বর্তমানে মেসায়াহ অনেক বেশি আলোচিত। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নিজেদের প্রতিশ্রুত ব্যক্তি হিসেবে দাবি করা মানুষের সংখ্যা ঢের। অতীত ইতিহাস থেকে নাম লিপিবদ্ধ করতে গেলেও কম দীর্ঘ হবে না তালিকা। অন্যায় আর বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ দুনিয়ায় ধর্মে প্রতিশ্রুত পাঞ্জেরীর স্বপ্নে বিভোর ধার্মিকেরা। মেসায়াহ মতবাদ তাই কেবল ধর্মে সীমাবদ্ধ নেই; মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব এমনকি রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলেও চিন্তার খোরাক।
মেসায়াহ মূলত ভবিষ্যতের কোনো নিখুঁত স্থান এবং সময়ের মতবাদ। প্রত্যেক ধর্মের একটা সমৃদ্ধ স্বর্ণযুগ আছে অতীতে। প্রধান ধর্মনেতার মৃত্যুর পর অনুসারীদের মধ্যে দেখা দেয় বিচ্যুতি ও বিশৃঙ্খলা। স্বর্ণযুগের পতন ঘটে অজস্র প্রতিবন্ধকতায়। মেসায়াহ তাই সমস্ত বিশৃঙ্খলাকে পরাজিত করে বাসযোগ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। শ্বাসরুদ্ধকর জীবনকে পাশ কাটিয়ে স্বর্ণযুগের পুনরুদ্ধার।
সাওশিয়ান্ত
মেসায়াহ মতবাদের গোড়ার উদাহরণ জরাথুস্ত্রবাদের সাওশিয়ান্ত। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে পারস্যে জন্ম নেন জরাথুস্ত্র। বহুধাবিভক্ত গোত্রীয় কাল্টগুলো তার প্রচারেই আসে একটা ধর্মের ছায়াতলে। পরবর্তীতে একেমেনিড সাম্রাজ্যের সময় (৫৫৮-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্ব ) ধর্মের সাথে সংগঠিত হয় ধর্মগ্রন্থ জেন্দাবেস্তা। জগৎ তাদের চোখে শুভ আর অশুভের অবিরাম যুদ্ধের ময়দান। প্রধান দেবতা আহুরা মাজদা আর অশুভের নায়ক আঙরা মাইনুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। যদিও ধর্মগ্রন্থাদি ঘেটে তিনজনের ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়; তবু সাওশিয়ান্ত প্রভাব বিস্তার করে আছে ধর্মতত্ত্বে।
সাওশিয়ান্ত শব্দের অর্থ ‘যে শুভ আনে’। স্বর্গীয় গুণাবলী নিয়ে আহুরা মাজদার দূত হিসাবে তার আগমন। পরিচিত হবে ভিসপা তাওরুয়াইরির সন্তান বলে। স্পর্শেই নিখুঁত আর পবিত্র হয়ে উঠবে দুনিয়া। তাকে সাহায্য করবে সাত স্বর্গীয় দূত আমেশা স্পেন্টা। বিশ্বাসীরা মুক্তি পাবে। দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য করতে থাকা অন্যায় আর অনাচার হবে পরাজিত। নিশ্চিহ্ন হবে দ্রুগ এবং অশুভের হোতা আঙরা মাইনু। আবেস্তার বর্ণনা মতে,
“বিজয়ী সাওশিয়ান্ত এবং সাহায্যকারীরা পৃথিবী পুনর্গঠিত করবে। আর বয়স ফুরিয়ে যাওয়া নেই, মৃত্যু নেই। অবক্ষয় নেই, পচন নেই। কেবল চিরন্তন জীবন, চিরন্তন বৃদ্ধি আর ইচ্ছাপূরণ। মৃতরা জেগে উঠবে, জীবন আর অমরত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে; পৃথিবী হবে পুনরুদ্ধার”। (Darmesteter, 1883, Pages 306-307)
কল্কি
প্রাচীন ভারতীয় সময়ের ধারণা সরলরৈখিক না; চক্রাকার। ক্রম আবর্তিত চিরন্তন সময়কে প্রধানত চারটি যুগে বিভক্ত করা হয়েছে- সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। বর্তমানে মানুষ কলিযুগে বসবাস করছে; যা শুরু হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর পরই। কল্কি হলো হিন্দুধর্ম অনুসারে বিষ্ণুর দশম এবং শেষতম অবতার। সত্য প্রতিষ্ঠা করবেন; পদানত করবেন অসত্য। যেমনটা শ্রীকৃষ্ণের দাবি,
“যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত,
অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।”
অর্থাৎ “যখনই ধর্মের গ্লানি হয়; অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে। হে ভরতবংশীয় (অর্জুন), তখনই সাধুদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করতে; পুনরায় ধর্ম স্থাপন করতে যুগে যুগে আমি আবির্ভুত হই।” সত্যিকার অর্থেই কল্কি এই বাণী পূর্ণ করবেন। ঘোড়ায় চড়ে হাতে তরবারি নিয়ে আগমন হবে ধূমকেতুর মতো। কল্কি শব্দের অর্থই ‘অন্ধকারের বিনাশকারী’। তার পিতার নাম হবে বিষ্ণুযশ এবং মায়ের নাম সুমতি।
কলিযুগে মানুষ ক্রমশ লোভ আর পার্থিবতায় নিমজ্জিত। আধ্যাত্মিকতা, ভক্তি এবং ধর্মীয় অনুভূতি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। দেবতাদের নিয়ে চলে হাসি তামাশা। ব্যক্তির জীবন থেকে রাষ্ট্রের গলা অব্দি ডুবন্ত অন্যায় আর অবিচারে। যার চরমতম অবস্থায় ঘটবে কল্কির আবির্ভাব। অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন করে দেখা দেবে আরেক সত্যযুগ। মানুষ ফিরবে সমৃদ্ধি আর স্বর্ণ সময়ের দিকে। যেমনটা বলা হয়েছে,
“কল্কি আর তার অনুসারীরা রাজ্যের কোনায় কোনায় গিয়ে দুষ্টের দমন করবেন। সময়ের ব্যবধানে যে সব মানুষ বিভ্রান্ত, অশান্ত, লোভে অন্ধ, পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এমনকি নিজের পিতামাতার সাথেও বেপরোয়া; তাদের সকলকে। নতুন করে শুরু হবে সত্য আর সততার শাসন।” (Knapp, 2016)
মৈত্রেয়ী
বোধি বলতে সেই জ্ঞানকে বোঝায়; যার চর্চায় দুঃখের নিবারণ ঘটে। এই জ্ঞানের জন্য বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। গৌতম বুদ্ধ এর আগে ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করে মানুষের দুঃখের সমাধানে কাজ করেছেন। তখন তাকে চিহ্নিত করা হতো বোধিসত্ত্ব হিসেবে। অর্থাৎ বোধিসত্ত্ব হলো নির্বাণ পূর্ববর্তী অবস্থা; যখন সকল জীবের প্রতি অসীম করুণা ও মৈত্রী অনুভূত হয়। বৌদ্ধধর্ম অনুসারে মৈত্রেয়ী একজন বোধিসত্ত্ব; গৌতম বুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে যিনি ভবিষ্যতে আগমন করবেন। অধর্মের অবসান ঘটিয়ে উত্থান ঘটাবেন ধর্মের।
মৈত্রেয়ীকে চিত্রিত করা হয়েছে সিংহাসনে বসে অবতরণের অপেক্ষায় এক মহাপুরুষ হিসেবে। গায়ে ভিক্ষুর পোশাক। তার জন্ম হবে চক্রবর্তী রাজা শঙ্খের রাজ্য খেতুমতিতে। সন্তান জন্মের পর গৃহত্যাগ করবেন নিগূঢ় জ্ঞান সাধনার জন্য। সাত দিনের মাথায় বোধি লাভ করবেন। শিষ্যত্ব বরণ করবে অশোক, ব্রহ্মদেব, সুমন, পাদুম এবং সিহা। তার আগমণের মধ্য দিয়েই গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা অপ্রচলিত হয়ে পড়বে। পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে দুনিয়ায়। গৌতম বুদ্ধের ভাষ্যে,
“ভ্রাতৃসকল, মৈত্রেয়ী নামে এক মহাত্মা আবির্ভূত হবেন। পরিপূর্ণ রূপে জাগরিত; জ্ঞান, কল্যাণ, সুখ আর প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ; অতুলনীয় পথনির্দেশক, দেবতা আর মানবকূলের শিক্ষক এবং বুদ্ধ; এমনকি আমার থেকেও। তিনি নিজে থেকেই সৃষ্টিজগতের সকল কিছু দেখবেন এবং জানবেন; যেন মুখোমুখি বসা। এমনকি আমি যতটা জানি ও দেখি; তার চেয়েও স্পষ্ট।” (Dagha Nikaya xxvi.25 Pages. 73-74)
মোশিয়াহ
হিব্রু শব্দ মোশিয়াহ এর অভিধানগত অর্থ ‘উপলিপ্ত’ আর পারিভাষাগত অর্থ পরিত্রাতা। হিব্রু বাইবেলে মর্যাদাবান এবং মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের সাথে মোশিয়াহ ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান যাজককে বলা হতো কোহেন হা-মোশিয়াহ। তালমুদীয় আলাপ আলোচনায় মোশিয়াহ বলতে ডেভিডের বংশে প্রতিশ্রুত ভবিষ্যত নেতাকে বুঝানো হয়। তিনি জেরুজালেমের টেম্পল পুণঃনির্মাণ করবেন, ইহুদিদের একত্রিত এবং ইসরায়েলের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সারা বিশ্বের মানুষ মোশিয়াহকে বিশ্বনেতা বলে স্বীকৃতি দেবে এবং আনুগত্য করবে। সেই যুগ হবে শান্তির, উপদ্রবহীন এবং জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মূল্যবোধ আর নৈতিকতার ভয়াবহ অধঃপতন ঘটেছে। হত্যা, অপরাধ, নেশাদ্রব্য যেন খুব সাধারণ ঘটনা। মোশিয়াহ আসবেন সমস্ত সংঘাত, ঘৃণা, যুদ্ধ আর অনাচার বিলোপ করে। তোরাহের মৌখিক আর লিখিত উভয় পারদর্শীতা নিয়ে। কোনো কোনো বর্ণনায় মোশিয়াহর সঙ্গী হিসেবে নবী এলিজাহর পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছে। ইহুদি দীর্ঘ ইতিহাসের এই মতবাদ ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবৃতি মতে,
“কেটে ফেলা গাছের মতো ডেভিডের ধারা কেটে আছে। কিন্তু গাছে নতুন কুঁড়ি গঁজানোর মতোই নতুন রাজার উত্থান ঘটবে উত্তরাধিকারীদের থেকে। ঈশ্বর তাকে প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং শাসন ক্ষমতা দান করবেন। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্যক অবগত থাকবেন এবং কৃতজ্ঞতা জানাবেন। সন্তুষ্ট থাকবেন আনুগত্যে। বাইরের চাকচিক্য দেখে বিচার করবেন না। গরীবদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন; অসহায়ের অধিকার সুরক্ষা দেবেন। তার আদেশেই শাস্তি হবে; হবে বিশঙ্খলাকারীর বিনাশ। মানুষ শাসিত হবে ন্যায় আর ভালোবাসায়।” (ইসায়াহ: ১১:১-৫)
দ্বিতীয় আগমনী
ইহুদি মেসিয়ানিক মতবাদের উপর দাঁড়িয়েই খ্রিষ্টধর্মের বিকাশ। যীশুর জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরে অনুসারীদের দ্বারা বনি ইসরায়েলের প্রতিশ্রুত পুরুষ বলে পরিগণিত হন। কিন্তু শেষ অব্দি ইহুদি ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রত্যাশাকে যীশু পূর্ণ করতে পারেননি। পিটার এবং পলের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মূলধারার ইহুদিরা মুখ ফিরিয়ে নিল। পরিণামে ইহুদি ধর্মের থেকে আলাদা হয়ে পড়লো খ্রিষ্টধর্ম। পরবর্তীতে গ্রীক আর রোমানদের মধ্যে ব্যাপকতা লাভ করে মতবাদ। যীশুর পার্থিব জীবন মেসিয়ানিক ছিল; ঠিক একইভাবে ভবিষ্যৎ পুনরাবির্ভাবের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। (বুক অভ রেভেলেশন, ২২:১২)
খ্রিষ্ট শব্দটি হিব্রু মোশিয়াহর গ্রীক অনুবাদ; অর্থ উপলিপ্ত। ধর্ম প্রচারের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা নিয়ে পন্টিয়াস পিলেটের আদালতে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা যীশুর পুনরাগমন হবে প্রকাশ্য। প্রত্যেকটা চোখ তাকে দেখতে পাবে। তার সাথে থাকবে ফেরেশতারা। মৃতরা জীবিত হবে; সৎকর্মশীলরা পাবে যথার্থ প্রতিদান। দুষ্কৃতিকারীরা ধ্বংস হয়ে যাবে চিরতরে। সেই সাথে ধ্বংস হবে অসন্তুষ্টি, বিশৃঙ্খলা, ক্লেশ এবং খোদ মৃত্যুও। বাইবেলের ভাষ্য,
“যখন প্রধান স্বর্গদূতের কণ্ঠে ঈশ্বরের তূরীধ্বনি হবে, প্রভু নিজে স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন। যেসব খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের মৃত্যু হয়েছে; তারা আগে জেগে উঠবে। আমাদের যারা তখনো জীবিত থাকব, তাদেরকে মেঘে করে তুলে নেয়া হবে প্রভুর সাক্ষাতের জন্য। আর এভাবেই আমরা চিরকাল প্রভুর সাথে থাকব।” (থেসালোনিকীয়-১, ১৬-১৭)
ইমাম মাহদী
মুহম্মদ সা. এর নাতি হোসেনের পরিবারের উপর জুলুম এবং ৬৮০ সালে কারবালায় নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা সমর্থকগোষ্ঠীকে প্রকাশ্য রাজনৈতিক পাটাতন দান করে। শিয়া বিশ্বাস তার পরে থেকেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চায় ক্রমবর্ধমান কোণঠাসা পরিস্থিতিতে বিস্তার লাভ করে ভবিষ্যত ত্রাণকর্তা বা ইমাম মাহদি মতবাদ। সুন্নি মূলধারার সমান্তরালে ইরান ও ইরাকে বৃদ্ধি পেতে থাকে তৎপরতা। ৯০৯ সালে উবায়দুল্লাহ মিশরে ফাতেমীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন মাহদি মতবাদে ভর করেই।
মাহদি শব্দের অর্থ পথপ্রাপ্ত। কোরানে সরাসরি এই ধারণা অনুপস্থিত; যদিও সূরা আল ইমরানের ৪৬ এবং মারিয়ামের ২৯ নম্বর আয়াতে শৈশব অর্থে ‘মাহদি’ শব্দের ব্যবহার আছে। মাহদি সংক্রান্ত হাদিসের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ৫০। সুনানে আবু দাউদ অনুসারে তার নাম মুহম্মদ, উপাধি মাহদি এবং পিতার নাম আবদুল্লাহ। কিয়ামতের আগে সৎকর্মশীলদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে আসবেন রাসুলের বংশ থেকে। পতন ঘটবে দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ-মাজুজের। নিম্নশ্রেণি কিংবা বিত্তশালী; কেউ তাকে প্রত্যাখ্যান করবে না। হাদিস অনুসারে,
“মাহদি আমার বংশধর। তিনি উজ্জ্বল ললাট আর বাঁকা নাসিকা বিশিষ্ট হবেন। পৃথিবীকে ন্যায়-নীতি এবং ইনসাফ দিয়ে ভরে দেবেন। তার শাসনকাল হবে সাত বছর।” (সুনানে আবু দাউদ: হা/ ৪২৮৫; সনদ সহীহ)
লি হং
ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক মতবাদ হিসাবে তাওবাদের প্রতিষ্ঠা খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। আসক্তিবিহীন কর্ম এবং মহাবিশ্বের চিরন্তন সুর অনুযায়ী নিজেক গঠনের চর্চা হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে দ্রুত। যার গোড়ায় রয়েছে গুরু লাওৎসে এবং মহাগ্রন্থ তাও তে চিং। লি হং তাওবাদের ভবিষ্যৎ ত্রাতা যিনি পৃথিবী ধ্বংসের আগে এসে সৎকর্মশীল মানুষদের উদ্ধার করবেন। সমৃদ্ধ থাকবেন জ্ঞান, অনুধাবনশক্তি আর চর্চায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০২ থেকে খ্রিষ্ট পরবর্তী ২২০ অব্দি বিস্তৃত হান সাম্রাজ্যের সময়ে সংগঠিত হয় লি হং মতবাদ। একজন আদর্শ শাসক তিনি; যেমনটা ধর্মগ্রন্থ বর্ণনা করেছে। ক্রমবর্ধমান ভ্রান্তি আর বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে জমিনে শান্তি নেমে আসবে। ব্যক্তি, সমাজ আর রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে দূরীভূত হবে কালিমা। কখনো কখনো লাওৎসের ভবিষ্যৎ অবতার হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তাকে ব্যবহার করে পরবর্তী চীনে বহু বিদ্রোহ এবং আন্দোলন বৈধতা পেয়েছে।
পৃথিবীর সমাপ্তি সংক্রান্ত আলোচনা বিধৃত ‘থাইশাং তংউয়ান শেং চৌ চিং’ নামক গ্রন্থে। অন্যান্য অনেক মেসিয়ানিক মতবাদের মতো, তাওবাদেও পৃথিবীর সমাপ্তি মানে পুরাতন বিশ্বব্যবস্থার পরিসমাপ্তি এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা। ইতিহাস সেখানে চক্রাকার।
অবশেষ
প্রধান ধর্মগুলোর বাইরে রাশান, লাতিন আমেরিকান এবং আফ্রিকান অনেক ধর্মেও মেসায়াহ মতবাদ ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক আবেদন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অঙ্কিত হয়েছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ চিত্র। জগতের অন্যায় আর অনাচারের পতন ঘটিয়ে পরিশুদ্ধ আর সুখী সময়ের প্রতিশ্রুতি। অধর্মের কাছে প্রতি পদে মার খাওয়া ধার্মিকদের জন্য ইহকালীন বিজয়ের আশ্বাস। আত্মানুসন্ধানীর জন্য সান্ত্বনা রাত্রিশেষের।
সব সময় মানুষ মেসায়াহর অপেক্ষায় থাকেনি। সমাজের অবিচার আর নিপীড়ন বৃদ্ধি পেলে মজলুমদের মধ্য থেকে কেউ বিদ্রোহ করেছে এই ধর্মতত্ত্ব প্রয়োগ করে। কেউ ব্যবহার করেছে নিজের স্বেচ্ছাচারী শাসনকে শক্তিশালী ও বৈধ করতে। সকল ধর্মের ইতিহাসে তাকালে তাই অজস্র মেসায়াহ দাবিকারীর নাম পাওয়া যায়। সেই জেরুজালেমে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে হিটলারের নাৎসি মেসিয়ানিজম। প্রাচীন চীনের ইয়োলো টারবান বিদ্রোহ থেকে সুদানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই মতবাদ দিয়েছে শক্তি ও সমর্থন। তাই শুধু ধর্ম নিয়ে মেসায়াহ বুঝতে যাওয়াটা অবিচার হবে; নিপীড়িত কৃষকদের মুক্ত করতে জমিদার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা সিলেটের আগা মোহাম্মদ রেজা বেগের মাহদি দাবি তার বড় প্রমাণ।