আপনি কি পুরোনো প্যালেসের কথা বলছেন?
চীনের বেইজিংয়ে গিয়ে কোনো পর্যটক যখন বেশ উৎফুল্ল হয়ে ‘জিজিন চেং’ (zǐjìn chéng 紫禁城) বা ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’র সন্ধানে বের হন, তখন জায়গাটির সঠিক নাম বলতে পারেন না বলে অভিমত দেন অনেক স্থানীয় ব্যক্তি। খানিকটা বিরক্ত এবং অসন্তুষ্টও হন। আপনার মনে হতে পারে, বিশ্বখ্যাত পর্যটন স্থান ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’র নাম তো সবারই জানা, তাহলে সেটা নিয়ে গর্বিত না হয়ে বিরক্ত হওয়ার কারণ কী? আসলে চীনের স্থানীয়দের কাছে এই জায়গাটি ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’ বা ‘নিষিদ্ধ শহর’ নয়, বরং ‘গুগং‘ (gùgōng 故宫) নামেই বেশি পরিচিত।
চীনা ভাষায় ‘গুগং’ এর অর্থ প্রাক্তন রাজপ্রাসাদ। একে ‘পুরনো প্যালেস’ বা ‘ওল্ড প্যালেস’ বলেই সবাই ডাকে। ১৯১২ সাল থেকে এই স্থানটি ‘গুগং’ এবং ১৯২৫ সালে এখানে জাদুঘর খোলা হলে সেটা ‘গুগং বোউইউয়ান’ (gùgōng bówùyuàn 故宫博物院)-এর নামে খ্যাতি লাভ করে। এই প্রাসাদটি ছিল ‘মিং’ (১৩৬৮-১৬৪৪) ও ‘কিং’ (১৬৪৪-১৯১১) রাজবংশের প্রায় ২৪ জন চীনা সম্রাটের বাসভবন এবং বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্র। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন।
কেন একে নিষিদ্ধ শহর বলা হয়?
এখন তাহলে কথা হলো, এই ‘ফরবিডেন সিটি’ নামটা আসল কোথা থেকে? নামটি মূলত প্রাসাদটির সার্বভৌম নাম ‘জিজিন চেং‘ এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে প্রাপ্ত। আপনি ভাবতে পারেন হয়, প্রাসাদটিতে শ্রমিক বা নিচু জাতির ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষেধ ছিল, তাই এমন নামকরণ। আপনার ধারণা আসলে পুরোপুরি ভুল না, তবে আরও কিছু কারণ রয়েছে।
এই প্রাসাদটি ছিল অনেকটা ভিআইপি ক্লাবের মতো, যেখানে শুধুমাত্র সম্রাট ছাড়া আর কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি সম্রাটের গর্ভধারিণী মায়েরও সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। এবার এই নামটার আরেকটু বিস্তারিত ব্যাখা দেওয়া যাক। প্রাসাদটির ঐতিহাসিক নাম ‘জিজিন চেং’ মূলত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। প্রথম অংশটি হচ্ছে ‘জি’ ( 紫 zǐ), যার মানে বেগুনি রঙ। এর জন্য একে ‘পার্পল ফরবিডেন সিটি’ও বলা হয়। আবার এই শব্দটি দ্বারা উত্তরদিকের নক্ষত্র ‘পোলারিজ’ও বোঝায়।
চীনা জ্যোতিষীরা তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাতের আকাশকে ২৮টি নক্ষত্রমন্ডলে বা স্বর্গীয় বাসভবনে ভাগ করেন, যেগুলো আবার ৩টি পৃথক পৃথক এলাকার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে একটি হলো পোলারিজ নক্ষত্র কেন্দ্রিক, যার নাম ‘জিয়েই ইউয়ান’ (zǐwēi yuán 紫微垣)। চীনা পুরাণ মতে, এটি হচ্ছে স্বর্গের সম্রাটের আবাসস্থল। তারা রাজাকে ‘স্বর্গের পুত্র’ হিসেবে সম্মান করেন বলে তার আবাসের নামেও ‘জি’ যুক্ত করে।
দ্বিতীয় অংশে রয়েছে ‘জিন’ (jìn 禁)। এর অর্থ ‘ফরবিডেন’ বা ‘নিষিদ্ধ’। প্যালেসটিতে সময়, প্রয়োজন এবং কারণ সাপেক্ষে সম্রাট ছাড়া কয়েকজন রাজপরিবারের সদস্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং পাহারাদারই যেতে পারতো। প্রাসাদের বিশাল বিশাল দেয়াল ও দুর্গ বাইরের কোনো ব্যক্তিকে বিনা অনুমতিতে সেখানে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতো। আর সর্বশেষ অংশ ‘চেং’ (chéng 城) হলো বড় দেয়াল দিয়ে ঘেরা কোনো গোপন এলাকা। ৭,২০,০০০ বর্গ মাইলের কোনো বিশাল স্থানের চেং শব্দটি প্রযোজ্য!
ইতিহাস
ফ্রান্সের ল্যুভর প্যালেসের তিন গুণ হলো এই রাজপ্রাসাদ। প্রায় ১ মিলিয়ন বা দশ লক্ষ শ্রমিক এই কাজে সহায়তা করে। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ‘মিং’ রাজবংশের সম্রাট ইওঙলির সময় (১৪০৬) এবং শেষ হয় ১৪২০ সালে। প্রাচীনকালে চীনাদের বিশ্বাস অনুসারে, স্বর্গের রাজপ্রাসাদ ছিল ‘দ্য পার্পল প্যালেস’, যার প্রতিরূপই হল এই ‘জিজিন চেং’। ১৪ জন ‘মিং’ সম্রাট ১৬৪৪ পর্যন্ত চীনকে শাসন করে। তাদের সময় চীনের রাজধানী ছিল বেইজিং।
তবে ১৬৪৪ সালে মানচুস বংশ মিংদের হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসলে কয়েক মাসের জন্য চীনের রাজধানী সেনাং এ স্থানান্তরিত হয়। সেই বছরই কিং সম্রাট মানচুসদের ক্ষমতাচ্যুত করে রাজধানী আবার বেইজিংয়ে নিয়ে আসে। ১৯১২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ রিপাবলিক অফ চীন হওয়ার আগপর্যন্ত কিং বংশের ১০ জন সম্রাটের রাজত্বই চীনে চলে।
প্যালেসটির আরও কিছু খুঁটিনাটি
পুরো প্যালেসে প্রায় ৯০টি কোয়ার্টার ও আঙিনা রয়েছে। এখানে ৯৮০টি ভবন এবং ৮,৭২৮টি রুম রয়েছে। যদিও একটি পুরাণ মতে, ঐখানে ৯,৯৯৯টি রুম রয়েছে। তবে এর সত্যতা নিয়ে সুনিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা, প্যালেসটির কিছু অংশে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
‘দ্য ফরবিডেন প্যালেস’ এ চীনা সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশিল্প খুব সুন্দর করেই বোঝা গিয়েছে। মধ্যযুগীয় কাঠের শিল্পের নিদর্শনও দেখা যায় এখানে। এছাড়া সারা রাজপ্রাসাদেই রয়েছে তাদের বিভিন্ন পবিত্র পশুর ছবি ও মূর্তি। যেমন- সিংহ, ফিনিক্স, ড্রাগন ইত্যাদির মূর্তি ও ছবি হলের ছাদে বসানো বা লাগানো। তাদের বিশ্বাস ছিল এরকম করলে তাদের উন্নতি হবে ও এগুলো তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে।
ম্যাজেস্টিক বহিঃস্থ প্রাসাদে কোনো গাছ নেই
‘দ্য ফরবিডেন সিটি’ প্রধানত আনুষ্ঠানিক বহিঃস্থ প্রাসাদ ও আবাসিক অভ্যন্তরীণ প্রাসাদ নিয়ে গঠিত। ভেতরের প্রাসাদে অনেক গাছ থাকলেও বাইরের দিকে কোনো গাছ চোখে পড়ে না। এর কোনো আদর্শ যুক্তি না পাওয়া গেলেও দুটি মতবাদ রয়েছে। যেহেতু বাইরের প্রাসাদটিতে সম্রাটরা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতেন এবং জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, তাই সেখানে কোনো গাছ লাগানো নিষিদ্ধ ছিল।
কেননা, তাদের মতে তা রাজার আধিপত্য ও শক্তির প্রদর্শনকে আচ্ছাদিত করতে পারে। আরেকটি কারণ হলো নিরাপত্তা। গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে কেউ যেন সম্রাটের ক্ষতি করতে না পারে।
দ্য প্যালেস মিউজিয়াম
এই মিউজিয়ামে প্রাচীন চীনের ঐতিহাসিক হস্তশিল্পের নিদর্শন দেখা যায়। হাজার বছরের চীনা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেখা যায় এই জাদুঘরে। তাই একে পৃথিবীর সবচাইতে সেরা জাদুঘরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পর্যটকেরা ঘুরে দেখার সময় প্রাচীন কিছু হস্তশিল্প ও ভবন তাদের আকৃষ্ট করে।
এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ‘দ্য ইটারনাল টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ গোল্ড কাপ। এটা আসলে একটি ওয়াইন কাপ, যা কিং বংশের সম্রাট কিয়ালংয়ের ৩০ তম জন্মবার্ষিকীতে তাকে উপহার দেওয়া হয়। এছাড়াও রয়েছে ঝাং চেংয়ের তৈরি সোনালী বার্নিশের আসবাবপত্র। ঝাং চেং ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত হস্তশিল্পী। আরও কিছু হস্তশিল্প হলো ক্লোয়েসন এনামেল এলিফ্যান্ট-ইয়ার বার্নার, রিকভারি লেটার, ইয়াক্সু স্কয়ার ভেসেল, ল্যাং কিলন রেড-গ্লেজড ভাস প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৬১ সালে চীনা কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রাসাদকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কীর্তিস্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই গুগং বেশ ভূমিকা রাখে। ১৯৮৭ সালে এই পর্যটন স্থানটি যখন ইউনেস্কো দ্বারা ‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন মূলত এই গুগংকে সবাই চিনতে শুরু করে। ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি পর্যটন স্থানের অন্তর্ভুক্ত।
‘জিজিন চেং’ এখন নিষিদ্ধ না হলেও শতকরা ৪০ ভাগ স্থানে এখনও প্রবেশ করা যায় না। তবে বাকি ৬০ ভাগ জায়গাও কম নয়! চীনে গেলে এই স্থানটি ঘুরে দেখতে পারেন। চীনা সংস্কৃতির অপূর্ব নিদর্শনগুলো উপভোগ করার জন্য বেশ উপযুক্ত স্থান।
ফিচার ইমেজ – zijincheng.gruzphoto.eu