আমি সবুজ ঘাস বিছানো একটি সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছি। সেখানে বাতাসের ভারি প্রবাহে ঘাস, লতাপাতাগুলো একই সমন্বয়ে দুলছে, যেন দৃশ্যমান অর্কেস্ট্রার ঐকতান। এই বাতাস একই সাথে কানে বহমান সামুদ্রিক গুঞ্জনের ধাক্কাও দিচ্ছে। আমি সামনের বিস্তৃত জলের সমারোহে তাকালাম। দিগন্তের অস্তায়মান সূর্য তার কমলাভ রশ্মি সমুদ্রের নীলে ভেজাতে চাইছে যেন। এই সমস্ত নীলরঙা পানি শুধুমাত্র আমার নৌকার পাটাতনেই ভিজেছে, আমিই ছিলাম তার জল চিরে যাওয়া একমাত্র নাবিক। আমার বীণার সুরে তার হৃদয়ের সমগ্র দীর্ঘশ্বাস বাতাসের প্রবাহে রুপ নিয়েছে এবং পথ দেখিয়েছে আমার নৌকার পালকে। আমি এক তরবারিযোদ্ধা, এক তান্ত্রিক, এক অতি সাধারণ কারিগর যে তার অপহৃত ভালোবাসাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বই মানুষকে কল্পনা করা শেখায়, সিনেমা কল্পনার একটি প্রতিচ্ছবি দেখায় আর ভিডিও গেম সে-ই কল্পনা ও প্রতিচ্ছবিকে অনন্য অভিজ্ঞতায় রূপদান করে।
১৯৯৪ সালের আগে ভিডিও গেমকে শুধুমাত্র ‘টাইম কিলার’ হিসেবে দেখা হতো। কারণ গেমের প্রধান অডিয়েন্স ছিল ধনী পরিবারের কিশোর বয়সী ছেলেরা। এ কারণেই অনেকে এই মাধ্যমটিকে ডিজিটাইজড খেলাধুলার বাইরে অন্যকিছু ভাবতে পারেন না। তাদের যুক্তিটি এরকম: যদি দাবা অথবা বাস্কেটবলকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা না করা যায় তাহলে ভিডিও গেমকেও শিল্প বলা অযৌক্তিক। এই দলের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো বক্তব্য ছিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্টের। ২০০৬ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি উন্মুক্তভাবে ভিডিও গেমকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। তার ব্লগে ‘Video Games Can Never Be Art’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন,
No one in or out of the field has ever been able to cite a game worthy of comparison with the great poets, filmmakers, novelists and poets.
ভিডিও গেম শিল্পটি একটি পোস্টমডার্ন মাধ্যম। তাই একে অন্যসব পোস্টমডার্ন শিল্পের মতো একই দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে। আশি বছর আগে গেম আবিষ্কারের পর থেকে কতটুকু বিবর্তিত হয়েছে তা একবার দৃষ্টিপাত করলেই বুঝা যায়। অবশ্য সব গেমকেই ঢালাওভাবে শিল্পের রাজমুকুট পরাতে হবে না। সব গেম সেই যোগ্যতা রাখেও না। তবে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে বাজে পেইন্টিং এবং অখাদ্য বই ও চলচ্চিত্রের সংখ্যাও পৃথিবীতে নেহায়েত কম নয়।
একটি মাধ্যমকে কখন শিল্প বলা যায়? কী কী যোগ্যতার ভিত্তিতে মাধ্যমটি শিল্পের সংজ্ঞা উৎরে যায়? অথবা আরো সহজভাবে জিজ্ঞেস করলে, শিল্প কী? শতাব্দীজুড়ে শিল্পের ধারণা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হলেও তার উদ্দেশ্য বেশিরভাগ সময়েই অনেকটা একইরকম ছিল। শিল্প বাস্তবতাকে রূপায়িত করে, মানুষের মধ্যে চিন্তা ও অনুভূতির বিনিময় করে, সৌন্দর্যবোধ তৈরি করে, ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লেষণ করে এবং এইসব কিছুই করে মাধ্যমের নিজস্ব নিয়ম-কানুন ও ভাষাশৈলীর মাধ্যমে। অ্যারিস্টটল বলেছেন,
শিল্পের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বস্তুর বাইরের রূপটি চিত্রায়িত করা নয় বরং তার ভেতরের তাৎপর্যও প্রকাশ করা।
একজন ডিজাইনার ও শিল্পীর মধ্যকার একদম প্রাথমিক পার্থক্যটি হচ্ছে শিল্প (Art) ও নৈপুণ্যের (Craft) পার্থক্য। কোনো ডিজাইন সৃষ্টিশীল হতে পারে ও শিল্পের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে কিন্তু সব ডিজাইনই শিল্প নয়; মৌলিকভাবে প্রতিটি ডিজাইনই একটি নৈপুণ্য। একজন সাধারণ ডিজাইনার নতুন কিছু তৈরির সময়ে প্রশ্ন করেন, ‘এই ডিজাইন দিয়ে কীভাবে সবচেয়ে বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যাবে?’ এখানে লক্ষণীয় যে তার সমসাময়িক শিল্পীদের কেউ এইভাবে চিন্তা করেন না। কারণ হচ্ছে, শিল্পীরা শিল্প তৈরির প্রবৃত্তি থেকে সৃষ্টি করেন। ডিজাইনাররা তৈরি করেন তার ডিজাইন বিক্রির তাগিদ থেকে। একেবারে মূলে, এই প্রবৃত্তিই সাধারণ ডিজাইন এবং নৈপুণ্য থেকে শিল্পকে আলাদা করে দিয়েছে।
ভিডিও গেম হচ্ছে একটা মাধ্যমের মাধ্যম। এখানে সুরকার সংগীত রচনা করেন, আর্টিস্ট টুডি ছবি ও থ্রিডি মডেল সৃষ্টি করেন। লেখক গল্প ও সংলাপের খসড়া লিখেন আর প্রোগ্রামাররা সমগ্র চলন্ত অংশটাকে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিপুণভাবে কোরিওগ্রাফ করেন। প্লেয়ার বা গেমের অডিয়েন্স সরাসরি এই গেমে অংশগ্রহণ করেন। তারা গেমের দুনিয়ার সাথে সক্রিয় হয়ে উঠেন; উভয়পক্ষের মধ্যে এভাবে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
শুধুমাত্র সুন্দর একটি ভার্চুয়াল দুনিয়াতে নিমজ্জিত করার ক্ষমতা থাকার ফলেই কিন্তু ভিডিও গেমকে শিল্প উপাধি দিয়ে দেওয়া যায় না। সত্যি বলতে বেশিরভাগ গেমই এককভাবে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। অর্থ উপার্জনের সাথে শিল্পের কোনো বিরোধ নেই কিন্তু যদি মৌলিক উদ্দেশ্যই অর্থনৈতিক হয়ে উঠে তখন শিল্প সৃষ্টির তাড়না দূর্বল হয়ে পড়ে। এমন ভিডিও গেম রয়েছে যেগুলো অডিয়েন্সকে চুম্বকের মতো আটকে রাখে, তাদের মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করে রাখতে চায়। এমনও ভিডিও গেম রয়েছে যা শিল্পকে পরিব্যাপ্ত করতে চায় নতুন রূপে; তার অডিয়েন্সদেরকে এমন অভিজ্ঞতা দিয়ে মগ্ন করে রাখতে চায় যা মোজার্ট কিংবা মন্যের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সৌন্দর্যবোধের মূল্য বিচার করে ডেভিড বেস্ট খেলাকে বিভক্ত করেছেন। বেজবল, হকি, বাস্কেটবল দেখার সময় আমরা সুন্দর খেলাগুলোতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। কিন্তু তখনও খেলোয়াড়দের নান্দনিক মাপকাঠিতে মাপা হয় না। অন্যদিকে জিমন্যাস্টিকস, ডাইভিং ও ফিগার স্কেটিংকে অনেকক্ষেত্রে শিল্পরুচি দিয়ে বিচার করা হয়। ‘দ্যা ফিলোসফি অব হিউম্যান মুভমেন্ট’ বইয়ে ডেভিড বেস্ট বলেছেন,
একটি নান্দনিক খেলা হচ্ছে তা যেখানে অর্জনের ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য স্বাধীনভাবে বিশেষায়িত করা যায় না।
অনেকে এই খেলাগুলো নৃত্যের সাথে তুলনা করেন। সেদিক থেকে এগুলো শিল্প বা তার কাছাকাছি কিছু।
ডেভিড বেস্ট তার বইয়ে শিল্পের সাথে খেলাধুলার একটি বড় পার্থক্য তুলে ধরেছেন। প্রচলিত খেলাগুলো মানুষের জীবন, চিন্তা ও ধারণার প্রতিনিধিত্ব করার একেবারে মৌলিক নির্ণায়কগুলো বহন করেনা। শিল্পের সাথে এই পার্থক্যটি এভাবেই বড় হয়ে উঠে,
whereas sport can be the subject of art, art could not be the subject of sport. Indeed, the very notion of a subject of sport makes no sense.
এদিক থেকেই ভিডিও গেম সাধারণ খেলাধুলার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে শিল্পের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এক্ষেত্রে একটি আপত্তি আসতে পারে যে খেলাধুলা প্রতিযোগিতামূলক। ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে অভিযোগটি আরো তীব্র; সম্ভবত শ্যুটার গেমগুলোর কারণে। প্রতিযোগিতাকে অনেকে শিল্প সৃষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর হিসেবে দেখেন কারণ সেখানে জেতার উদ্দেশ্যটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রতিযোগিতা ও শিল্প একে অপরকে অস্বীকার করে না। গ্রীক ট্র্যাজেডিগুলো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো। একজন কবি তার শিল্পরুচি ব্যাহত না করে কন্টেস্টে অংশগ্রহণের জন্যে কবিতা লিখতেই পারেন। আধুনিক যুগের অস্কার বা ফিল্ম উৎসবগুলো এরকম একটি উদাহরণ।
তবে ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে অনেকের অভিযোগ: এখানে অডিয়েন্স অনেকটা প্রতিযোগিতামূলক একটা পরিবেশে ঢুকে পড়ে। এই অভিযোগটি সব গেমের জন্যে সত্য নয়। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে আমরা কি বই পড়া বা সিনেমা দেখার সময়ে মূল চরিত্রকে তার মিশনে সফল হওয়ার জন্যে সমর্থন দিই না? হ্যামলেট তার বাবার হত্যাকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গেলে তাকে সমর্থনের জন্যে অডিয়েন্সকে কি প্রণোদনা দেওয়া হয়নি? তাতে করে হ্যামলেটের শিল্পমান কি ক্ষুণ্ণ হয়েছে?
ভিডিও গেমকে শিল্পমাধ্যমে পরিণত করার এই প্রচারণা প্রধানত স্বাধীন ডেভেলপার স্টুডিওগুলোর জন্যেই জোরালো হয়ে উঠেছিল। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউনিটি, ইনফর্ম এবং টোয়াইনের মতো বিনামূল্যের ডেভেলপমেন্ট টুলগুলো। এমিলি শর্ট, জন ইনগোল্ডের মতো লেখকরা প্রতিনিয়ত চমকপ্রদ কাজ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, হিডেও কোজিমার মতো ডিজাইনাররা গেম আর সিনেমাকে একত্রিত করে ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন কাজ উপহার দিচ্ছেন। এরকম কিছু গেম হচ্ছে প্লেয়েবল টিজার, ডিয়ার এস্থার, ফ্যাটালে।
অনেক গেম ডেভেলপারও রয়েছেন যারা ভিডিও গেমকে শিল্পমাধ্যম হিসেবে দেখার বিরোধিতা করেন। তারা একে শুধুমাত্র খেলার একটি রূপ হিসেবেই দেখেন। কিন্তু অনেক তাত্ত্বিক যেমন: জ্যানেট মুরে মনে করেন ভিডিও গেমগুলোকে তাদের শিল্পগত সামর্থ্য সম্পুর্ণ বিকাশ করার জন্যে গল্পভিত্তিক পথেই হাঁটা উচিত। অনেক গেম ডেভেলপারই এই পথ অনুসরণ করেছেন। আর বর্তমান যুগে অনেক গেমেই এমন ন্যারেটিভ রয়েছে যা সিনেমার ন্যুয়ার প্লটগুলোর মতোই জটিল।
গেম ডিজাইনাররা গল্প বর্ণনাকে শক্তিশালী রূপ দেওয়ার জন্যে সিনেমার মতোই অনেকগুলো উপাদান ব্যবহার করেন। এরকম একটি উপাদান হলো কাটসিন। বড় কোনো ঘটনা বা এপিসোডের মাঝে চরিত্রগুলোকে মানবিক করে তুলতে কাটসিন ব্যবহার হয়। এটি ব্যবহারের অন্য আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্লেয়ারকে গল্প এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নতুন মিশনের সাথে পরিচিত করে দেওয়া যায়। আধুনিক গেম ডিজাইনাররা অ্যানিমেটর, লেখক, সেট ডিজাইনার, আর্ট ডিরেক্টরের মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পগুলোর সাথে গভীরভাবে যুক্ত। কারণ এই একই উপাদানগুলো গেমেও প্রয়োগ করতে হয়। ভিডিও গেমের ভার্চুয়াল দুনিয়া তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ যার মধ্যে লেভেল ম্যাপ তৈরি, লাইটিংয়ের উৎস, ভিজ্যুয়াল টেক্সচার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
সিনেমার মতোই গেম ডিজাইনও তাই ব্যয়বহুল সমন্বিত প্রজেক্ট। কয়েকজন ভিডিও গেম ডিজাইনার রয়েছেন যারা নিজেদের সৃজনশীলতার অনন্য ছাপ রেখে গেছেন। এরকমই একজন প্রসিদ্ধ গেম নির্মাতা হচ্ছেন শিগেরু মিয়ামোতো যিনি মারিও ব্রাদার্স, দ্যা লিজেন্ড অব জেলডার মতো নিনটেন্ডোর জনপ্রিয় গেমগুলোর স্রষ্টা। আধুনিক গেমগুলোতেও তার অনিবার্য প্রভাব দেখা যায়।
ইতিমধ্যেই একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভিডিও গেম জাদুঘরগুলোর স্বীকৃতি পেয়েছে। অনেকগুলো জাদুঘরে ভিডিও গেম এক্সিবিশন শুরু হয়েছে। স্মিথসোনিয়ান, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের মতো মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরগুলোতে এরকম এক্সিবিশন চলছে। এমআইটি, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কার্নেগি মেলন, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ার উপর পড়ালেখা চলছে। জর্জিয়া টেকে একই বিষয়ের উপরে পিএইচডিও প্রোগ্রামও চালু হয়েছে। তাছাড়া এমটিভি নেটওয়ার্ক, ব্রিটিশ একাডেমি (বাফটা) ভিডিও গেমের জন্যে আলাদাভাবে পুরষ্কার দেওয়া শুরু করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ভিডিও গেম রিভিউ করার জন্যে রয়েছে আলাদা বিভাগ। এভাবে সবরকম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমেই এটি মূল্যায়ন পাচ্ছে ও নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।
রজার এবার্ট বলেছেন:
One obvious difference between art and games is that you can win a game. It has rules, points, objectives, and an outcome. [Someone] might cite a immersive game without points or rules, but I would say then it ceases to be a game and becomes a representation of a story, a novel, a play, dance, a film. Those are things you cannot win; you can only experience them.
ভিডিও গেমের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘পয়েন্ট অর্জন’ বা ‘জেতা’ বলতে কী বোঝায় রজার এবার্ট তা উপলদ্ধি করতে পারেননি। এই মাধ্যমটির বাইরে থেকে যারা সমালোচনা করেছেন তাদের সবাইকেই প্রতিনিয়ত এরকম ভুল করতে দেখা যায়। বেশিরভাগ ভিডিও গেমের চোখে ‘জেতা’ হচ্ছে গল্পের সমাপ্তি যা অনেকটা সিনেমা দেখে বা বই পড়ে শেষ করার মতো। তবে তাদের সাথে গেমের পার্থক্য হচ্ছে গল্প শেষ হওয়ার পরে প্লেয়ার বিশেষ সামর্থ্য অর্জন করে যার মাধ্যমে গেমের যে কোনো ভার্চুয়াল জায়গা এবং ন্যারেটিভ ইচ্ছামতো ভ্রমণ করা যায়। যেমন: ‘The Legend of Zelda: Ocarina of Time’ শেষ করার পরে প্লেয়ার ইচ্ছামতো পাহাড়ের চূড়ায় ভ্রমণ করতে পারবে। যেখান থেকে নিচের প্রান্তরে বাতাসের ঢেউ উপভোগ করা যায়। এভাবে ভিডিও গেম সিনেমা এবং বইয়ের চেয়েও বেশি অভিজ্ঞতামূলক হয়ে উঠেছে।
শিল্প কি যদি তা একটা প্রতিরূপ বা বর্ণনার অভিজ্ঞতা না হয়? ইতিহাসে এরকম শিল্প আন্দোলন ছিল যেখানে শিল্পীরা আগের যুগের নিয়মকানুন ও উদ্দেশ্যকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। ভিডিও গেমের ক্ষেত্রেও এরকম নিয়ম রয়েছে যদিও অনেক ক্ষেত্রে তা এখনো অপরিণত। এই নিয়মগুলো শিল্পকে ব্যাখ্যা বা সমালোচনা করার অপরিহার্য নিয়মের মতো। শিল্প বুঝতে হলে একজনকে তার সাথে ঠিকঠাক যোগাযোগ করে তার প্রকৃতি বুঝার চেষ্টা করতে হয়, এমনকি তা অবচেতনভাবে হলেও। শিল্প বুঝতে গেলে তার সঠাক অনুবাদ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
রজার এবার্ট তার প্রবন্ধে পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে কিছু শব্দ নিয়ে খেলেছেন। পরবর্তীতে যখন তিনি নিজের উক্তি কিছুটা সংশোধন করে বলেছিলেন, “ভিডিও গেম কখনোই হাই আর্ট বা উন্নত শিল্প হতে পারবে না” তখনও এই শব্দের খেলার অব্যাহতিই দেখা যায়। ‘হাই আর্ট’ একধরনের অস্পষ্ট শব্দ যার সরাসরি কোনো সংজ্ঞা নেই। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইম্প্রেশনিজম শিল্প আন্দোলন ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব আর্টকে একরকম নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে শুরু করে শিল্পকে ব্যক্ত করার জন্যে যেসব নিয়ম-কানুন একরকম আদর্শ হয়ে উঠেছিল ইম্প্রেশনিস্টরা সেগুলোর ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তখনকার প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও সমালোচক তাদের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, ইম্প্রেশনিস্টরা প্রকৃত অর্থে শিল্পী নয়, বাচ্চাসুলভ পেইন্টিং করে তারা অপরিণত কাজ প্রদর্শন করছে। কিন্তু আজকের দিনে সবাই দল বেঁধে ক্লদ মন্যের পেইন্টিং দেখতে যায় এবং মুগ্ধতায় হতবাক হয়ে পড়ে। সব জায়গায়ই ইম্প্রেশনিজম এখন ‘হাই আর্ট’ হিসেবে সমাদৃত। এমনকি পরবর্তীতে যারা ইম্প্রেশনিস্টদের জায়গা কেড়ে নিয়েছিলেন তাদের কাজও এখন ‘হাই আর্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সত্যি বলতে, পুরনো শিল্পের বিপরীতে গিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার প্রচলন পোস্টমডার্ন যুগে এসে এমন রুপ নিয়েছে যে অনেক সাধারণ মানুষ পোস্টমডার্ন আর্ট দেখে বুঝতেই পারে না তা কীভাবে শিল্প হতে পারে!
কিছু উদাহরণ
তিনজনের সৃষ্ট সমন্বয়ে ভিডিও গেমের অকৃত্রিম রূপটি ফুটে উঠে। একজন হচ্ছে যিনি গেমটির নির্মাতা, একজন হচ্ছে অডিয়েন্স এবং বাকিজন হচ্ছে স্বয়ং গেমটি। যারা প্লেয়ার বা অডিয়েন্স তারা নির্মাতার সৃষ্ট গেমটিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। গেমটির ভার্চুয়াল দুনিয়ার নিজস্ব নিয়ম ও যুক্তি প্লেয়ারকে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলো আবার প্লেয়ারভেদে বিভিন্ন হতে পারে। একইভাবে প্লেয়ারের সিদ্ধান্ত এবং অভিজ্ঞতা একান্তই তার ব্যক্তিগত হয়ে উঠে। নির্মাতার গল্প ও গেমের দুনিয়া উভয়ে মিলে এভাবে অডিয়েন্সের বিভিন্ন অনুভূতি, চিন্তা ও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
তত্ত্ব নিয়ে অনেক কথা হলো। এবারে কিছু গেমের উদাহরণ দেওয়া যাক যা পোস্ট মডার্ন শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। এরকম অনেক গেম রয়েছে যেগুলো শুধুই অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক, যেখানে কোনো স্কোর বা ফাইট নেই। এই গেমগুলোকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করাটা সহজ। তাই ফাইট রয়েছে এরকম গেমের উদাহরণ দেখালে উদাহরণটি জোরালো হবে।
এডমন্ড ম্যাকমিলেন নামের একজন ডেভেলপারের তৈরি গেম ‘The Binding of Isaac’। এই গেমে প্লেয়ার আইজ্যাক নামের একজন বালকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলে। আইজ্যাক তার মায়ের কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। তার কারণ হচ্ছে তার মা কোনোভাবে প্রণোদিত যে ঈশ্বর তাকে নিজের ছেলেকে হত্যার তাগিদ দিচ্ছেন। ছুটে বেড়াতে গিয়ে আইজ্যাক বেজমেন্টের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। এভাবে তার মায়ের গর্ভাশয়ের মতো প্রতীকী অনেকগুলো লেভেল পার হয়ে সে নরকে প্রবেশ করে। পুরো গেমজুড়েই প্লেয়ারকে বিভিন্ন রকম শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে হয়। এই যুদ্ধে অদ্ভুতভাবেই যুদ্ধের অস্ত্র হচ্ছে তার চোখের পানি। গেমটিতে প্রায় ৪০০ ধরনের আইটেম রয়েছে। যার মধ্যে মৃত বিড়াল, একটি ছিন্ন বাম হাত, পোলারয়েড ফটো, মারিয়ো গেমের একটি মাশরুম, পেন্টাগ্রাম থেকে শুরু করে মুকাভিনয়ের একটি বাচ্চা পর্যন্ত দেখা যায়।
গেমের মধ্যে আইজ্যাকের সবগুলো শত্রুরই তার চেহারার একটা সংস্করণ রয়েছে। এই গেমের সবগুলো আইটেমই গল্পের রেফারেন্স অথবা ম্যাকমিলেনের নিজের জীবন ও বিশ্বাস থেকে নেওয়া। মৃত বিড়ালটি তার প্রিয় পোষা বিড়ালের রেফারেন্স। তার দাদি তাকে একবার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, তিনি তার বাম হাতের শৈল্পিক সামর্থ্যের চেয়েও বড় কিছু; ছিন্ন হাতটি সে ঘটনার একটি রেফারেন্স। এগুলো অবশ্য তিনি সরাসরি প্রকাশ করেননি। নিজের ব্লগে ভক্তদের প্রশ্নের উত্তরে তা জানিয়েছেন। এভাবে প্রতীকীভাবে তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক গেম তৈরি করেছেন।
আরেকটি গেম হচ্ছে ‘Journey’ যেখানে প্লেয়ার অনেকটা আত্মার মতো ভেসে বেড়ানো একটি চরিত্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। দূরের একটি পাহাড়কে গন্তব্য ধরে যাত্রা শুরু হয়। এই ভ্রমণে অন্য আরো প্লেয়ারের সাথে তার দেখা হতে পারে যেখানে তারা একে অপরকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু তাদের যোগাযোগের একমাত্র উপায় হচ্ছে সংগীত, যার মাধ্যমে মরুভূমিতে পুরনো নেতিয়ে যাওয়া কাপড়কে উজ্জ্বল লাল রঙে পরিণত করা যায়। এই কাপড় বিভিন্নভাবে গেমের দুনিয়াকে প্রভাবিত করে যার সাহায্য নিয়ে প্লেয়ার একেকটি লেভেল সমাপ্ত করতে পারে। গেমটি বিস্তীর্ণ মরুভূমির মাঝে নিজের ক্ষুদ্র উপস্থিতির একটি পরাবাস্তব অনুভূতি দেয়। যাত্রার মাঝে প্লেয়ার একসময়ের সমৃদ্ধ অনেকগুলো শহরের ধ্বংসাবশেষের সম্মুখীন হয় যা ধুলোঝড়ের মাঝে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চরিত্রটির একাকীত্বের মাঝে এরকম প্রাচীন জনপদের শতবছরের স্মৃতিচিহ্ন নিজের প্রজাতির অতীতের জন্যে হৃদয়কে সকরুণ করে তোলে; নেপথ্যে যুক্ত হয়েছে এর মোহনীয় সংগীত।
সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখক নিইল ড্রাকম্যানের ‘The Last of Us’ গেমের ন্যারেটিভে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। গেমটি জোম্বি আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীবিত মানুষদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকা একটি সমাজকে দেখায়। বেঁচে থাকা যেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নৈতিকতা সেখানে বিলীন হওয়ার পথে। মূল চরিত্র জো’ল এরকমই এক সময়ে এলি নামের এক কিশোরীকে বোস্টনে পাচার করার দায়িত্ব পায়। জো’ল এবং এলি দুইজনেরই বিষণ্ণ অতীত রয়েছে যা প্রতিনিয়ত তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্লেয়ার প্রধানত জো’লের নিয়ন্ত্রণ রাখলেও এলির সাহায্য ছাড়া লেভেলগুলোর কাঠিন্য বেড়ে যায়। বিভিন্নভাবে এলির সাহায্য তার প্রতি প্লেয়ারের সহমর্মিতা গাড় থেকে গাড়তর করে তোলে। এভাবে গেম মেকানিক্সের সাহায্যে একজন মানুষের সাথে প্রতিনিয়ত কাটানো সময়ের মাধ্যমে পরস্পর একাত্ম হওয়ার অনুভূতি তৈরি করা হয়েছে। গেমটি ইতিমধ্যেই ইতিহাসের সবচেয়ে বিক্রিত গেমগুলোর তালিকায় যুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়। জিটিএ ফাইভ, বায়োশক ইনিফিনিট, টুম্ব রেইডারের মতো গেমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে বর্ষসেরা গেম নির্বাচিত হয়েছিল। সিনেমা ও টিভি সিরিজের লেখক, সমালোচকরাও গেমটির প্লট ও ন্যারেটিভে মুগ্ধ হয়েছেন।
সম্প্রতি এইচবিও ‘The Last of Us’ এর একটি টিভি সিরিজ তৈরির ঘোষণা দিয়েছে যেখানে নির্মাতা ও লেখক হিসেবে থাকবেন স্বয়ং নিইল ড্রাকম্যান। তার সাথে যুক্ত হয়েছেন এমি পুরষ্কার প্রাপ্ত টিভি সিরিজ ‘চেরনোবিল’ এর নির্মাতা ক্রেগ মাজিন।
কোনো একটি শিল্পকে সেই মাধ্যমের স্বকীয় প্রকৃতি ও নিয়ম-কানুনের চোখে বিচার না করতে পারলে তার অনন্যতা ও মাধুর্য অনুভব করা যায়না। এই কারণেই যুগে যুগে নতুন মাধ্যমগুলো সমালোচকদের কটুক্তি শুনেছে, যেখানে উপলদ্ধির ব্যর্থতা ছিল সমালোচকদেরই। কিন্তু তাতে মাধ্যমগুলো থেমে থাকেনি, নিজেদের অসাধারণত্বের গুণে ইতিহাসে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। সৃজনশীলতার এই নতুন স্রোতের প্রাবল্যে পরবর্তীতে সমালোচকরা তাদের স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন; সে-ই শিল্পের জ্বলজ্বলে দ্যুতিতে মোহনীয় চোখে তাকিয়েছেন। ভিডিও গেম শিল্পও একই পথে এগোচ্ছে। এতক্ষণ এই লেখাটি পড়েও যদি এ সম্পর্কে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে তাকে ‘Journey’ অথবা ‘What Remains of Edith Finch’ গেম নিজে আস্বাদন করার অনুরোধ করব।