বিশ্বব্যাপী চলছে কোভিড-১৯ রোগের প্রকোপ। মহামারি চলাকালীন ঘরে থাকাই এখন বেঁচে থাকার সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। তবে ঘরে থাকলেও তো আর দৈনন্দিন নানান কাজের প্রয়োজনীয়তা কমছে না। হঠাৎ করে ঘরবন্দি হওয়ায় বিষণ্ণতাও হানা দিচ্ছে কারও কারও মনে। স্বাভাবিক জীবনযাপনগত অভ্যাস পাল্টে ফেলতে বাধ্য হওয়ায় কেউ কেউ পড়ছেন মানসিক চাপে।
মানসিক চাপের কথা বলতে গেলে, এদেশের নারীদের কথাই আসবে শুরুতে। দেশের প্রায় সকল প্রান্তেই নানাবিধ বিষয়কে ঘিরে হরেক রকম ‘ট্যাবু’ কাজ করার কারণে নারীদের নানান মানসিক চাপে থাকতে হয় অনেক বেশি পরিমাণে। যার মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো পিরিয়ড। একেবারেই প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ঘটনা হওয়ার পরও, হাজারও সংস্কারের কারণে পিরিয়ডকালীন নারীরা এদেশে সম্মুখীন হন নানান জটিলতার। এমনকি কখনও কখনও তারা মানুষের সামনে থাকতেই সংকোচবোধ করেন পিরিয়ডের সময়।
এমনিতেই পিরিয়ড নিয়ে অস্বস্তি নতুন কিছু নয় বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য, তবে লকডাউন কিংবা ঘরবন্দি অবস্থায় পরিবারের সকল সদস্য সার্বক্ষণিক বাসায় থাকায় এই অস্বস্তির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়।
কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথ কুসংস্কারের দিকে নয়, বরং প্রগতির পথে। যুগে যুগে মানুষেরই নতুন নতুন চেষ্টা ঠেলে সরিয়েছে শত সংস্কারকে। ঠিক এই বিষয়টিতেও তাই প্রয়োজন এমন কিছু উদ্যোগের, যেগুলো পিরিয়ড নিয়ে অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় অস্বস্তি কিংবা ট্যাবুগুলো দূর করতে পারে সহজেই।
পিরিয়ডকালীন নারীদের প্রয়োজন একটু বেশি যত্নের। বিশেষত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা খুবই জরুরি এসময়ে। এক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা বেশ কাজের। সেইসাথে এসময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়াও প্রয়োজন। যত সমস্যাই হোক, পরিবারের সকল সদস্যের সাথে মন খুলে আলোচনা এবং দায়িত্বগুলো ভাগ নেয়ার মতো সহজ কিছু উদ্যোগই কিন্তু সমস্ত অস্বস্তি কাটিয়ে পিরিয়ডকে সত্যিকার অর্থে খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে রূপান্তরিত করতে পারে।
পিরিয়ড চলাকালীন অনেক নারীই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বিশেষ করে জরায়ুর রোগ, ইনফেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগ হতে পারে এসময়। এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অসচেতনতা ও জরুরি বিষয়গুলো না জানা। এমনকি এসময় যে অপরিষ্কার কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করাও বিপদজনক, সেটাও অনেকের অজানা।
এতকিছুর মাঝেও কেউ কেউ আশা দেখায়। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্র্যান্ড ‘সেনোরা’ তেমনই এক প্রদীপ। শুরু থেকেই সেনোরা কাজ করছে পিরিয়ড নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য। হেল্পলাইন চালু করা, মেয়েদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও কন্টেন্টের মাধ্যমে তারা কাজ করে চলেছে। পিরিয়ডকালীন যে কোন স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের জন্য আছে সার্বক্ষণিক কেয়ারলাইন নাম্বার ০৮০০০৮৮৮০০০। ‘সংকোচ নয় সচেতনতা’ এই শ্লোগান নিয়ে তারা তাদের কাজের মধ্য দিয়ে পাল্টে দিতে চাইছে আমাদের দেখার চোখগুলোকে, ভাঙতে চাইছে কঠিন ট্যাবুগুলোকে।
সময় পাল্টানোর বিজ্ঞাপনগুলোর শুরুটি ছিল এক বাবা-মেয়ের গল্প দিয়ে। ‘ফারিয়া’ তার জন্মের সময়েই মা’কে হারায়। বাবাই তাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করে। একটা সময়ে বয়ঃসন্ধিকালে পিরিয়ড শুরু হলে বাবার সাথে তার দূরত্ব বাড়ার উপক্রম হলেও, সামাজিক ট্যাবু ভেঙে বাবা দাঁড়ান মেয়ের পাশে।
পরের বিজ্ঞাপনটিতে আসে এক দম্পতির ছবি। স্ত্রীর প্রয়োজন বুঝে নিয়ে স্বামীর স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে নিয়ে আসার গল্পটি পিরিয়ড নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে অযাচিত ট্যাবু ভাঙার কথা বলে।
করোনা মহামারির কালে মানুষের জীবন থমকে থাকলেও প্রাকৃতিক নিয়মে যথাসময়ে নারীদের জীবনে কিন্তু ঠিকই পিরিয়ড হাজির হচ্ছে। কিন্তু বাইরে যাওয়া বিপদজনক বলে দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে যাওয়াই যখন অনিরাপদ, তখন দারুণ এক সমাধান নিয়ে এসেছে সেনোরা। গত ২৮ মার্চ ‘মাসিক সুরক্ষা দিবস’ উপলক্ষে নতুন একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে আসে সেনোরা; যেখানে দেখা যায়, লকডাউন চলাকালীন পিরিয়ড শুরু হলে বোনের সুরক্ষার জন্য অনলাইনে স্যানিটারি ন্যাপকিন অর্ডার করছে তার ভাই।
ঘরে থাকার এই সময়ে যাতে কাউকে বাইরে বের হতে না হয়, সেজন্য ঘরে বসেই ন্যাপকিন কেনার দারুণ এই ব্যবস্থা চালু করেছে সেনোরা। চালডাল, প্রিয়শপ, দারাজসহ দেশের জনপ্রিয় সব অনলাইন শপেই পাওয়া যায় এই পণ্যটি।
পিরিয়ড নিয়ে লজ্জা পাওয়া আর লজ্জা দেওয়ার বিষয়টি এখনও এত প্রবল যে, অনেকেই ভাবেন, পিরিয়ড নিয়ে নারীরা কোনো কথাই বলতে পারবে না। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যান। বাইরে না যাওয়া বা আলাদা থাকার ঘটনাও ঘটে অনেক জায়গায়। আর স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজনীয়তার কথাও পরিবারের সবার কাছে বলতে পারেন না অনেক নারী। এর কারণে যদি আবার পুরনো কাপড়ের টুকরো বা ন্যাকড়া ব্যবহার করতে হয়, সেটি স্বাভাবিকভাবেই বাড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি। অধিকাংশ নারীদের ক্ষেত্রে মা-ই একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে পিরিয়ডের কথা বলা যায়। আর বাড়ির পুরুষ সদস্য- বাবা, ভাই এমনকি স্বামীর সাথেও পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি অনুভব করেন বহু নারী। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক শিক্ষার জায়গাতেও বিষয়টিকে সহজ করে তোলার বিশেষ কোনো উদ্যোগ এখনও নেই।
এমন পরিস্থিতিতে সেনোরার বিজ্ঞাপনের গল্পগুলো মানুষের মনে নিশ্চয়ই চিন্তার জন্ম দেয়। অনলাইনেই স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সুযোগটি অবশ্যই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের জন্যও নিজেদের সংস্কারকে ঝেড়ে ফেলার সুযোগ দেয়। নিজের বোন, স্ত্রী বা মায়ের পিরিয়ড যে অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়, সেটা বুঝতে পারাটাই খুব জরুরি। নিজেদের পারিবারিক সম্পর্কের জায়গা থেকে নারীর পিরিয়ড নিয়ে ভাবাটাই যে সচেতন মানুষের দায়িত্ব, সেটা অনুধাবন করতে পারলেই কেবল সম্ভব অস্বস্তির দেয়াল ভেঙে সত্যিকারের মানবিক সম্পর্কের নির্মাণ।