“পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।” হুমায়ূন আহমেদের এই উক্তিটি খুবই জনপ্রিয়। একটা সময় পর্যন্ত আমাদের অনেকেরও এই উক্তিটি ভীষণ পছন্দের ছিল। কেননা দুই-একটি ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই রয়েছে, তবু আমাদের আশেপাশে আমরা কিন্তু সারাজীবন ভালো বাবাদেরই দেখে এসেছি। আমরা দেখেছি, একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে যেমনই হোক না কেন, বাবা হিসেবে সবসময় দশে দশ। তাই হুমায়ূন আহমেদের এই উক্তিটিকে ভালো না লেগে কি উপায় আছে!
কিন্তু এখন যেহেতু আমাদের টিনেজ বয়সের সেই উথালপাথাল আবেগ আর নেই, যেকোনো বিষয় নিয়ে আমরা একটু-আধটু গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি, তাই স্রেফ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন বলেই কোনো কথা ধ্রুব সত্য, তা কি চোখ বন্ধ করে মেনে নেয়া সম্ভব? বরং এখন কি নিজেদেরও একটু তলিয়ে দেখা উচিত না? সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তারপরই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত না?
ভালো বাবা বলতে কী বুঝায়? আমরা সাধারণভাবে যেটি বুঝে থাকি তা হলো, যিনি শুধু জন্মই দেন না, বরং ছোটবেলা থেকে এমনকি পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্তও যিনি বিনা আপত্তিতে সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করে যান। সন্তানের কোনো আবদার মাটিতে পড়ার আগেই যিনি সেটি পূরণ করেন। দরকার হলে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা যিনি সন্তানের ইচ্ছাপূরণের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান। সন্তানের জন্য যিনি নিজের জীবনের ছোট-বড় সকল সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতেও কার্পণ্য করেন না। সন্তানকে সুখী রাখতে যিনি জগতের কঠিনতম কাজটি করতেও পিছপা হন না। সন্তানকে যিনি সারাজীবন বুকে আগলে রাখেন। কখনো তার গায়ে ফুলের আঁচড়টুকুও লাগতে দেন না।
হ্যাঁ, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ বাবাই এমন, যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত সন্তানের মাথার উপর শীতল ছায়াদায়ী বটবৃক্ষের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তাই বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধ যে মানুষটির মনে রয়েছে, সে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, “হ্যাঁ, আমার বাবা মানুষ হিসেবে যেমনই হোন না কেন, বাবা হিসেবে তিনি সবার সেরা।”
কিন্তু তারপরও, স্রেফ উপরের দায়িত্বগুলো যে বাবা পালন করেন, তাকেই আজ বোধহয় এক বাক্যে ভালো বাবা হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব না। বরং ভালো বাবার ধারণাটি নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
ধরুন একজন বাবা, যিনি উপরের বর্ণনানুযায়ী সন্তানের জন্য সবকিছুই করলেন, অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে ভালো বাবা হওয়ার যে শর্ত, তার সবটুকুই তিনি পূরণ করলেন। অথচ, সেই ভালো বাবাটিই কিনা, বউ পেটান! সন্তানের সামনে তার মাকে তথা নিজের স্ত্রীকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মারধোর করেন, গালি দেন। সর্বক্ষণ অপমানে অপমানে জর্জরিত করেন, উঠতে-বসতে খাওয়ার খোঁটা দেন। তারপরও কি তিনি ভালো বাবা?
কিংবা আবার ধরুন, সন্তানের ভালোর জন্য যে বাবাটি মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন, তিনিই কিনা নিজের বাবা-মায়ের খেয়াল রাখছেন না, তাদেরকে বোঝা মনে করছেন, মনে মনে তাদের মৃত্যুকামনা করছেন, বৃদ্ধ বয়সে তাদের যেসব প্রয়োজন রয়েছে তা মেটাচ্ছেন না, এমনকি হয়তো তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাচ্ছেন। তারপরও কি তিনি ভালো বাবা?
ভালো বাবাটির কর্মজগতের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। মানলাম, সন্তানকে ভালো রাখার জন্যই একজন ভালো বাবার অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সেই অর্থ আয়ের লক্ষ্যেই কিনা ভালো বাবাটি অসৎ পন্থা অবলম্বন করছেন, ঘুষ খাচ্ছেন, অন্যের পাওনাটা নিজে কেড়ে নিচ্ছেন, দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছেন, নৈতিক মূল্যবোধ পুরোপুরি জলাঞ্জলী দিচ্ছেন, ভয়ঙ্কর সব অন্যায়-অনাচার করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। তারপরও কি তিনি ভালো বাবা?
উপরের যে তিন রকম উদাহরণ দেখানো হলো, হুমায়ূন আহমেদ হয়তো তাদেরকেই সংজ্ঞায়িত করেছেন “খারাপ মানুষ কিন্তু ভালো বাবা” হিসেবে। কিন্তু না, আজ আর হুমায়ূন আহমেদের সাথে একমত হওয়া সম্ভব নয় যে তারা মানুষ হিসেবে খারাপ হলেও বাবা হিসেবে ভালো।
কেন? কারণ ভালো বাবা হওয়া মানে নিজের যাবতীয় ইতিবাচক গুণাবলী দিয়ে শুধু সন্তানকে ভালোবাসাই নয়। ভালোবাসার তীব্রতা দিয়ে কারো ভালোত্ব কখনোই পরিমাপ করা যায় না। বিশেষত একজন বাবার ক্ষেত্রে তো নয়ই।
এটি নিশ্চয়ই কারো মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয় যে একজন বাবাই হলেন সন্তানের সবচেয়ে বড় রোল মডেল। বাবাই হলেন সন্তানের কাছে সুপারহিরো। তাই ছোটবেলা থেকে সন্তান তা-ই শেখে এবং নিজের মধ্যে সংস্থাপনের চেষ্টা করে, যা সে তার বাবাকে করতে দেখে।
এখন যে সন্তানটি নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে যে তার বাবা তার মাকে মারধোর করছেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছেন, সেই সন্তান ছেলে হলে কি নিজে কখনো নারীদেরকে পুরোপুরি সম্মান করতে পারবে? নিজের স্ত্রীর প্রতি একজন ভালো স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে? বাবার অনুপস্থিতিতে সেই সন্তান কি মাকে যথাযোগ্য সম্মানটা দেবে? কিংবা সেই সন্তান যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার কি পুরুষজাতির উপর ছোটবেলা থেকেই একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে যাবে না? সে কি ছোটবেলা থেকেই মনে করতে শুরু করবে না যে, “পুরুষের কাছে নারীরা সর্বদাই অধঃস্তন, আমাকেও একদিন এভাবেই নিজের স্বামীর কাছে অপমানিত ও নিপীড়িত হতে হবে”?
আবার যে সন্তানটি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে যে তার বাবা তার প্রতি যতটা সদয়, নিজের বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি ঠিক ততটাই নির্দয়; সেই সন্তানটিও যে বড় হয়ে নিজের বাবা-মায়ের সাথে একই আচরণ করবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
আর সর্বশেষ যদি কর্মক্ষেত্রে কিংবা সামাজিক অঙ্গনে দুর্নীতগ্রস্ত, অপরাধপরায়ণ, নৈতিক মূল্যবোধহীন বাবাদের কথা চিন্তা করি। ওই বাবারাও হয়তো সন্তানের কাছে খুবই ভালো হিসেবে বিবেচিত। অথচ এ সত্যও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই যে তারা সন্তানের সামনে খুব বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। তাই একদিন তাদের সন্তানরাও যদি বিপথগামী হয়, অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে, সেটিকে কোনোভাবেই অস্বাভাবিক মনে করা যাবে না। কারণ তারা তো শুধু তা-ই করেছে, যা ইতঃপূর্বে তাদের ভালো বাবারা করেছেন!
সুতরাং এ বিশ্বাস দৃঢ়তার সাথে উপস্থাপন করা যায় যে একজন ভালো বাবা কেবল তাকেই বলা যাবে না, যিনি নিছকই তার সন্তানের প্রতি ভালো। ভালো বাবা আমরা বলতে পারব সেই বাবাকেই, যিনি স্ত্রীর প্রতি স্বামী হিসেবে ভালো, পিতা-মাতার প্রতি সন্তান হিসেবে ভালো, কর্মক্ষেত্রে যিনি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, সর্বোপরি যিনি মানুষ হিসেবে ভালো। মোদ্দা কথা, যে বাবা সন্তানের জন্য নিজেকে কেবল উজাড়ই করে দিচ্ছেন না, বরং যিনি সন্তানের জন্য এমন সব দৃষ্টান্তও রেখে যাচ্ছেন, যেগুলো অনুসরণ করে তার সন্তানও একদিন একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠবে।
অর্থাৎ ভালো বাবা হলেন তিনিই, যিনি তার সন্তানের সৎ কাজের আদর্শ, যিনি পথ দেখান তার সন্তানকে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার। আর যে বাবা তা না করেন, তিনি মানুষ হিসেবে যেমন খারাপ, বাবা হিসেবেও ঠিক ততটাই খারাপ। তাই এই লেখাটি আজ যেসব বাবা পড়ছেন, কিংবা যারা ভবিষ্যতে বাবা হবেন, তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে: ভালো বাবা হতে চাইলে অনুগ্রহ করে ভালো স্বামী, ভালো সন্তান এবং ভালো মানুষও হওয়ার চেষ্টা করুন।