Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জ্ঞানের তৃষ্ণায় যেভাবে কেটেছে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন

আব্দুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন, “আমাদের অক্ষর পরিচয়টা কলাপাতাতেও না, তালপাতাতেও না, তেঁতুল বিচিতে!” বোঝাই যায়, ছোটবেলায় তেঁতুলবিচি সাজিয়ে শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। তবে বয়সের সাথে পাল্লায় পেরে ওঠেনি তেঁতুলবিচি। বহরমপুর, হুগলি, রংপুর ঘুরে তেঁতুলবিচি তখন খসখসে সাদা কাগজ আর কালো কলমের রূপ ধরেছে। পিতার বন্ধু ও মুসলিম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খান বাহাদুর আব্দুল খালেকের হাত ধরে আব্দুর রাজ্জাক যখন ঢাকায় আসেন, বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমান বৌদ্ধিক সমাজের জন্য সময়টা ছিল দুই যুগের সন্ধিক্ষণ। কারণ, ১৯২৬ সালেই যাত্রা শুরু করে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ: বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। তবে, অল্পবয়সী আব্দুর রাজ্জাকের তার সাথে সম্পৃক্ততার সুযোগ ছিল না। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন পড়ালেখা করতে। সেই থেকেই ঢাকা শহর জড়িয়ে গেলো তার জীবনের সাথে। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডিক উইলসন তার ‘এশিয়া এওয়াক’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, ‘টু আব্দুর রাজ্জাক অব ঢাকা’। তিনি বনে গিয়েছিলেন ঢাকার। আরো ঠিকভাবে বললে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের!

আব্দুর রাজ্জাক; Image Source: Wikimedia Commons

আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে তার স্নেহধন্য ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, “ঢাকা ইউনিভার্সিটি ওয়াজ হিজ লাইফ।” জীবনাবসানের পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুকে যায়নি আব্দুর রাজ্জাকের সেই সম্পর্ক! তার অনুসারীদের পদচারণায় এখনও তিনি জীবিত তার প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে। আব্দুর রাজ্জাকের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সম্পর্ক, তার শুরু ১৯৩১ সালে। রমনার বুকে গড়ে ওঠা ঢাকার উচ্চবিদ্যাপীঠ তখনও হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলছে। তবে তাতে মান আর মেধার কোনো খামতি ছিল না। একঝাঁক মেধাবী ছাত্র-শিক্ষকের পদচারণায় তখন মুখর ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, হরিদাস ভট্টাচার্য, রমেশচন্দ্র মজুমদার, কাজী মোতাহের হোসেনসহ তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। তবে, ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা ছিল বেশ কম। ৬০০ জন ছাত্রের জন্য ছিলেন দেড়শোর মতো শিক্ষক। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাশ করা আব্দুর রাজ্জাক স্থির করেছিলেন ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হবেন। কিন্তু, পরবর্তীতে পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ভর্তির পর তার থাকার বন্দোবস্ত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজস্থ মুসলিম হলে। কাগজে-কলমে গাটবাঁধা পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আব্দুর রাজ্জাকের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আব্দুর রাজ্জাকের জীবন; Image Source: gonokotha.com 

১৯৩১ সালের জুলাই মাসে আব্দুর রাজ্জাক উঠে যান নবনির্মিত সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। সেসময় মুসলিম হলের পরিবেশ মোটেই এখনকার মতো ছিল না। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রভোস্ট আহমেদ ফজলুর রহমান (এফ. এ. রহমান) মুসলিম হল ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করেন, যার অনেক নির্বাচিত সদস্যই পরবর্তীতে দেশের বড় বড় কর্তায় পরিণত হন। তখনও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়নি ছাত্র রাজনীতির! প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক যে আজন্ম ছোট-বড়-সমবয়সী সকলকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, তার বীজও এখানেই বপন করা হয়েছিল। কারণ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দেখা হলে সালাম দেওয়া, সিনিয়রদের দেখলে উঠে দাঁড়ানো- এসব ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ। আদতে আব্দুর রাজ্জাক আজন্ম যেসকল বৈশিষ্ট্য লালন করে গেছেন, তার বেশিরভাগের পেছনেই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জল-হাওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্দুর রাজ্জাকের ঠাই হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে; du.ac.bd

বিস্তৃত পড়ার অভ্যাস ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। এই নিঃস্বার্থ জ্ঞানচর্চাই তার জীবনে ঘটায় বিস্তৃত গুণের সমাবেশ। এই নিরলস জ্ঞানচর্চার শুরুও হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। কথিত আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই একদিন লাইব্রেরির সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন তিনি। কিন্তু, শিক্ষার্থীদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। একদিন লাইব্রেরির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এক বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করেন, “কী চাও?” আব্দুর রাজ্জাকের সংকোচপূর্ণ দাবি ছিল, “বই পড়তে চাই।” সেই বৃদ্ধের কৃপায় লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেন আব্দুর রাজ্জাক। একসাথে এত বই তিনি কখনো দেখেননি। পাগলের মতো বই ঘাটতে শুরু করেন। শুধু বই দেখতে দেখতেই কেটে যায় প্রহর-অর্ধপ্রহর! এরপর থেকেই নিয়মিত লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়া শুরু করেন তিনি। এটা তার কাছে ছিল রীতিমতো নেশা! ইতিহাস, বিজ্ঞান, কলা, শিল্প কী ছিল না তার পাঠ্য তালিকায়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পরিণত করেছিল এক অন্তহীন জ্ঞান সমুদ্রে, যার গভীরতা মাপা যায় না, কাছে গেলে যা অনুমিত হয় তার থেকেও গভীর। নবাবগঞ্জের পাড়াগাঁয়ে জন্মানো আব্দুর রাজ্জাকের ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক’ হয়ে ওঠার শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই।

বই পড়া ছাড়াও আরেকটি নেশা ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। দাবা খেলতে ভীষণ পছন্দ করতেন তিনি। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে এই দাবার খেলার সূত্রেই তার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছরেই তিনি অধ্যাপক মোতাহার হোসেনের সাথে দাবা খেলতে গিয়েছিলেন কার্জন হলের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারে। তখন দাবা খেলার সময় বাঁচাতে মোতাহার হোসেন তাকে নিজে সাইকেল চালিয়ে সেগুনবাগিচার নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্যমতে, “তখন কাজী সাহেবের মাস্টারির বয়স হয়তো দশ বছর হয়ে গেছে। তখনকার দিনে আমরা শিক্ষক মাত্রই সমীহের ভাব নিয়ে দেখতাম। কাজেই, স্যারের সাইকেলের পেছনে চড়ার প্রস্তাব তো অদ্ভুত। কাজী সাহেব কিন্তু সরল, নিঃসংকোচ!” শুধু কাজী মোতাহার হোসেন নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো অনেক শিক্ষকের সাথেই হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার।

কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে আব্দুর রাজ্জাকের ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক; Image Source: charpatra.com

অনার্স জীবনে আব্দুর রাজ্জাক ছাত্র হিসেবে ছিলেন মোটামুটি গোছের। তার আলাপচারিতায় অনেকবারই উঠে এসেছে সেসময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাভ্যাসের চিত্র। আজকের মতো নোট পড়ে পরীক্ষায় পাশ করার অপ-অভ্যাস ছিল না তখন। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমাদের সময় নোট সম্মন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। কোনো ছাত্র নোট পইড়া পরীক্ষা দিবার লাগছে, সে যেকোনো ধরনের ছাত্রই হোক না কেন, আমাদের ধারণা ছিল না।”

নবীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাফল্য, তার পেছনে শিক্ষার্থীদের এই স্বচ্ছ পাঠাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেসময় আরেকটি ব্যাপার দেখা যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। জীবনের কোনো পূর্বলক্ষ্য স্থির করে রাখতেন না তারা। যদিও, সেই প্রজন্মের ছাত্রদের মাঝে ভবিষ্যত চিন্তার ঔদাসীন্যকে গুণের বিচারে ভাগ করেননি আব্দুর রাজ্জাক। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন উল্টো স্রোতের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই শিক্ষক হবার লক্ষ্য ছিল তাঁর।

১৯৩৪ সালে আব্দুর রাজ্জাক পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স পাশ করেন। পরের বছরেই মাস্টার্স পরীক্ষায় কেবলমাত্র লিখিত অংশের পরীক্ষা দেন। কারণ, তার ধারণা ছিল সেই বছর মৌখিক পরীক্ষা দিলে তিনি ভালো ফলাফল করবেন না। পূর্বেই বলা হয়েছে, আব্দুর রাজ্জাকের ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার। কিন্তু, সেসময় অন্যান্য সরকারি চাকরির বেতন ছিল শিক্ষকের থেকে ঢের বেশি। তাই পরিবারের সাথে আলাপের জন্য তিনি কেরানীগঞ্জ চলে যান। বাবার সাথে সেই সাক্ষাৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি বললাম বাবাকে, যদি ভাইবা দিতে কন দিতে পারি। কিন্তু, সেকেন্ড ক্লাস পাবো। কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সামনের বছর ভাইবা দিলে ফার্স্ট ক্লাস পাইতে পারি। আর তারপর ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পাইলে ২০০ টাকার বেশি মায়না হইব না। সংসারে এর বেশি তাইলে তো আমি সাহায্য করতে পারুম না। এখন আপনি যা বলেন।” বাবা পুত্রের মন বুঝলেন। তার শিক্ষক হবার ইচ্ছেয় সম্মতি জানালেন। ১৯৩৬ সালে মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষায় পুনরায় অংশগ্রহণ করলেন তিনি। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন আব্দুর রাজ্জাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষার্থী’ আব্দুর রাজ্জাকের অধ্যায় সমাপ্ত হলো।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক; Image Source: জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ

তিনি যেদিন মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন, সেদিনই তাকে পলিটিক্যাল ইকোনমি বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণীর লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় আব্দুর রাজ্জাকের নতুন জীবন। এবারের যাত্রা শিক্ষক হিসেবে!

This is a bengali article written on Dhaka University life of Professor Abdur Razzaq.

তথ্যসূত্র:

১. আব্দুর রাজ্জাক জীবনীগ্রন্থ- নাজমুল হাসান

২. যদ্যপি আমার গুরু- আহমদ ছফা

৩. সাক্ষাৎকারে সরদার ফজলুল করিম : বিষয় অধ্যাপক আবুদর রাজ্জাক- মোহাম্মদ আলী 

Related Articles