আজ থেকে অনেক অনেক কাল আগেকার কথা। চীনে তখন মেয়েরা কেবল ঘরের মাঝেই থাকতো এবং গৃহস্থালি কাজকারবার করে তাদের জীবন অতিবাহিত করতো। অন্যদিকে ছেলেরা পড়াশোনা করে পরিবারের হাল ধরতো। এই যে, ছেলেরা বাইরের আর মেয়েরা কেবল ঘরের কাজ করবে, এই বিষয়টি তখন একপ্রকার অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঝু য়িংতাই নামের এক মেয়ে এই প্রথা ভাঙার স্বপ্ন দেখেছিল, চেয়েছিল ছেলেদের মতো পড়াশোনা করতে।
সৌভাগ্যক্রমে, ঝুর পরিবার ছিলো বেশ ধনী। ছোটবেলা থেকেই তার কোনো আবদার অপূর্ণ রাখা হতো না। তবে এবার ঝু যখন বাবার কাছে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বিদ্যার্জনের আবদার জানালো, তখন তিনি বেঁকে বসলেন। কারণ এতদিনের প্রথা ভাঙার সাহসটা আসলে তার ছিলো না। মেয়েকে তিনি বললেন, যদি ঝু কোনো স্কুলে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তবে তিনি তাকে আটকাবেন না। আসলে ঝুর বাবা ভেবেছিলেন, কোনো স্কুলই তার মেয়েকে ভর্তি করবে না ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে। সেজন্যই তিনি সরাসরি দ্বিমত পোষণ করেননি।
ঝুও কম চালাক ছিলো না। সে-ও বুঝতে পেরেছিল, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা প্রথাকে ভাঙার সাহস দেখাবে না স্কুলগুলো। তাই সে নিজেই একটি কৌশল বেছে নিলো, ছেলেদের ছদ্মবেশ ধারণ করলো সে। এরপর খুব সহজেই হাংঝৌ শহরের একটি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলো সে।
প্রতিদিন সকালে ছদ্মবেশ ধারণ করে স্কুলে যেত ঝু, আবার ছদ্মবেশেই ফিরে আসতো। ফলে স্কুলের কেউই ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেনি যে, ছেলের ছদ্মবেশে থাকা ঝু আসলে একজন মেয়ে।
সেই স্কুলেই লিয়াং শানবো নামক এক ছেলের সাথে পরিচয় হয় ঝুর। আস্তে আস্তে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তাদের দুজনের মাঝে বেশ চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে বছরও কেটে যায়, সেই সাথে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে তাদের মধ্যকার সেই বন্ধুত্ব। একটা সময় ঝু বুঝতে পারে, সে আসলে লিয়াংয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে।
এখানেই বাধলো সমস্যা। কারণ ঝু লিয়াংয়ের কাছে তার আসল পরিচয় প্রকাশ করতে পারছে না, আবার তার আবেগও যেন কোনো বাধা মানতে চাইছে না। সবকিছু দেখে-শুনে সে এক চাল চাললো। লিয়াংকে ঝু জানালো, পড়াশোনা শেষ করে জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করে সে যেন ঝুর বাসায় আসে। তাহলে বাবার সাথে কথা বলে ঝু তার এক বোনের সাথে লিয়াংয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
সরলমনা লিয়াং সেই কথা বিশ্বাস করলেও পাঠকদের নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না যে ঝু কী চাইছিলো, কারণ তখন পর্যন্ত ঝুকে একজন ছেলে হিসেবেই চিনতো লিয়াং! চমৎকার এই প্রস্তাবে লিয়াংও রাজি হয়ে গেলো। কারণ ঝুর মতো বন্ধুকে সে-ও হারাতে চাচ্ছিলো না। আর ঝুর বোনকে বিয়ে করা মানে তো বন্ধুর সাথে সম্পর্ককে আরো একধাপ উপরে নিয়ে যাওয়া!
একসময় পড়ালেখা শেষ হলো। ঝু-লিয়াং দুজনেই যে যার বাড়ির পথ ধরলো। লিয়াংয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। তাই চাকরিতে ঢুকবার পরেও পরিবারকে সুন্দর অবস্থায় আনতে তার বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। অবশ্য এরই মাঝে বিয়ের জন্য সঞ্চয়ও করে যাচ্ছিলো সে। এরপর যখন যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হলো তখন সে আর একমুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গেলো ঝুর বাড়িতে; উদ্দেশ্য ঝুর বোনকে বিয়ে করা, ‘বন্ধু’ ঝুর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ঝু আর লিয়াংয়ের মাঝে কোনো রকম দেখা-সাক্ষাত হচ্ছিলো না প্রায় বছরখানেক ধরে। তখন তো আর আজকের দিনের মতো স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও কলের সুব্যবস্থাও ছিলো না যে, তারা একে অপরকে দেখবে। মনের মানুষকে দেখতে না পেয়ে ঝু তাই বেশ মুষড়ে পড়েছিলো।
একদিন হঠাৎ করে লিয়াংকে আসতে দেখে ঝু তাই চমকে গেলো। ভাবলো, ভুল দেখছি না তো! যখন সত্যি সত্যিই সে বুঝতে পারলো, এটা স্বপ্ন নয়, সত্যি, তখন আনন্দের আতিশায্যে সে ছুটে গেলো লিয়াংয়ের কাছে। তবে তখন সে আর কোনো পুরুষের ছদ্মবেশে ছিলো না, থাকার প্রয়োজনও বোধ করেনি। বরং নিজের গোপন পরিচয় ফাঁস করে দিয়ে সে লিয়াংকে বললো, “আমিই তোমার বন্ধু। আমি আসলে একজন নারী। তোমাকে ছাড়া আমি আসলেই থাকতে পারবো না।”
হুট করে এভাবে ঝুর আসল পরিচয় পেয়ে লিয়াংও বেশ চমকে যায়। তবে খুব বেশিক্ষণ সেটা ছিলো না। বরং নারীরুপে ঝুকে পেয়ে সে যেন আরো খুশিই হলো। আবেগের বশে সে ঝুকে জড়িয়ে ধরলো। সেদিনই লিয়াং প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলো, কেন ঝুর প্রতি তার একটা অন্যরকম আকর্ষণ কাজ করতো সবসময়!
এবার সম্পর্ক স্থায়ীকরণের পালা। ঝু তাই লিয়াংকে নিয়ে গেলো তার বাবার কাছে। লিয়াংয়ের কাছ থেকে তাদের দুজনের পরিচয়ের আদ্যোপান্ত জানলেন তিনি। কিন্তু যখনই লিয়াং ঝুকে তার জীবনসঙ্গিনী রুপে পাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলো, তখনই আপত্তি জানালেন ঝুর বাবা। কেননা ততদিনে মা ওয়েনচাই নামক স্থানীয় এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা দিয়ে এসেছিলেন তিনি। ঝু-লিয়াংয়ের শত অনুরোধ, অশ্রু বিসর্জন সত্ত্বেও তিনি তার মত পাল্টালেন না।
এতদিন ধরে করে আসা ঝুর সকল পরিকল্পনা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। এতদিন পর সত্য প্রকাশিত হওয়ায় তারা দুজন একে অপরকে বাকিটা জীবন কাছে পাবার যে স্বপ্নটা দেখেছিলো, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। চোখের জলে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে তার প্রতিজ্ঞা করলো, ইহজীবনে হয়তো তারা একত্রিত হতে পারলো না, তবে পরকালে যেন একসাথে থাকতে পারে, সেজন্য তাদের দুজনের কবর একসাথেই হবে।
এর কিছুদিন পরেই এক কাজে লিয়াংকে অন্য এক প্রদেশে পাঠানো হলো। কিন্তু ঝুকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। মানসিক এই অবসাদ প্রভাব ফেলে তার শরীরেও। অল্প কিছুদিনের মাঝেই অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে লিয়াং।
লিয়াংয়ের মৃত্যুর খবর ঝুর কাছে পৌঁছালে বেঁচে থাকাটা তার কাছে অর্থহীন ঠেকতে লাগলো। (এই বাক্যটুকু পড়ে আবার ভাবতে যাবেন না যে, ঝু আত্মহত্যা করেছিলো!) বিয়েতে ঝু রাজি হলো ঠিকই, তবে শর্ত দিলো একটি, তাকে নিয়ে যাবার সময় বরযাত্রীকে লিয়াংয়ের কবরের পাশে দিয়ে যেতে হবে।
যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেলো। বরযাত্রী যখন কবরের কাছাকাছি পৌঁছালো, তখনই হঠাৎ করে আকাশ কালো হয়ে এলো, শোঁ শোঁ বাতাস বইতে লাগলো, যেন পুরো আকাশটাই ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। এমন দুর্যোগময় মুহূর্তে সবার অলক্ষ্যে ঝু ছুটে চলে গেলো লিয়াংয়ের কবরের কাছে, সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকফাটা আর্তনাদ করতে লাগলো। সে বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিলো, যেন কবরটি খুলে যায় আর সে ভেতরে চলে পারে।
হঠাৎ করেই তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেলো। বজ্রপাত এসে আঘাত করলো সেই কবরে। সাথে সাথেই কবরের মুখটি খুলে যায়। ঝু-ও দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে ঢুকে পড়লো কবরে!
ঝড় যেমন হঠাৎ করে এসেছিলো, তেমনই হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। ওদিকে ঝুকে খুঁজে না পেয়ে তার আত্মীয়স্বজনেরা সেই কবরের কাছে চলে এসেছিলো। কবর খুড়ে তারা কেবল একটি শূন্য কফিনই খুঁজে পেলো। তখনই দুটো প্রজাপতি সেখান থেকে উড়ে বেরিয়ে গেলো। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন বহুদিন পর তাদের দেখা হয়েছে, আর সেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তারা নাচছে।
এভাবে উড়তে উড়তেই একসময় লিয়াং-ঝু সকলের নজরের আড়ালে চলে গেলো, তবে রয়ে গেলো একে অপরের চিরসঙ্গী হিসেবে।
পূর্ব জিন রাজবংশের শাসনামলে (২৬৫-৪২০ খ্রি.) রচিত ঝু-লিয়াংয়ের এই প্রেমকাহিনীটি আজও বেশ জনপ্রিয়, বিশেষত চীন ও পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলসমূহে।
কিংবদন্তী এই প্রেমকাহিনীকে ঘিরে পরবর্তীকালে বানানো হয়েছে বিভিন্ন সিনেমা, গান, টিভি সিরিজ প্রভৃতি। এমনকি, চীনের নিংবো শহরে আছে লিয়াং-ঝু কালচারাল পার্কও, যেখানে কাহিনীর সাথে মিল রেখেই সাজানো হয়েছে পুরো স্থাপনা।