগুলোর মধ্যে অন্তত তিনটি সংরক্ষিত আছে- দি এসেনশিয়ালস্ অব নলেজ ইন মিউজিক, অন দি মেলোডিজ এবং দি নেসেসারি বুক ইন দি কমপোজিশান অব মেলোডিজ। এর ঠিক পর পরই আবির্ভাব ঘটে সবচেয়ে প্রভাবশালী আরব সঙ্গীত তত্ত্ববিদ আল ফারাবির। তার প্রভাবশালী রচনাগুলো- গ্র্যান্ড বুক অন মিউজিক, স্টাইলস্ ইন মিউজিক এবং অন দি ক্লাসিফিকেশন অব রিদম। অন্যতম আরব গণিতশাস্ত্রবিদ আল বায়যানি রচনা করেন দ্য কম্পেন্ডিয়াম অন দি সায়েন্স অভ রিদম। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইখওয়ানুস সাফা এবং আল খাওয়ারিজমির সঙ্গীত আলোচনাও ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়।
ইবনে সিনার নাম চিকিৎসাবিজ্ঞানে জোরেশোরে নেয়া হলেও সঙ্গীতশাস্ত্রে তার অবদান কম ছিল না। কিতাবুশ শিফা এবং নাজাত গ্রন্থেই তার প্রমাণ স্পষ্ট। ‘ইনট্রুডাকশন টু দ্য আর্ট অভ মিউজিক’ নামে রচিত গ্রন্থ বেশ পরিচিতি লাভ করে। সমকালীন পদার্থবিজ্ঞানী ইবনে আল হাইসাম ইউক্লিডের রচনার দুটি ভাষ্য রচনা করেন। দ্বাদশ শতকের দিকে আবির্ভাব ঘটে ইবনে আল নাক্বাশ, আল বাহিলী এবং তার পুত্র আবুল মজিদ, ইবনে মানআ এবং আরো কয়েকজন বিখ্যাত তাত্ত্বিকের।
মুসলিম স্পেনে ফিরনাসের পর মাসলামা আল মাজরিতি এবং আল কিরমানীর রচনা দেখা যায়। ইখওয়ানুস সাফার রচনাগুলো এরা জনপ্রিয় করে তোলেন। সঙ্গীত তত্ত্বের উপর অধিকতর প্রতিভাবান লেখক ইবনে বাজা। পাশ্চাত্যে তার রচনাবলী প্রাচ্যের আল ফারাবির মতোই জনপ্রিয়। ত্রয়োদশ শতকে সফিউদ্দিন আবদুল মুমিন কর্তৃক নতুন পদ্ধতি ধারার প্রচলন ঘটে। শারাফিয়্যাহ এবং বুক অভ মিউজিক্যাল মুডস্ গ্রন্থে তার মতবাদসমূহ আলোচিত হয়। শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আল মারহুম, মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে কারা বিশেষ অবদান রাখেন। আমর ইবনে খিজির আল কুর্দি রচনা করেন ‘দ্য ট্রেজার অভ দি ইনকোয়ারি ইনটু দ্য মুডস্ এণ্ড দ্য রিদমস্’। ইবনে আল ফানারি তার বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থে সঙ্গীতের বিষয়ও তুলে ধরেছেন। পদ্ধতিবাদী ধারার প্রতিষ্ঠাতার রচনার পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা মুহম্মদ ইবনে মুরাদের ট্রিটিজ। এটি বর্তমানে বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
তাত্ত্বিকদের কদর
কোয়াড্রিভিয়ামে দক্ষ হবার কারণে অধিকাংশ আরব তাত্ত্বিকই গণিত ও পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। গ্রীক মতবাদের পরীক্ষামূলক যাচাই বাছাই এবং নিজেদের বাস্তব ও প্রায়োগিক ভিত্তি নির্মাণে তাদের অবদান ছিল বিস্ময়কর। পূর্বপুরুষ যত নির্ভুলই হোক; তাদের পরীক্ষা না করে গ্রহণ করা হতো না। আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেভাবে টলেমি ও অন্যান্য গ্রিক লেখকের ত্রুটি সংশোধন করেন; সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। আরব তাত্ত্বিকরা স্বরের পরিমাপসহ বাদ্যযন্ত্রসমূহের যে সতর্ক বর্ণনা দিয়েছেন, তা তাদের স্বরলিপির সঠিকতারই জানান দেয়। তাদের রচনায় অবগত হওয়া যায় বীণা, প্যান্ডোর, হার্প এবং বায়ুচালিত বাদ্যযন্ত্রের বিষয়ে। ইউরোপে এ ধরনের যন্ত্র আসার শত শত বছর আগেই আরবরা এর সাথে পরিচিত ছিল। সফিউদ্দিনের মতবাদ সম্পর্কে স্যার হুবার্ট প্যারি বলেন,
“এ যাবত উদ্ভাবিত স্বরলিপিসমূহের মধ্যে এটি সব চাইতে পূর্ণাঙ্গ।”
উত্তরাধিকার
সঙ্গীতে আরবদের অবদানকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কেবল আরব ভূখণ্ডে না; পারস্য এবং তুর্কি ভূখণ্ডেও দাপটের সাথে বিস্তার লাভ করে তাদের সৃষ্ট ধারা। এমনকি ভারতেও আমরা আরবি গ্রন্থের অনুবাদ দেখতে পাই। আরবদের থেকে ইউরোপে গমণ করে মৌখিক ভাষা ও বিভিন্ন অনুবাদের মাধ্যমে। এরিস্টটলের ‘ডি এনিমা’ এবং গ্যালেনের ‘ডি ভসে’ মূলত আরবি থেকেই ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছে। আল ফারাবির দুটি বিশ্বকোষ জোহানস্ হিসপালেনসিস ও জিরার্ড অভ ক্রিমোনা কর্তৃক যথাক্রমে ‘ডি সায়েন্টিস’ এবং ‘ডি অটু সায়েন্টিয়ারাম’ শিরোনামে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ভাষান্তরিত হয়ে আসে ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদের রচনাও।
আরবি থেকে হিব্রু অনুবাদও পশ্চিম ইউরোপে পরিচিতি লাভ করে। ইসাইয়া বেন আইজাক, মোজেস ইবনে তিব্বান, ইবনে আকনিন কর্তৃক ভাষান্তরিত হয় বিভিন্ন রচনা। এছাড়া কনস্ট্যান্টাইন দ্য আফ্রিকানের রচনায় ইবনে সিনা এবং গুণ্ডিসাল ভাসের লেখায় আল ফারাবির ছাপ স্পষ্ট। রজার বেকন ওপাস টেটিয়ামের সঙ্গীতাংশে টলেমি ও ইউক্লিডের সাথে আল ফারাবির উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। মুসলিম স্পেন ছিল সে সময় ইউরোপের জ্ঞান বিজ্ঞানের বাতিঘর। সেখান থেকে বহু তত্ত্বই ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছে। তাছাড়া পরবর্তী বহু ইউরোপীয় পণ্ডিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরব সঙ্গীতশাস্ত্র থেকে প্রভাবিত হয়েছে।
ইউরোপের জন্য আরবদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্ভবত পরিমাপমূলক সঙ্গীত। আগে তারা এর সাথে অপরিচিত ছিল। অথচ আরবীয় সঙ্গীতে সপ্তম শতক থেকেই তা ইকায়াত বা ছন্দ নামে তার পরিচিতি। ফ্রাঙ্কো এবং তার প্রবর্তিত ধারায় স্বরলিপির পরিমাপমূলক ব্যবস্থা ও ছান্দিক যে রূপ দেখা যায়; তা মূলত আরবদের থেকে ধার করা। ল্যাটিন গ্রন্থ ডি মেনসিউরিস এট ডিসক্যান্টোতে আমরা এলমুয়াহিম এবং এল মুয়ারিফা নামের যে ছন্দের দেখা পাই; তা আরবি নামকেই নির্দেশ করে। ডি মুরিসের রচনায় অ্যালেনট্রেড কৌশল, রবার্ট ডি হ্যান্ডলোর হকেট নামের স্বরলিপি ও যতিচিহ্নের সংমিশ্রণ- উভয়ই এসেছে আরবি থেকে। আরবি ইকায়াতেরই ল্যাটিন নাম হকেট।
আরবি শব্দ আল-উদ থেকেই ইংরেজিতে লিউট শব্দের জন্ম। রাবাব, কিতারা এবং নাককারা শব্দ থেকেই এসেছে আধুনিক রেবেক, গিটার এবং নাকের। মধ্যযুগের সঙ্গীত রচনার অন্যতম পদ্ধতি কন্ডাক্টাস শব্দটি আরবি মাজরা শব্দের অনুরূপ। স্পেনীয় উস্তাদরা আরব লিউটের বিকাশ সাধন করতে গিয়েই মিউজিকা ফিকটা উদ্ভাবন করেন।
এবং তারপর
১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের কাছে বাগদাদের পতন এবং ১৪৯২ সালে স্পেনীয়দের কাছে গ্রানাডার পতন আরবদের রাজনৈতিক আধিপত্যে ইতি টানে। ক্ষমতার সাথে সংস্কৃতির যোগসূত্র আরো একবার প্রমাণ করেই অবনতি ঘটে সঙ্গীত তত্ত্ব ও চিন্তাধারার। অবশ্য উনিশ শতকের দিকে পশ্চিমা প্রভাব আসে প্রাচ্যে। শুরু হয় নতুন স্রোত। সেই প্রতিক্রিয়াতেই পুনর্জাগরণ ঘটতে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের। সিরিয়া, ইরাক, মিশর, তুরস্ক কিংবা উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতে নিজস্বতা নিয়ে সঙ্গীত চর্চা হতে থাকে। ১৯৩২ সালে কায়রোতে আরব সঙ্গীতের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কায়রোতে।
ধর্ম ইসলাম এবং সঙ্গীতের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন সত্ত্বেও আরবরা এক মাইলফলক রেখে গেছে সঙ্গীতের ইতিহাসে। এই ব্যাপারে একটা গল্প সামনে আনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
মসনবি প্রণেতা দার্শনিক জালাল উদ্দীন রুমিকে একবার প্রশ্ন করা হয়, কোন ধরণের সঙ্গীত হারাম? রুমির জবাব ছিল- “গরীব এবং ক্ষুধার্তের সামনে বিত্তশালীর থালায় চামচ নাড়ানোর শব্দ।”