“বিচিত্র জাত বেদেরা। জাতি জিজ্ঞাসা করিলে বলে, বেদে। তবে ধর্মে ইসলাম। আচারে পুরা হিন্দু; মনসাপূজা করে, মঙ্গলচন্ডী, ষষ্ঠীর ব্রত করে, কালী-দুর্গাকে ভূমিষ্ট হইয়া প্রণাম করে। হিন্দু পুরাণ-কথা ইহাদের কন্ঠস্থ। বিবাহ আদান প্রদান সমগ্রভাবে ইসলাম-ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে হয় না, নিজেদের এই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বিবাহ হয় মোল্লার নিকট ইসলামীয় পদ্ধতিতে, মরিলে পোড়ায় না কবর দেয়।”
বেদে সম্প্রদায়কে তাঁর ছোটগল্প ‘বেদেনী’তে এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। দলিতশ্রেণীর গল্প বলা এই মানুষটির বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসেই উঠে এসেছে গোষ্ঠীটির বৈচিত্রময় জীবনধারার কাহিনী।
বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকাতে বাস করে। এজন্য তাদের জলের জিপসিও বলা হয়। সাপের খেলা দেখানোর জন্যই এরা বেশি জনপ্রিয়। বেদেদের বাদিয়া, বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়। এই নামগুলোর উৎপত্তি বৈদ্য (চিকিৎসক) থেকে। প্রাচীনকাল থেকেই বেদেরা কবিরাজি, ঝাঁড়ফুঁকসহ বিভিন্ন হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে জড়িত। অনেকে অবশ্য দাবী করেন, বেদে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বেদুইন থেকে। আরব বেদুইনদের বেদেরা পরিচয় দেয় নিজেদের পূর্বপুরুষ হিসেবে।
নৃতাত্তিক পরিচয় ও ইতিহাস
নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় কিন্তু বেদেরা অনার্য। তাদের মধ্যে আরবদের সেমিটিক কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। বেদেরা সুঠাম দেহ, গভীর কালো গায়ের রঙ, কোঁকড়ানো চুল, আয়ত ও কালো চোখের অধিকারী। শারীরিক বৈষিষ্ট্য অনুযায়ী তারা আদি অস্ট্রাল বংশোদ্ভূত। তাদের এদেশে আসা নিয়ে অবশ্য অনেক ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত আছে। কারও মতে, তারা আরাকানের মনতং মান্তা নৃগোত্র থেকে এসেছে। কেউ বলে থাকেন, বেদেরা সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন অংশ। যারা পারস্যের সাথে বেদেদের সম্পর্ক খোঁজেন, তাদের মতে, বেদেরা সাত শতকে আরবের আলবাদিয়া নামক স্থান থেকে এদিকে এসেছে। অনেকের ধারণা, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে পূর্ব ভারত থেকে বেদেরা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কালক্রমে এ অঞ্চলে আসে।
সে যা-ই হোক, বেদেরা কোনো একসময় সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতিকূলতার জন্যই ঘরবাড়ির মায়া ছেড়ে বাধ্য হয় যাযাবর জীবন বেছে নিতে। শত শত বছর ধরে নদীর জীবনে অভিযোজিত হয়ে আজও তারা টিকে আছে এই ভূমিতে।
ভাষা
বেদেরা বাঙালিদের সাথে বাংলায় কথা বললেও তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। নিজেদের মধ্যে তারা ঠেট বা ঠার ভাষায় কথা বলে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, বেদেরা অস্ট্রালগোত্রীয়। কিন্তু তাদের ভাষা তিব্বতি-বর্মি (সাক-লুইশ) ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষার কোনো লিপি নেই। ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী ঠারভাষী বাংলাদেশি বেদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
ধর্মাচার
সমাজকল্যাণ দপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ বেদে মুসলিম। বেদেদের ধর্মাচার অবশ্য মিশ্র। অনেকে পীরের অনুসারী, আবার কেউ কেউ মনসা বা বিষহরির ভক্ত। ধর্মে সাধারণত বেদেদের আগ্রহ নেই। হিন্দু দেবদেবীর প্রশস্তি রচনা, বিভিন্ন পার্বণে অংশ নিলেও বেদেরা পূজা অর্চনা করে না। বাঙালি মুসলমানদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বিবাহ মুসলিম ধর্মীয় মতে হলেও বিবাহে বিভিন্ন রীতিনীতি আছে। গোষ্ঠীভেদে এসব রীতিনীতির পার্থক্য দেখা যায়। আগের দিনে মারা গেলে তাদের লাশ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো। এখনও তাদের মৃতদেহের ঠাঁই হয় কোনো পরিত্যক্ত স্থানে কিংবা নদীর কিনারায়।
সমাজব্যবস্থা
বেদেরা কৌমসমাজের রীতি পালন করে আসছে শুরু থেকেই। তাদের জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন গোত্রের মধ্যেই আবদ্ধ। প্রতিটি বেদে পরিবারের আছে নিজস্ব নৌকা। কয়েকটি নৌকা নিয়ে তৈরি হয় একটি দল। আর কয়েকটি দল নিয়ে একেকটি বহর। প্রতিটি বেদে বহরে একজন সর্দার থাকেন। বহরের নিয়মনীতি, প্রত্যেক দলের বাণিজ্যপথ ও এলাকা এসবই নির্ধারণ করেন সর্দার। বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসবে সর্দারকে দিতে হয় অর্থ কিংবা বিশেষ উপহার।
বেদে সম্প্রদায়ের উপগোত্রীয় ও গোত্রীয় সর্দারও আছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের তথ্যানুযায়ী, বেদেরা ৮টি গোত্রে বিভক্ত। এই গোত্রগুলো হলো মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে। বেদেরা সাধারণত কার্তিক মাসের ৫ তারিখ থেকে অগ্রাহয়ণের ১৫ তারিখ, এই সময়ের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ বা চট্টগ্রামে একত্রে মিলিত হয়। তখন সমস্ত বহরের নেতারা মিলে গোত্রীয় সর্দার নির্বাচন করে থাকেন। বেদে জনগোষ্ঠীর গোত্রপ্রীতি প্রবল। তারা আজও সমগ্র দেশজুড়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে।
বৈবাহিক রীতিনীতি
বেদে সমাজে সাধারণত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌথ পরিবারের মতো প্রথাগুলো দেখা যায় না। বেদেনীরা স্বাধীনচেতা। বেদে যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর-কনেসহ উপস্থিত সবাই নাচগানের মাধ্যমে উৎসবে মেতে ওঠে।
বেদেদের বিয়ের চমৎকার এক রীতির কথা জানা যায়। হবু বর গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে গিয়ে বসে। তখন হবু বরকে নামাতে কনেকে কথা দিতে হয় শ্বশুর-শাশুড়ি আর সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার। তারপর বরকে আজীবন ভরণপোষণের ওয়াদা করলে তবে সে নিচে নেমে আসে। এরপর তাদের বিয়ে হয়। বহিরাগত কেউ থাকলে বেদে তরুণীরা তাদের বিয়েতে প্রলুব্ধ করে। বিয়ের পর তাকে গোত্রে রাখতে চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে বাইরের যুবক বেদে তরুণীকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে তাকে দিতে হয় ক্ষতিপূরণ।
বিয়ে করতে গেলে কনেকে অর্থ দিতে হয় বরের। বিয়ের পর স্বামী যায় স্ত্রীর সংসারে। স্বামী-স্ত্রীতে কখনো ছাড়াছাড়ি হলে সর্দারের নির্দেশে সন্তান ও সম্পত্তি দুজনকে ভাগ করে দেওয়া হয়। বেদে সমাজে বিধবা বিবাহও প্রচলিত।
বেদে পুরুষ ও নারীরা
বেদে ছেলেরা সাধারণত কাজ করে না। মেয়েরা যখন রোজগারে বাইরে যায় তখন সংসার ও বাচ্চা সামলায় তারা। বেদেনীরা কিন্তু তাদের এই অলস স্বামীদের ভীষণ ভালোবাসে। স্বামীকে দেবতার মতো মানে, সবসময় আগলে রাখে। স্বামীকে বশে রাখতে কখনো শরীরে মালিশ করে দেয় সাপের চর্বির তেল, কখনো আবার করে রাখে তাবিজ-কবজ।
বেদেনীদের পছন্দের সাপ হলো ভয়ঙ্কর, উগ্র মেজাজের কালনাগিনী। তারা চালচলন আর স্বভাবে যেন এই কালনাগিনীরই অনুকরণ করে। সাজতে ভীষণ ভালোবাসে এই মেয়েরা। কপালে টিপ আর উঁচু খোপায় ফুল গুঁজে দিয়ে, রঙিন শাড়ি পরে বেরিয়ে পড়ে দলবেঁধে। হাঁসুলি, বালা, বাজু, নোলক, পায়ের মল বা খাড়ু, বিছা এসব অলঙ্কার যুগ-যুগান্তরে আজও তাদের অঙ্গে শোভা পায়। অপূর্ব মায়াবী এই সাজের পিছে আরেকটি কারণ হচ্ছে পেশাদারিত্ব। মানুষকে আকৃষ্ট করতে তারা এই প্রসাধনের আশ্রয় নেয়।
কাজের ধরন
বেদেরা কৃষিশ্রম এবং অন্যান্য কায়িক শ্রমকে অমর্যাদার মনে করে। মেয়েরাই প্রধানত কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে যায়। এই মেয়েরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছুটে বেড়ায়। তাদের আদি সার্বজনীন পেশা হলো কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা। এছাড়া ঝাড়ফুঁক, শিঙ্গা লাগানো (কাপিং থেরাপি), ব্যথা দূর করতে গরুর শিং দিয়ে রক্ত টেনে আনা, দাঁতের চিকিৎসা, বানর খেলা, যাদু দেখানো এসব কাজ করে থাকে। গোত্রভেদে কাজের ধরন আলাদা হয়ে থাকে। সাপুড়েরা সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়। বর্তমানে অনেকেই শুটিংয়ের কাজে সাপ ভাড়া দেয়।
বাংলাদেশে আবাসস্থল
প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, ১৬৩৮ সালে বেদেরা আরাকান রাজ বল্লাল রাজার সাথে এ দেশে আসার পর বিক্রমপুরে প্রথম বসতি গড়ে তোলে। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। বাংলাদেশের বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালিতে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের পাওয়া যায়। সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেদের আবাসের কথাও জানা যায়। উল্লেখ্য, সাভারে যে বিশাল প্রান্তিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের অধিকাংশ নিজেদের মান্তা বলে পরিচয় দেয়। মান্তারা পেশায় মৎস্যজীবী। এদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মাচার বেদেদের মতোই।
বর্তমান অবস্থা
দিন বদলের সাথে বেদেদের কাজেও আসছে পরিবর্তন। চুড়ি-ফিতা, খেলনা বিক্রি, ছোটখাট ব্যবসা এসবে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। আবার অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ। বেদেদের বিরুদ্ধে চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই। বর্তমানে শহরের রাস্তাতেও এদের দেখা যায় মানুষকে বিব্রত করে টাকা তুলতে।
বাংলাদেশে প্রায় ৭.৮০ লাখ বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগের সাথে এই মানুষগুলো তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র ২০০৮ সালে বেদেদের একটি বিশাল অংশকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। নাগরিক অধিকার পেলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার নেই কোনো সুব্যবস্থা। সরকারিভাবে তাদের জন্য বৃত্তি, ভাতা ও প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন ব্যবস্থা থাকলেও বেদেরা শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। সামাজিকভাবেও এরা চরম অবহেলিত। নির্বাচনের সময় ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের সময় হয় না এই উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর কথা ভাবার।
লক্ষ্য রাখা উচিত, জীবিকার তাগিদে এই মানুষগুলো যেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে। বেদেরা তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে চায়। তাদের এই স্বাতন্ত্র্য আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজের সাথে মিশে পরিণত হয়েছে এক ঐতিহ্যবাহী অংশে।
বেদে সম্প্রদায়কে তাদের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে সহায়তার পাশাপাশি নতুন জীবিকা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্পের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবী।
ফিচার ইমেজ: protichhobi.com/m. hossain