অনেক অজানা রহস্যে ঘেরা আমাদের এই পৃথিবী। রহস্যই পৃথিবীর সৌন্দর্য; এক রহস্য উদঘাটনের পর আমরা ছুটে চলি আরেক রহস্য উদঘাটনের পিছনে। আজকে আমরা তেমনই এক রহস্যময় জাতিগোষ্ঠীর সাথে পরিচিত হবো, যাদের নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র মালয়েশিয়ায়; নাম ‘মাহ মেরি’। তাদের এই নামের মধ্য দিয়েই তাদের এক রহস্যময় পরিচয় ফুটে ওঠে। ‘মাহ’ মানে ‘অধিবাসী’ এবং ‘মেরি’ মানে ‘জঙ্গল’, অর্থাৎ তাদের নামের অর্থ ‘জঙ্গলের অধিবাসী’। মালয়েশিয়ায় সরকারীভাবে মোট ১৮টি আদি জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি রয়েছে। তাদের মধ্যে এই মাহ মেরি জাতি অন্যতম।
মাহ মেরি জাতিগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্য মালয়েশিয়ার দক্ষিণ সিলানগরের উপকূলীয় অঞ্চল ‘সাঙ্গাই পেলেক’ থেকে ‘পুলাউ কেরির’ অঞ্চল পর্যন্ত ৪টি গ্রামে এবং কালাং নদী বিপরীত তীরে আরও ১টি গ্রামে; মোট ৫টি গ্রামে বসবাস করে। ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুসারে তাদের জনসংখ্যা মোট ২,১২০ জন। তবে এই সংখ্যা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমতও পাওয়া যায়; বিশিষ্ট ‘মাহ মেরি’ গবেষক রাশিদ ইশা তার ‘বুঙ্গা মোয়াং’ গ্রন্থে এই সংখ্যা প্রায় ৪,০০০ জন বলে উল্লেখ করেছেন।
মাহ মেরি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধানত তিনটি ভাগ রয়েছে- নেগ্রিটো, সেনোই এবং প্রোটো মালয়।
নেগ্রিটারা সিলানগরের উত্তরদিকে বসবাস করে। তারা নিজেদেরকে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে আদি জনগোষ্ঠী বলে দাবী করে। তাদের বিশ্বাস, প্রায় ২৫,০০০ বছর পূর্বে তারা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মালয়েশিয়ায় আগমন করেছে।
সেনোইরা সিলানগরের মধ্যভাগে বসবাস করে। তাদের বিশ্বাস, তারা চীনের ইউনান থেকে প্রথমে থাইল্যান্ডে এবং প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়ায় আগমন করেছে।
প্রোটো মালয়রা সিলানগরের দক্ষিণ দিকে বসবাস করে। তারা মূলত নাবিকদের বংশোদ্ভূত; জাহাজ চালনার সূত্রে খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১,৫০০ এর মধ্যে তারা মালয়েশিয়ায় আগমন করে। তবে গবেষকগণ মনে করেন, মাহ মেরি জাতিগোষ্ঠীর সকল আদিপুরুষই জাহাজ চালনার সূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মালয়েশিয়ায় আগমন করেছেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন।
মাহ মেরিদের নিজস্ব ভাষা আছে, নাম ‘বেসিসি’। এটি একটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা। মাহ মেরি জনগোষ্ঠী ছাড়াও অল্প কিছু মালয়েশিয়ান এই ভাষা জানেন, তবে বর্তমানে এই ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সমাজ পরিচালনার জন্য মাহ মেরিদের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। পাঁচটি গ্রামের মধ্যে ‘অরাং আসলি’ নামক গ্রামটি তাদের সমাজ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। প্রত্যেক গ্রামে একজন করে গ্রাম প্রধান রয়েছে, তাকে বলা হয় ‘বাতিন’। গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা প্রবীণ তাদেরকে নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম কাউন্সিল। ‘বাতিন’ এই কাউন্সিলের প্রধান হন। তবে সামাজিকভাবে বাতিনের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে থাকেন ‘বোমো’। ‘বোমো’ কিছুটা ধর্মগুরুর মতো, আবার কিছুটা ওঝার মতো- সব মিলিয়ে সমাজ পরিচালনায় তার মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
তাদের বিভিন্ন উৎসব রয়েছে, এর মধ্যে ‘সেওয়াং’, ‘টেরিয়ান যো’ এবং ‘টেরিয়ান টোপেন’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রত্যেকটি উৎসবের সাথে জড়িত রয়েছে একেকটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, যা মাহ মেরি জনগোষ্ঠীকে করে তুলেছে রহস্যময়।
‘সেওয়াং’ মূলত একধরনের নৃত্য, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তাকে বিদায় জানানোর জন্য এই নৃত্য করা হয়। নৃত্যের বাদ্য হিসেবে বাঁশ গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। মাটির সাথে লম্বালম্বিভাবে একটি বাঁশের টুকরো রাখা হয় এবং চার-পাঁচজন নারী ছোট ছোট বাঁশ দিয়ে উক্ত বাঁশটিকে ধীরে ধীরে আঘাত করতে থাকেন, এতে একটি আধ্যাত্মিক মূর্ছনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, আর সেই ছন্দে ছন্দে শোকের মাতম গাওয়া হয়।
‘টেরিয়ান যো’ মানে জঙ্গল নৃত্য, এই নৃত্যে নারী ও পুরুষ উভয়ে বৃক্ষের লতা পাতার মাধ্যমে বন্য পশুর মতো সজ্জা গ্রহণ করেন, তারপর বাদ্যের তালে নৃত্য করেন। নৃত্য করতে করতে কেউ কেউ অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। এমন অবস্থাকে তাদের নৃত্যের বা নৃত্যরত ব্যক্তির সফলতা হিসেবে গণ্য করা হয়; নৃত্য করলেই সকলে এই অবস্থানে পৌঁছাতে পারেন না।
‘টেরিয়ান টোপেন’ মানে হচ্ছে মুখোশ নৃত্য, এই সময়ে সবাই মুখোশ পরে অদ্ভুত রকমের সজ্জা গ্রহণ করে, তারপর বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করতে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এই মুখোশের সাথে আধ্যাত্মিকতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাদের বিশ্বাস, তাদের মধ্য থেকে যত মানুষ এবং প্রাণী মৃত্যুবরণ করে, তারা এই মুখোশের মাধ্যমে প্রকৃতিতে বর্তমান থাকে।
মুখোশ তৈরির পেছনে একটি লোককথা প্রচলিত আছে তাদের সমাজে, যা তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে। একবার একটি বাঘ একটি গুহায় শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা সকল প্রাণীকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করে। এমতাবস্থায় বাঘটিকে রক্ষা করাও তাদের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে, কিন্তু ভয়ে কেউ বাঘটিকে মুক্ত করতে গুহার ভেতরে যায়নি। একপর্যায়ে বাঘটি শিকলে আবদ্ধ অবস্থায় মারা যায়। এতে সমগ্র মাহ মেরি সদস্যরা অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে থাকে, তারা ভয়ের অজুহাতে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। এখন মুখোশের মাধ্যমে সেই বাঘের শোকার্ত আত্মা তাদের কাছে ফেরত আসে। তাই অন্যান্য প্রাণীর মুখোশের চেয়ে বাঘের মুখোশ তাদের কাছে অধিক শোকের। এই মুখোশ নৃত্যের মাধ্যমে তারা তাদের মৃত্যুবরণ করা সকল মানুষ ও প্রাণীদের স্মরণ করে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই জাতিগোষ্ঠী বেশ রহস্যময়; রহস্যময় বলতে তাদের এমন কিছু বিশ্বাস, প্রথা, নিয়ম-কানুন রয়েছে, যা আমাদের কাছে বা কথিত সভ্য মানুষের কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে। কোনো ধরনের নেতিবাচক জায়গা থেকে আমরা তাদের সেসব রহস্যকে বিবেচনা করবো না, শুধুমাত্র জানান চেষ্টা করবো, নিজেদের জানার পাল্লা ভারি করবো। মাহ মেরিদের নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক রাশিদ ইশা; তিনি পশ্চিম মালয়েশিয়াতে অবস্থিত ‘মাহ মেরি কালচারাল ভিলেজ’ এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মাহ মেরিদের উপরে গবেষণা করে ‘বুঙ্গা মোয়াং’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি মাহ মেরিদের অনেকগুলো রহস্যময় বিশ্বাস, প্রথা, নিয়ম ইত্যাদি তুলে ধরেছেন।
মাহ মেরিদের কোনো ধর্ম বিশ্বাস নেই, তারা প্রকৃতিবাদী। নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রথা ও উৎসব তৈরি করে নিয়েছে। তারা জান্নাত কিংবা জাহান্নামে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে সকল বৃক্ষের পুনর্জন্ম হয়, ফলে অযথা কোনো বৃক্ষ নষ্ট করা যাবে না। যা একবার জগতে এসেছে তা আর কখনো পুরোপুরি জগত থেকে চলে যায় না; মৃত্যুর মাধ্যমে রূপ বদলায় মাত্র। প্রাণী জগতের কোনো কিছুর মৃত্যু মানে দেহ থেকে আত্মা আলাদা হয়ে যাওয়া, তারপরে সে নিষ্ক্রিয় অথবা সক্রিয় আকারে আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদেরকে ধারণ করার জন্য জীবিতরা ‘মুখোশ’ তৈরি করে। এই মুখোশ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় ‘নাইরি বাতু’ নামক বৃক্ষের কাঠ। এ বিষয়ে তাদের ‘বোমো’রা আরও গুরুগম্ভীর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে।
কেউ মৃত্যুবরণ করলে ‘বাতিন’ আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যু ঘোষণা করে। ঘোষণার পরে মৃতদেহকে বিদায় জানানোর অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেই অনুষ্ঠানে মাহ মেরির সকল সদস্যকে অংশগ্রহণ করতে হয়। একটি দড়ি দিয়ে মৃতদেহের কনুই বরাবর বাঁধা হয়, তারপর পালাক্রমে সকল সদস্যকে সেই মৃতদেহকে ঘুরে ঘুরে বিদায় জানাতে হয়। এ সময়ে মূলত সেওয়াং নৃত্যের মাধ্যমে সবাই মৃতদেহকে বিদায় জানায়। ব্যবহৃত দড়িটি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে মৃত ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। যদি কেউ এই বিদায় অনুষ্ঠানে না আসে তবে তার প্রতি মৃত ব্যক্তি অভিশাপ দিতে থাকে। এতে উক্ত ব্যক্তির জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে মৃতদেহকে কবরে রেখে আসা হয় এবং তার আত্মা আলাদা হয়ে যায়।
তাদের বিশ্বাস অনুসারে, জগতের সবকিছু ‘সমান্তরাল’ভাবে চলমান। দিনের বিপরীতে রাত; দিন ও রাত দুটি আলাদা জগতের প্রতিচ্ছবি। একদিনে মোট ২৪ ঘন্টা, যা ১২ ঘন্টা করে দুই ভাগে বিভক্ত; মানুষের আগমন ঘটে দিনের প্রতিচ্ছবি হিসাবে, মানুষ বিদায় নেয় রাতের প্রতিচ্ছবি হিসেবে। এই উভয় জগতের দরজা বছরে একবার খুলে যায়। তখন মৃতদের আত্মারা নতুন শিশুদের মানব জগতে প্রেরণের প্রস্তাব পাঠায়, তারা সেদিন যাদের যাদের নির্দিষ্ট করে দেয় তারা সামনের এক বছর যাবত মানুষ রূপে জগতে আগমন করতে থাকে। মাহ মেরিরা তাদের নিজস্ব হিসাব অনুসারে এই দিনটিকে বের করে নেয় এবং সেদিন উৎসবের আয়োজন করে।
তাদের প্রথা অনুসারে পুরুষদের মতো নারীরাও একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারবে। তারা মনে করে, যৌনতার অধিকার সবার জন্য সমান; এখানে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য নেই। তবে তাদের বিবাহ প্রথা অত্যন্ত জটিল। বিবাহের জন্য সর্বমোট ৭ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়; এবং এর জন্য সময় ধার্য থাকে মাত্র ৪ দিন। এই ৭ ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সবচেয়ে জটিল কাজ হচ্ছে কন্যা বাছাই। অনেকজন যুবতী কন্যাকে একত্রিত করে তাদের সারা দেহ ঢেকে রেখে শুধুমাত্র হাত বের করে রাখা হয়। উক্ত হাত দেখেই ছেলেকে কন্যা বাছাই করতে হয়। এ সময়ে ছেলের জন্য আরও নানা ধরনের ধাঁধাঁ তৈরি করা হয়। হাত দেখে যাকে পছন্দ করা হয় অনিবার্যভাবে তাকেই বিয়ে করতে হয়।
আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে দাঁতে ধার দেয়া। মাহ মেরিদের বিশ্বাস, এর কারণে তারা মারা গেলে তাদের সন্তানরা তাদের আত্মাকে খেয়ে ফেলতে চাইবে না; তাদের আত্মা শান্তিতে থাকবে। আনুষ্ঠানিকতার তৃতীয় দিন তাদের পবিত্র করা হয় এবং সর্বশেষ দিন তাদের উভয়কে দুটি আলাদা সিংহাসনে বসানো হয় এবং বিবাহ সম্পন্ন হয়। সাধারণ তখন উভয়ে উভয়ের হাতে একগুচ্ছ ফুল তুলে দিয়ে একত্রে মিলিত হয়।
তবে এতকিছুর পরেও সবচেয়ে রহস্যময় হচ্ছে তাদের পোশাক। বিভিন্ন গাছের পাতার সমন্বয়ে তারা অদ্ভুত একধরনের পোশাক তৈরি করে। গাছের পাতা দিয়ে বিভিন্ন অলংকারও তৈরি করে। সর্বোপরি তারা তাদের আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের নামকরণের সার্থকতা রক্ষা করে; অর্থাৎ তারা যে ‘জঙ্গলের অধিবাসী’ তা তাদের পোশাকে ফুটে ওঠে। তবে তারা কিন্তু এখন আর প্রকৃতপক্ষে কোনো জঙ্গলের অধিবাসী নয়; হয়তো তাদের আদিপুরুষদের সময়ে অত্র অঞ্চল পুরোপুরি জঙ্গল ছিল।
বর্তমানে মাহ মেরিদের আবাসস্থল ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছেও রহস্যময় জায়গা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রচুর পর্যটক প্রতিবছর সেখানে ভ্রমণ করেন। মালয়েশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও তারা তাদের নৃত্য প্রদর্শন করতে যান। তারা কাঠ দিয়ে মুখোশ তৈরি করার ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ। বর্তমানে মুখোশ তৈরি তাদের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। তারা তাদের স্বকীয়তা নিয়ে টিকে থাকুক এটাই আমাদের কামনা।
ফিচার ইমেজ: mmcv.org.my