Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আলতাফের কথা বলতে এসেছি, আমাদের আলতাফ

আলতাফ মাহমুদ; এক গর্বের নাম, এক অহংকারের নাম। দেশ ও নিজের মাটিকে ভালোবেসে আমৃত্যু লড়াই করে যাওয়া এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক জ্বলজ্বলে তারার নাম। শত্রুর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিয়েছেন সেই একাত্তর সালে, তবু প্রতিদিন এ দেশের লাখো কোটি প্রাণে নতুন করে নিজের অস্তিত্বের রঙ ভরিয়ে দেন এমন এক বীরের নাম আলতাফ মাহমুদ। তবে তাঁর যুদ্ধটা ছিল সচরাচর যুদ্ধের চেয়ে আলাদা।

অস্ত্র হাতে ময়দানে নামেননি তিনি, বরং যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ  করতো তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা ছিলেন তিনি। গানের সুরে সুরে তখন মানুষের মনে দেশপ্রেম আর সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়ে দিতেন, সুরের এমন যোদ্ধা ছিলেন তিনি। এদেশের মুক্তির পথে তাঁর চেষ্টার জন্য  জন্য নিজের জীবনের সর্বোচ্চ মূল্যও পরিশোধ করে গিয়েছেন তিনি। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি যাঁর সুর আমাদের হৃদয়ে নিজেদের শেকড়ের জানান দেয়, সেই “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” গানের সুরারোপকারী আলতাফ মাহমুদের স্মরণে আমাদের আজকের এই লেখা।

কন্যার সাথে আলতাফ মাহমুদ; source: shahidaltafmahmud.com

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে যখন পাকিস্তানীরা পরাজয়ের ঘণ্টা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো, তখন তারা পরিকল্পনা করে এদেশের প্রতি এক জঘন্য প্রতিশোধ নেয়ার। তারা বেছে বেছে দেশের সোনার সন্তানদের হত্যার নীল নকশা সাজালো। তালিকা তৈরি করলো স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে জোরালো বুদ্ধিদীপ্ত কন্ঠগুলোর। তাদের এই জঘন্য পরিকল্পনাতে সাহায্য করে এদেশেরই কিছু লোভী, নপুংসক দালাল। সেই তালিকায় নাম ছিলো আলতাফ মাহমুদের।

বরিশালের এক গ্রামের ছেলে আলতাফ ঢাকায় আসেন ১৯৫০ সালে। সমগ্র ঢাকায় তখন ভাষা সংগ্রামের সুর বাজছে।  যে ভাষা শুনে ও শিখে এদেশের সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করে, সে ভাষা মুছে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। মাতৃভাষার এমন দুর্দিনে আলতাফ তো ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সেই একই বছর আলতাফ যোগ দিয়েছিলেন ধূমকেতু শিল্পী সংঘে। ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আলতাফ তখন ঢাকার রাস্তায় ও জনসমাবেশে গেয়ে চলেছেন দেশের গান, বলে চলেছেন পাকসেনাদের গুলিতে আত্মোৎসর্গ করা বাংলা ভাষার সূর্যসন্তানদের কথা। তাঁর গাওয়া গণসংগীত আন্দোলনকারীদের দেয় অনুপ্রেরণা।

আন্দোলনকে নতুন উদ্যমে উজ্জীবিত করে তোলে তাঁর সৃষ্ট ও গাওয়া দেশপ্রেমের গণসংগীতগুলো। সেই সময় থেকেই মুক্তির চেতনা তাঁর ছিলো জলের মতোই স্বচ্ছ, স্বাধীনতার পক্ষে মনোবল ছিল ইস্পাতের মতো দৃঢ়। তিনি জানতেন, ন্যায়ের আদর্শ আপোষ মানে না কখনোই । সুরের এই যোদ্ধার জীবনের গল্পটা শুরু থেকে যেন তা-ই বলে যায় বারবার। তাই তো ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিজ এলাকা মুলাদিতে মুসলিম লীগের প্রার্থী নিজের পিতা নেজাম আলীর বিপক্ষে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে সমর্থন জানান। তৎকালীন পাকিস্তানী সরকারকে অস্বীকার করে সরকারের কর্মকান্ড নিয়ে বিদ্রূপাত্মক গান বেঁধে নিজে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে রাস্তার জনসমাবেশগুলোতে গাইতেন। এরপর ১৯৬৯ সালে তাঁর সুর দেয়া “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি ব্যবহৃত হয় জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে এবং এদেশের মানুষের মনে স্থায়ী স্থান দখল করে নেয়।

আলতাফ মাহমুদ বরিশালের মুলাদি থানার পাতারচর গ্রামে ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মা তাঁর নাম রাখেন এ এন এফ আলতাফ আলি। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বি এম কলেজে ভর্তি হন। এরপরেই তিনি ছবি আঁকা ও রঙের কাজ শিখতে ভারতের কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীতে সঙ্গীতের তালিম নেন গুণী বেহালাবাদক ওস্তাদ সুরেন রায়ের কাছে। পরে তিনি গণসংগীতেরও পাঠ নেন, যা পরবর্তীতে তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে ধূমকেতু শিল্পীসংঘে যোগদানের পরে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সমাবেশে গণসংগীত পরিবেশন করেন। পরে তিনি এই সংঘের পরিচালক হয়ে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন, যদিও করাচিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কতৃক সৃষ্ট ভিসা জটিলতার জন্য তাঁর সেখানে যোগদান সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই সময় বাড়ি ফিরে আসার পরিবর্তে তিনি ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতে অবস্থান করেন এবং সংগীতজ্ঞ আব্দুল কাদের খানের কাছে মূলধারার সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য ও নৃত্য পরিচালক ঘনশ্যামের সাথেও তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়। ১৯৬৫ সালে পূর্ব বাংলাতে ফিরে এসে তিনি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার কাজ শুরু করেন। নামকরা চলচ্চিত্র  ‘কার বৌ’, ‘তানহা’ ও ‘ ক্যায়সে কাহু’ সহ তিনি প্রায় ১৯টি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। ‘শোন গণসংগীত’ ও ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’ সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদেশের মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করতেও কর্মজীবনের পুরোটা সময় তিনি আন্তরিক চেষ্টা করে যান।

 

তার লেখা একটি চিঠি; source: bdsaradin.com

বাংলা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সেই টলমলে সময়ে যাঁদের ছিলো অক্লান্ত সাধনা, আলতাফ মাহমুদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি এদেশের মানুষকে মুক্তির গান শোনাতেন, গানের সুরে সুরে মানুষের মাঝে বুনে দিতেন স্বদেশপ্রেমের বীজ। তাঁর দেশপ্রেমের সেইসব অগ্নিঝরা গান পরিবেশিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। তাঁর মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মেশানো এসব গানগুলো পাকিস্তানী শাসকদের হৃদয়ে পরাজয়ের সুর হয়ে বেজে উঠেছিলো বলেই হয়তো তারা এমন কাপুরুষোচিত প্রতিশোধ নেয়।

দেশের মুক্তিসংগ্রামের সেই ক্রান্তিকালে কেবল সুরের যুদ্ধ করেই কিন্তু আলতাফ থেমে থাকেননি। খাবার ও নিজের সাধ্যের অর্থ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। দেশের জন্য সর্বস্ব ঝুঁকিতে রেখে নিজের ঘরেই গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা। এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী একাত্তরের ৩০শে আগস্ট তাকে নিজ বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমাদের আলতাফ সেই যে যান, আর ঘরে ফেরেননি কোনোদিন।

কেমন ছিলো তার হারিয়ে যাওয়ার দিনটি?

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট। সারাদিন অশান্ত, উদভ্রান্ত অবস্থায় থাকেন আলতাফ। উঠোনে মাটিচাপা দেওয়া অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্কগুলোকে নিরাপদে কোথাও সরিয়ে রাখার চিন্তায় সারাদিন ঢাকার রাস্তায় নিজের কালো মরিস গাড়িটা নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান আলতাফ। ক্রাক প্লাটুনের অনেক গেরিলা যোদ্ধা ধরা পড়েছে আজ। একদিকে বাসায় পুলিশি হামলার আশঙ্কা, অন্যদিকে অস্ত্রগুলো নিরাপদে থাকাও দেশের মুক্তির জন্য এখন অত্যন্ত জরুরি। রাত ১১টায় বাসায় ফিরে ভাতপ্রিয় আলতাফ সেদিন চিন্তায় আর মুখে ভাত তুলতে পারেননি। শোবার ঘরে তখন তাঁর দুই কলিজার টুকরা শাওন ও ঝিনু ঘুমিয়ে পড়েছে। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের তাঁর বাসার দরজায় কড়া পড়েছিলো এক চরম অশুভ শক্তির। ভগ্নীপতি ও এক বন্ধুর সাথে আল-বদর বাহিনীর সাহায্যে সেদিন তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পাকসেনারা। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সোজা নাখালপাড়া এমপি হোস্টেল টর্চার সেলে।

আমাদের আলতাফ সেদিন দেশকে ভালোবেসেছিলেন নিজের জীবনের চেয়ে বেশি, শুধু নিজের মাটি আর শেকড়ের প্রতি মমতার অপরাধে তাঁকে বরণ করতে হয়েছিলো অকথ্য যন্ত্রণাময় এক মৃত্যু। তবু সে যন্ত্রণা ভাঙতে পারেনি তাঁকে, সে মৃত্যু ধন্য হয়েছে তাঁকে পেয়ে। ক্ষতবিক্ষত আলতাফ যখন পানি চাইতেন, পেতেন পাক সেনাদের নিগ্রহ। তাচ্ছিল্যের সাথে আলতাফের মুখে মূত্রত্যাগ করতো তারা। ছোট বাথরুমে অন্য অনেকের সাথে রেখে দিতো তাঁকে। সেখানেই কেউ আঁজলা ভরে পানি খাইয়েছিলো তাঁকে। রাত ১০টায় ট্রাকে করে অন্যদের সাথে রমনা থানায় পৌঁছালে সেখানে কয়েদিদের ভাগের একটু ডাল-রুটি পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ব্যথায় কোঁকাতে থাকা আলতাফ সেদিন আর খেতে পারেননি। পরদিন সকালে আবার এমপি হোস্টেল টর্চার সেলে থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয় তাঁকে। একসময় অধৈর্য হয়ে পাক সেনারা ফ্যানের রডে পা বেঁধে বেধড়ক পেটায় তাঁকে। শুধু একটা নামই চেয়েছিল তারা। একসময় তারা সুঠামদেহী আলতাফের কনুই, হাঁটু আর কোমর ভেঙে দেয়। গরম পানিতে ঝলসে দেয় তার শরীর। শরীর ভাঙলেও দৃঢ়চেতা আলতাফের মনোবল ভাঙেনি সেদিন, মুখ খোলেননি তিনি।

অন্যদের সাথে আবার রমনা থানায় যখন তাঁকে নিয়ে আসা হয়, ততক্ষণে পাক সেনারা ঠিক করে ফেলেছিল কাকে মারবে আর কাকে নয়। শেষ রাতে রমনা থানায় এক আর্দালি তাঁকে ভাত আর পেঁপে ভাজি খেতে দিয়েছিলো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে তিনি একটি কাঁচা মরিচ চেয়ে নিয়েছিলেন সেই আর্দালির কাছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এদেশের অন্যান্য সূর্যসন্তানদের সাথে পাওয়া যায় ক্ষত-বিক্ষত আলতাফের লাশ।

১৯৭৭ সালে  বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান ও মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য ত্যাগের জন্য তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক ও ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার দেওয়া হয়। আলতাফসহ নাখালপাড়ার ক্যাম্পে রুমি, বদি, জুয়েলসহ আরো অনেককে নির্মমভাবে হত্যা ও হত্যায় সাহায্যের জন্য আলী আহসান মুজাহিদকে ১৮ জুলাই, ২০১৩ সালে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত করে।

আলতাফ মাহমুদের কন্যা, শাওন মাহমুদ; source: clickittefaq.com

বুদ্ধিজীবী হত্যা পাকিস্তানের এদেশকে চিরতরে পঙ্গু করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ ছিল। আর খুবই দুঃখের সাথে বলতে হয়, তাতে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো এদেশেরই কিছু নরপিশাচ। এটুকুই সান্ত্বনা যে, দীর্ঘদিন পরে হলেও সেই সকল নরপিশাচদের কয়েকজনকে আমরা ঘাড় ধরে জাতির সামনে আনতে পেরেছি। এদেশের আকাশে-মাটিতে মিশে থাকা আলতাফ, রুমি আর জুয়েলরা জানুক- আমরা তোমাদের ভুলিনি, আমরা ভুলবো না।

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles