আজ ২৬ জুন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ১৯৯৪ সালের আজকের এই দিনে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ মায়ের সন্তান বিয়োগের চিরন্তন যাতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে যাকে কেন্দ্র করে, তিনি হলেন জাহানারা ইমাম। শহীদ রুমির মা আবির্ভূত হয়েছিলেন লক্ষ শহীদের জননীরূপে। যিনি তাঁর সন্তানকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের স্বার্থে।
জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় এক রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মহিয়সী এই নারীকে সকলে জাহানারা ইমাম নামে চিনলেও তার ডাক নাম ছিল জুডু। রক্ষণশীল পরিবার হলেও তাঁর বাবা ছিলেন একজন আধুনিক মানুষ। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর মা সৈয়দা হামিদা বেগম।
বাবার সহযোগিতায় পড়াশোনা শুরু করেন জাহানারা ইমাম। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর চলে যান কলকাতায়। কলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে ভর্তি হন ১৯৪৫ সালে। এই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। এরপর চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট শরীফুল ইমাম আহমদের সঙ্গে জাহানারা ইমামের বিয়ে হয়। শরীফ ইমাম ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। জাহানারা ইমামের বর্ণিল কর্মজীবনের শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। শিক্ষক হিসেবে তার কর্মময় জীবনের প্রথমকাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। ময়মনসিংহের স্বনামধন্য বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮-৪৯ সাল তিনি কর্মরত ছিলেন। স্বামীর কর্মস্থল বদলের কারণে তাঁকে এ চাকরি ছাড়তে হয়। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৫১ সালে তাদের পরিবারে জন্ম হয় শাফী ইমাম রুমীর। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫২ সালে। মাঝে কিছুদিন কর্মবিরতি দিয়ে এখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক (১৯৬২-১৯৬৬) হিসেবেও কর্মরত ছিলেন তিনি। এর মাঝে জন্ম নেয় তাঁর দ্বিতীয় সন্তান জামী। ছেলেদের দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। শুরু হয় তাঁর পুরো মাত্রায় সংসার জীবন।
চার বছর পর ১৯৬৪ সালে আমেরিকা যান ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করে ফিরে আসেন ঢাকায়। ফিরে এসে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যোগ দেন অধ্যাপিকা হিসেবে। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে। একইসাথে চলতে থাকে তাঁর সংসার জীবন ও লেখালেখি।
তাঁর কর্মজীবন ছিল বেশ বর্ণিল। সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। টিভি সমালোচনা লিখেছেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছেন তিনি। টেলিভিশনে উপস্থাপনা করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী ও সুদর্শনা জাহানারা ইমাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। অবশ্য দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর এদিকে আর আগ্রহ বোধ ছিলো না।
দেশ তখন উত্তাল। শুরু হয় ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এমন সময় প্রায় প্রতিদিনই জাহানারা ইমামের সাথে দু’ছেলের তর্ক হত যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে রুমীর স্কলারশিপ হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার চিন্তা রুমির মাথায় একদমই ছিল না। তার চােখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। একটা সময় জাহানারা ইমাম তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়ার সময় একটি চমৎকার কিন্তু ভীষণ বেদনাদায়ক কথা বলেছিলেন, “যা তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম”। এমন করেই ১৯৭১ এ বাংলাদেশের হাজার হাজার মা তার সন্তানকে দেশের জন্য কোরবানী দিয়েছেন।
জাহানারা ইমামের প্রিয় সন্তান রুমী যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। ট্রেনিং থেকে ঢাকায় ফিরে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেয় রুমী। সেই সাথে নিয়মিত অংশ নিতে থাকে বিভিন্ন অপারেশনে। রুমী ও তার সঙ্গীদের একজন সহযোদ্ধা হয়ে ওঠেন জাহানারা ইমাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর সন্তান রুমী ও সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্য দেয়া, অস্ত্র আনা নেয়া ও যুদ্ধক্ষেত্রে তা পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি ছিল তার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান ভূমিকা। যুদ্ধের ফাঁকে রুমি বাসায় আসতো। যুদ্ধের বিবরণ শোনাত তাঁর মাকে। যে রুমি গ্লাসে একটু ময়লা দেখলে পানি পান করতো না, সেই রুমি যুদ্ধে গিয়ে পোকা খাওয়া রুটি খেত। এসব ঘটনা শুনতে শুনতে জাহানারা ইমামের চোখ অশ্রুতে ভরে যেত। এভাবেই ‘৭১ এর সেই উত্তাল দিনগুলো কাটতে থাকে। তারপরে আসে সেই ২৯ আগস্ট। সেই রাতেই রুমী, জামী, শরীফ ইমাম কে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়া একই রাতে ধরা পড়েন আজাদ, বদি, আলতাফ মাহমুদ সহ আরও অনেকে। পরদিন জামী আর তার বাবা ফিরে এলেও রুমীরা ফেরে না।
এরপর শুরু হয় এক অসহায় মায়ের আকুতি। জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর ছেলে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে শহীদ হয় রুমী। সন্তানের মৃত্যুতে তবু তিনি বিচলিত হননি। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের সন্তান ভেবে গোপনে তাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে থাকেন। স্বাধীনতার মাত্র তিনদিন আগে তার স্বামীও মারা যান। যুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে পতপত করে উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তাঁর সন্তান রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মযার্দায় ভূষিত হন।
‘৯০ এর দশকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও আল-বদরদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” গঠনেও তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ড-যোগ্য বলে ঘোষণা করেন। জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। তখনকার নিয়মিত দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হতে থাকে তা। পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এই মহিয়সী নারী নতুন এক পরিচয় লাভ করেন। আর তা হলো ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের মূর্তপ্রতীক’। বর্তমান প্রজন্মের নিকটও তিনি যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনের নেতা। তিনি না থেকেও তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন।
প্রাণপ্রিয় সন্তান রুমীকে ঘিরেই জাহানারা ইমাম রচনা করেন অমর গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। এছাড়াও তাঁর বেশ কিছু মৌলিক ও অনুবাদ সাহিত্যকর্ম রয়েছে। সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার’ ও ‘কমর মুষতারী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে তাঁর আরো অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। মৃত্যুর পর ১৯৯৭ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
১৯৯৪ সালের আজকের এই দিনেই ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে যাত্রা করেন। শহীদ জননীর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।
ফিচার ইমেজ: ডেইলি স্টার