১৯৬৯ সালের জুলাই মাস। স্নায়ু যুদ্ধের আতিশায্যে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার প্রাণান্ত চেষ্টায় মরিয়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারই ধারাবাহিকতায় এক দুরূহ মহাকাশযাত্রা শুরু করলো যুক্তরাষ্ট্র। গন্তব্য- পৃথিবী থেকে (গড়ে) প্রায় ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার দূরের রহস্যময় চন্দ্রপৃষ্ঠ। কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে ১৬ জুলাই তিন নভোচারীকে নিয়ে রওয়ানা হয় অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযান। আর ২০ জুলাই চাঁদের বুকে পা রাখে মানবজাতি। ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয় এক নতুন অধ্যায়।
সেই ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাইয়ের ৪৮ বছর ৯ মাস ২১ দিন পর রচিত হয়েছে আরো একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। সেই একই স্থান, যেখান থেকে উড়াল দিয়েছিল অ্যাপোলো ১১, কেনেডি স্পেস সেন্টারের সেই ঐতিহাসিক লঞ্চ সাইট থেকে উৎক্ষিপ্ত হলো বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু ১। বাংলাদেশ সময় হিসেবে, ২০১৮ সালের ১১ মে রাত শনিবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে ফ্যালকন নাইনের সর্বাধুনিক সংস্করণের রকেটে করে মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে স্যাটেলাইটটি। পৃথিবীর ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এখন থেকে উচ্চারিত হবে একটি নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হিসেবে।
স্বপ্নযাত্রার বাহন যেন বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট
প্রায় ৩, ৫০০ কেজি ভরের বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফরাসি থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানি। বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয় উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’র নামানুসারে এই স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয়েছে। প্রায় ২,৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে মহাকাশের জিওস্টেশনারি কক্ষপথে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে।
স্যাটেলাইট তৈরি শেষে গত ৩০ মার্চ একটি বিশেষ বিমানে করে ফ্রান্স থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেনেডি মহাকাশ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রতিকূলতা পেরিয়ে বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ফ্যালকন নাইন রকেটে করে স্যাটেলাইটটি ২০১৮ সালের ১১ মে (বাংলাদেশ সময়ানুযায়ী) মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। মহাকাশে স্যাটেলাইটটি রকেট থেকে পৃথক হবার পর থেকে তার জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। মূলত দুটি পর্যায়ে স্যাটেলাইটটিকে নির্ধারিত কক্ষপথে স্থাপন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে সময় লাগবে ১০ দিন আর পরের পর্যায়ে লাগবে ২০ দিন।
প্রথম পর্যায়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও প্রাক-কক্ষপথ (LEOP) অতিক্রমণ আর দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্ধারিত কক্ষপথে আনয়ন। ধাপে ধাপে এর নিয়ন্ত্রণভার বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হবে। স্যাটেলাইটটির জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে প্রধান গ্রাউন্ড স্টেশন তথা ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। স্যাটেলাইট থেকে সংকেত আদান-প্রদানে এখানে দশ টন ভরের দুটি অ্যান্টেনা স্থাপন করা হয়েছে। বিকল্প গ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে আছে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।
স্যাটেলাইটটির মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে যার মধ্যে (এখন পর্যন্ত নেওয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক) ২০টি থাকবে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ আর বাকি ২০টি ভাড়া দেওয়া হবে। চল্লিশটির মধ্যে ২৬টি হবে কেইউ ব্যান্ড (Ku Band) আর ১৪টি সি ব্যান্ড (C Band)-এর ট্রান্সপন্ডার। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার থেকে ৪০ মেগাহার্টজ হারে ফ্রিকোয়েন্সি প্রাপ্তির হিসেবে স্যাটেলাইটের মোট ফ্রিকোয়েন্সি তাত্ত্বিকভাবে ১,৬০০ মেগাহার্টজ হবে। তবে বাস্তবে কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে এই পরিমাণ ১,৪০০ মেগাহার্টজের মতো হবে বলে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের Ku Band ট্রান্সপন্ডারের আওতায় থাকবে সমগ্র বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরে তার নির্ধারিত জলভাগ। এছাড়া এই ব্যান্ডের রিজিওনাল বিমের আওতায় থাকবে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া। অন্যদিকে রিজিওনাল C Band-এর আওতায় থাকবে আরো বিশাল এলাকা। এই ট্রান্সপন্ডারগুলো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ সংকেত হিসেবে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে পাঠানো তথ্য (Up-link) গ্রহণ করবে। অতপর সেই সংকেতগুলোকে কয়েকগুণ বর্ধিতকরণপূর্বক (Amplification) পুনরায় তা ফেরত পাঠানো হবে (Down-link) পৃথিবীতে। মহাকাশে প্রতিটি স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের একটি কার্যকরী মেয়াদকাল থাকে। বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে সেটি ধরা হয়েছে কমপক্ষে ১৫ বছর।
মহাকাশের কোন ঠিকানায় থাকবে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ পৃথিবীর প্রথম জিওস্টেশনারি (Geostationary) কৃত্রিম উপগ্রহ যা কিনা আমাদের এই প্রাণবন্ত পৃথিবীর পাশাপাশি মহাশূন্যে প্রদক্ষিণ করবে। Geostationary ব্যাপারটি একটু পরিষ্কার করে সামনে অগ্রসর হই। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার উপর ভিত্তি করে ভূকেন্দ্রী কক্ষপথকে (যাকে ইংরেজিতে বলে Geocentric Orbit) প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।
১। Low Earth Orbit (LEO): এরা সাধারণত পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে ১৮০-২,০০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থান করে। গোয়েন্দা স্যাটেলাইটগুলো মূলত এই কক্ষপথে থাকে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র ও হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এই কক্ষপথের সদস্য।
২। Medium Earth Orbit (MEO): এরা থাকে ২,০০০-৩৫,৭৮০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে। গ্যালিলিও ও গ্লোনাস স্যাটেলাইট ব্যবস্থা এই কক্ষপথে আবর্তিত সতত।
৩। High Earth Orbit/Geostationary Earth Orbit (GEO): আমাদের আগ্রহের, আমাদের গৌরবের, আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এই ধরনের কক্ষপথে অবস্থিত। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট এমন একধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ যেটি পৃথিবীর নিরক্ষরেখা বরাবর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করবে। তবে ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে এর কোনো আপেক্ষিক গতি থাকবে না; অর্থাৎ পৃথিবী যেভাবে আবর্তিত (Earth’s Rotation) হচ্ছে এই ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ঠিক সেভাবেই আবর্তিত হবে। এগুলো সাধারণত ৩৫,৭৮০ কিলোমিটারের অধিক ঊর্ধ্বে মহাকাশে অবস্থান করে।
এবার, কেনেডি মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ঘুরে আসি
ফ্লোরিডার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই মহাকাশ কেন্দ্রটি ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নামানুসারে। এটি মেরিট আইল্যান্ডের এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার একরেরও অধিক জায়গা জুড়ে অবস্থিত।
এখানে অবস্থিত লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯ (LC-39) থেকে মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে প্রধানত তিনটি লঞ্চ প্যাড- ৩৯এ, ৩৯বি ও ৩৯সি। বঙ্গবন্ধু ১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক লঞ্চ কমপ্লেক্স ৩৯এ (LC-39A) থেকে। কারণ এই স্থান থেকেই ১৯৬৯ সালে নীল আমস্ট্রং, বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্সকে নিয়ে চাঁদের পানে ছুটে গিয়েছিল অ্যাপেলো ১১ মহাকাশযান।
বেসরকারি মার্কিন মহাকাশ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল নাসার কাছ থেকে আগামী বিশ বছরের জন্য লঞ্চ প্যাড ৩৯এ ইজারা নেয়। আর এই লঞ্চ প্যাড থেকেই মহাকাশের উদ্দেশ্যে ছুটে যায় বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু ১।
সংক্ষেপে জেনে নিই ফ্যালকন নাইন সম্পর্কে
স্পেসএক্সের ফ্যালকন নাইনের প্রসঙ্গ যখনই আসে তখনই তাদের (স্পেসএক্স) এলিট লেভেলের সেবাগ্রহীতা হিসেবে নাম চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নাসা, লুক্সেমবার্গভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট অপারেটর এসইএস (SES)-এর মতো মহারথীদের নাম। বাংলাদেশ এই তালিকায় ভাগ বসিয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটকে মহাশূন্যের বাসিন্দা করেছে এই ফ্যালকন নাইন। এটি দুই স্টেজের রকেটযান, যার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয় তরল অক্সিজেন (LOX) আর রকেট গ্রেডের কেরোসিন (RP-1)। এর নকশা, তৈরি ও চালনার পুরোভাগের কৃতিত্ব মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের।
ফ্যালকন নাইন উচ্চতায় প্রায় ৭০ মিটার (২২৯ ফুট) আর ব্যাসে ১২ ফুট বা ৩.৬৬ মিটার। ৫৯৭ টন ভরের এই রকেটযানের কাঠামো তৈরি হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও লিথিয়াম ধাতুর সংকর দিয়ে। এই রকেটের দুইটি স্টেজেই আছে প্রচণ্ড শক্তিশালী মার্লিন ক্লাস ইঞ্জিন। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এই রকেটের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী সংস্করণের নাম ব্লক ৫ যার মহাকাশযাত্রার সূচনা হলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। ফ্যালকন সিরিজের আগের সংস্করণগুলো দুবারের বেশি উৎক্ষেপণ কাজে ব্যবহার করা যেত না; তবে জ্বালানি সাশ্রয়ী এই ব্লক ৫ দিয়ে অন্তত ১০ বার উৎক্ষেপণ করা সম্ভব বলে স্পেসএক্স দাবি করে থাকে।
উলম্ব অবস্থায় ফ্যালকন নাইনের সবচেয়ে উপরের অংশে থাকে স্যাটেলাইট। উপরের এই অংশে ছোটোখাট একটা স্কুলবাসের সমান স্যাটেলাইট বহন করা সম্ভব। এরপরের অংশে রয়েছে স্টেজ-২; আর একদম নিচের শেষাংশের নাম স্টেজ-১। নয়টি মার্লিন ক্লাস ইঞ্জিনযুক্ত স্টেজ-১ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমের পর রকেট থেকে খসে পড়ে আর পৃথিবীতে ফিরে আসে। এই স্টেজ-১ পরবর্তীতে পুনরায় কোনো উৎক্ষেপণে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট স্টেজ-২ আর ফেরত আসে না এই ধরাধামে। সে রকেটের বাকি কাঠামোর সাথে থেকে যায় মহাশূন্যে।
পেছনে ফিরে জেনে আসি শুরুর গল্পটা
দৈনিক প্রথম আলো (১২ মে ২০১৮ সালে অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় এক দশকের প্রায় কিছু সময় আগে, ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বরাবর আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ঐ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০টি দেশ তাদের আপত্তি জানায়।
এরপর রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের অরবিটাল স্লট ১৫ বছরের জন্য ইজারা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ চাইলে এই সময় ৪৫ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করতে পারবে। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বিটিআরসি ও ইন্টারস্পুটনিকের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। একই বছরের ১১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মাণে ফরাসি প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানির সাথে চুক্তি করে বিটিআরসি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে ঘোষণা আসে যে, আসছে (২০১৭ সালের) ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হতে পারে। কিন্তু সরকারের এই পরিকল্পনায় বাধ সাধে ক্যাটাগরি পাঁচ মাত্রার প্রলয়ঙ্করী হারিকেন ইরমা। লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে ফ্লোরিডাকে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বন্ধ থাকে।
অবশেষে উৎক্ষেপণের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয় (বাংলাদেশ সময়ানুযায়ী) শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিট থেকে রাত ৪টা ২১ মিনিটের মধ্যবর্তী সময়। রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ১ উৎক্ষেপণের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছিলো। শুরুও হয়ে গিয়েছিল কাউন্ট ডাউন। কিন্তু একেবারে শেষ মিনিটের শুরুতে (T- 58 sec) এসে থমকে যায় সেকেন্ডের কাঁটা। স্পেসএক্সের ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউণ্ট থেকে জানা যায় যে, গ্রাউন্ড সিস্টেমের Auto Abort কমান্ডের কারণে শেষ মুহূর্তে এসে বাতিল হয় সেদিনের মহাকাশযাত্রা। আগামীকাল শনিবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়ানুযায়ী) পুনরায় উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারিত হয়। এবার আর ব্যর্থতা জেঁকে বসেনি কোনোভাবেই। ঠিক ঠিক ঘড়ির কাঁটা ধরে ২টা ১৪ মিনিটেই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা। মহাকাশের পথে পা বাড়ায় ৪৭ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ।
ধাপে ধাপে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
নিচের ধারাবাহিক ছবিগুলো বোঝার স্বার্থে T-Minus কথাটার সাথে পরিচিত হয়ে নেওয়া যাক। মহাকাশ বিজ্ঞানে উল্লিখিত T দিয়ে কোনো রকেট বা নভোযানের উৎক্ষেপণের একদম সূচনালগ্নকে (Startup) নির্দেশ করে। অন্যদিকে T-Plus দিয়ে উৎক্ষেপণের পরবর্তী অবস্থা নির্দেশ করে।
কী প্রাপ্তির আশায় মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট?
মর্যাদার বিষয় তো আছেই। এই স্যাটেলাইট থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হতে পারে যদি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি আমরা। দৈনিক প্রথম আলো (১২ মে ২০১৮ সালের নগর সংস্করণ, ৩য় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয়- দুটোই সম্ভব হবে এই স্যাটেলাইটের কারণে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ত্রিশটির মতো স্যাটেলাইট ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সম্প্রচারের জন্য হংকং ভিত্তিক অ্যাপস্টার-৭ নামের একটি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য এশিয়াস্যাট-৭ থেকে ভাড়া নেয়। স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় প্রায় ১৭ কোটি টাকার মতো। টাকার এই বাৎসরিক পরিমাণ এখন কমে যাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সার্ক দেশগুলোর পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও কাজাখস্তানের একটি অংশ এই স্যাটেলাইটের আওতায় পড়ার কারণে এখান থেকে তাদের সেবা গ্রহণের সুযোগ থাকছে।
তবে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আশংকা যে, এই স্যাটেলাইট দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হয়তো সেবা দিতে পারবে না। স্যাটেলাইট ব্যবস্থার কারণে এখন স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (Direct to Home) সেবার প্রসার হবে। এর ফলে তুলনামূলক কম খরচে হাই ডেফিনিশন (এইচডি) টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখা যাবে।
হাওর ও পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট সেবার সম্প্রসারণে এই স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো যাবে। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে সাতশ’র মতো ইউনিয়নে দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট সংযোগ নেই। তুলনামূলক খরচবহুল হলেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে এবার। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে হয়তো ভর্তুকি দিতে হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লেও দুর্গত অঞ্চলগুলোতে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে। এমনকি রিখটার স্কেলে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে এই স্যাটেলাইট থাকবে সব সময়ের বিকল্প ব্যবস্থা।
এই স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে নাকি গুটিকয়েক শ্রেণীই শুধু এর সুবিধাভোগ করবে এটা বলে দেবে সামনে অপেক্ষমান অজানা ভবিষ্যৎ। তবে বর্তমান আমাদের নিয়ে গিয়েছে বিশ্ব দরবারের এক অভিজাত শ্রেণীর মর্যাদার আসরে- এটুকু তো নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
ফিচার ইমেজ: Ben Cooper