মানুষের জীবন প্রতিনিয়ত নানা ব্যস্ততার মধ্যে কাটে। ব্যস্তময় এই জীবন চায় একটু প্রশান্তি। উৎসবই হয়ে ওঠে তার কাছে এই প্রশান্তি প্রদান অনুষঙ্গ। উৎসবকে উপলক্ষ করে জীবনের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা দূরে সরিয়ে রেখে পরিবারের সাথে চুটিয়ে আনন্দময় মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার সুযোগ এনে দেয়। আর তাই তো দেশ-বিদেশের মানুষ আনন্দ-উচ্ছ্বাসে নিজেদের কর্মমুখর, ব্যস্ততাময়, নিসঙ্গ একাকিত্বকে ছেঁটে ফেলে অচেনা বহু মানুষের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে এই উৎসবগুলোয় শরিক হন। উৎসবগুলো বেঁচে থাকার টনিক হিসেবে কাজ করে। চলুন জেনে নিই তেমনই কিছু উৎসব সম্পর্কে।
কারনেভালে দি ইভরিয়া: ইতালি
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ইতালির উত্তরাঞ্চলের একটি ছোট্ট শহর ইভরিয়ায় পালিত হয় এই উৎসব। কবে থেকে এই উৎসবের শুরু, সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয়, এই উৎসবের সাথে জড়িয়ে রয়েছেন ভায়োলেত্তা নামের এক গ্রাম্য নারী।
কাহিনীর সূত্রপাত মধ্যযুগে। মারকুইস রেনারি দি বায়ানড্রেট নামের এক নিষ্ঠুর শাসকের অত্যাচারে গ্রামবাসীরা ভীত সন্ত্রস্ত ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়ে। একদিন ভায়োলেত্তা তার বিয়ের প্রাক্কালে কিছু আর্থিক সাহায্যের আশায় শাসক মারকুইসের নিকট আসেন। মারকুইস ভায়োলেত্তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ভায়োলেত্তাকে সেই নিষ্ঠুর শাসক সাহায্য না দিয়ে বরং ধর্ষণের চেষ্টা করে। ভায়োলেত্তা নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য মারকুইসকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং এক পর্যায়ে মারকুইসকে হত্যা করেন। এ খবর যখন গ্রামবাসীদের কানে পৌছলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ক্রুদ্ধ গ্রামবাসী প্রাসাদে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এর কয়েক শতাব্দীর পর থেকে গ্রামবাসী তাদের স্বাধীনতা ও শৌর্য-বীর্যের এই ঘটনাকে চিরস্থায়ী করার জন্য এই উৎসব পালন করতে শুরু করে। এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে কমলালেবুর লড়াইয়ের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য ইতালির আশেপাশের বিভিন্ন শহরের লোকজন ছাড়াও বিদেশ থেকে আগত অনেক পর্যটকও উৎসবে শরিক হন। এই কমলালেবুর যুদ্ধে দু’টি পক্ষ থাকে। এক পক্ষে খোলা গাড়িতে অবস্থান নেয়, যারা প্রতীকিভাবে সমাজের শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। আরেকপক্ষ রাস্তায় পায়ে হেঁটে পদচারণা করে যারা প্রতীকিভাবে সমাজের শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। আর এই কমলালেবুর যুদ্ধে শোষিত শ্রেণীর জয়ের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।
আরগুঙ্গু উৎসব: নাইজিরিয়া
প্রত্যেক বছর নাইজেরিয়ার উত্তর পশ্চিমাংশের কেব্বি রাজ্যের আরগুঙ্গু শহরে চারদিন ব্যাপী মাছ ধরার একটি মজার পার্বণে মজে থাকে সেখানকার মানুষ। এই অঞ্চলে অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং মৎস্যজীবী। ১৯৩৪ সালে সোকোতো ও কেব্বি রাজ্যের মধ্যকার বৈরিতা অবসানের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই উৎসবের প্রচলন হয়।
এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য মাছ ধরা এবং সকলের মাঝে একাত্মতা প্রকাশ করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এই উৎসবের সাক্ষী হতে আরগুঙ্গু শহরে ভ্রমণে আসে। কে কত মাছ ধরছে, তা এখানে দেখা হয় না। সবচেয়ে বড় মাছটি যে ধরতে পারে, তাকে পুরস্কৃত করা হয়। ২০০৫ সালে যে মাছ ধরা পড়েছিল, তার ওজন ছিল ৭৫ কিলোগ্রাম। ২০০৬ সাল থেকে নদীর পানির নাব্যতা রক্ষার জন্য বেশ কয়েক বছর উৎসবে মাছ ধরা পর্বটি বন্ধ রাখা হয়। কয়েক বছর পর তা আবার চালু হয়।
উৎসবে স্থানীয় প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ মাছ ধরার জন্য নদীতে নেমে পড়ে। অংশগ্রহণকারীরা নদীতে নেমে সবচেয়ে বড় মাছটিকে ধরার জন্য চিরুনি তল্লাশ চালায়। এ খেলায় ছিপ, জাল কিছুই ব্যবহার করার অনুমতি নেই।
ফেঁ ড্যু সিটরন: ফ্রান্স
ফ্রান্সের দক্ষিণপূর্ব উপকূল এলাকার মেন্টন শহরে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে আয়োজিত হয়ে থাকে ফেঁ ড্যু সিটরন বা লেবু উৎসব। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ লেবু। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে লেবুর সাহায্যে পুরো মেন্টন শহরকে সাজিয়ে তোলা হয়।
মেন্টন ও তার আশেপাশের অঞ্চল লেবু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। কিংবদন্তী রয়েছে যে, ইডেন অফ গার্ডেন থেকে যখন আদম ও ইভকে বহিষ্কার করা হয়, তখন ইভ এই ফলটি সাথে নিয়ে আসেন। তিনি ঠিক করেন, এই ফলের বীজ গারাভান সাগরে তীরবর্তী কোনো এক জায়গায় রোপণ করবেন, যা আজ মেন্টন শহর নামে পরিচিত। সেই থেকেই নাকি এ অঞ্চলে প্রচুর লেবু জন্মায়।
ফ্রান্সের পর্যটন বিভাগ এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। ১৯২৮ সাল থেকে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ফ্রান্সের পর্যটন অফিস এ উৎসবের আয়োজন করে আসছে। উৎসবে বাড়ির আঙিনা ও রাস্তার পাশে নানা ভাস্কর্য তৈরি করা হয় লেবু দিয়ে। উৎসব উপলক্ষে সুবিশাল সব ভাস্কর্য বানানো হয়। এতে প্রয়োজন হয় ১৪৫ টনের অধিক লেবু আর এসব ভাস্কর্য তৈরিতে নিয়োজিত থাকে ৩০০ এর বেশি লোক। লেবু দিয়ে বানানো নানা ভাস্কর্য নিয়ে দল বেঁধে মানুষ সমুদ্রের ধারের বড় রাস্তা ধরে আনন্দ মিছিল করতে থাকে।
প্রতি বছর উৎসবের সাজসজ্জা নির্ভর করে কোনো একটা থিমকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছরই নতুন থিম নির্বাচন করা হয়। ফলে উৎসবের নতুনত্ব ও বৈচিত্র্যময়তার কারণে লেমন উৎসব মেন্টন শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনপ্রিয় উৎসব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ বছর এই উৎসবের ৮৪তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে।
২০১৭ সালের উৎসবের থিম নিউইয়র্কের আইকনিক মিউজিক্যাল থিয়েটার ব্রডওয়েকে উৎসর্গ করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক পর্যটক এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের এই উৎসব ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত চলবে।
বোরেওয়ংয়ে মাড ফেস্টিভ্যাল: দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার অতি জনপ্রিয় এক উৎসবের নাম মাড ফেস্টিভ্যাল বা কাদা উৎসব। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বোরেওয়ংয়ে শহরের নির্জন সমুদ্র সৈকতে প্রতি বছর জুলাই মাসে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। ১৯৯৯ সালে প্রথম এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। মূলত কাদার কসমেটিক গুণাবলী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করো তোলার উদ্দেশ্যে এই উৎসব আয়োজনের সূত্রপাত। পরবর্তীতে তা বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়।
এই উৎসবে আরো বৈচিত্র্য আনার জন্য আয়োজন করা হয় নানা ধরনের খেলা। কাদায় মাখামাখি হয়ে অংশগ্রহণকারীরা মেতে চলেছে মাড স্লাইডিং, মাড রেসলিং, মাড কিং কনটেস্ট, মাড ফায়ারওয়ার্ক কনটেস্ট, মাড স্কিইং, মাড স্লাইডিং, বডি পেইন্টিং, মাড ম্যারাথনের মতো নানা খেলায়। সবকিছুতেই সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়াই যেন সবার উদ্দেশ্য। এই আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে ছোটরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই।
বোরেওয়ং শহরটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্র এক অপূর্ব লীলাভূমি। দ্বীপ পরিবেষ্টিত শহরটিতে চারদিকে পাহাড় এবং সাগরের নীল জলের হাতছানি। তাছাড়া শহরটিতে রয়েছে কোরিয়ার নানা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্ভার। ফলে এমনিতেই শহরটিতে সারা বছর পর্যটকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মাড ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেড়ে যায়।
উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য পর্যটকদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই মাড ফেস্টিভ্যালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় কয়েক লাখ মানুষ প্রতি বছর অংশ নেয়। স্থানীয়দের সাথে দেশ-বিদেশের এসব পর্যটকেরাও নেমে যায় এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে। কাদা মেরে ও কাদা খেয়েই ব্যাপক আনন্দ পান আগতরা।
বার্নিং টার ব্যারোল: ইংল্যান্ড
বার্নিং টার ব্যারোল ইংল্যান্ডের প্রাচীন উৎসবের একটি। প্রতি বছর ৫ নভেম্বরে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। শত বছরের পুরনো এই উৎসবে ইংল্যান্ডের ডেভন শহরের রাস্তায় লোকজন পিঠে জ্বলন্ত আলকাতরার পিপে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। সূর্যাস্তের পর যতক্ষণ সম্ভব গরম পিপেটি বয়ে বেড়ান কোনো ব্যক্তি। সহ্য ক্ষমতা ফুরিয়ে এলে অন্য একজন ইচ্ছুক ব্যক্তির পিঠে পিপেটিকে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারও যখন ক্ষমতা ফুরিয়ে আসে, তখন পরের জনের পিঠে ওঠে দায়িত্ব। এভাবে উৎসবে এই আশ্চর্য খেলাটি চলতে থাকে।
ফিচার ছবি: kevin-bonnaud.com