মানুষ হিসেবে ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের রয়েছে অদম্য কৌতূহল। ভবিষ্যতে কী হবে, আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পাব কি না, ব্যবসায়ের উন্নতি হবে কি না, প্রিয়জনকে নিজের করে পাব কি না, বিদেশযাত্রার সম্ভাবনা আছে কি না এমন হাজারটা প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা ছুটে যাই বিভিন্ন গণক, পন্ডিত কিংবা গুরুর কাছে।
কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে, যে দেশটিতে আমরা বাস করি, সেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? যেকোনো সমস্যা বা দুর্যোগ হলেই আমরা দেশকে গাল দিয়ে বলি, এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু আসলেই এই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল না অন্ধকার, তা কি কখনো গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখেছেন? খুব দূরে যাওয়া লাগবে না, যদি বলি ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের চিত্র কেমন হবে, পারবেন বলতে? নিঃসন্দেহে বলতে পারি, অধিকাংশ মানুষই পারবেন না। কারণ দেশ নিয়ে এত দীর্ঘ পরিসরে ভাবার অবকাশ আমাদের কারোই তেমন একটা হয় না।
তবে তাই বলে ভাববেন না বাংলাদেশের চিত্র ২০৫০ সালে কেমন হতে চলেছে, তা একেবারেই অজানা কোনো বিষয়। বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়ে মোটামুটি কিছু ধারণা আমরা পেতেই পারি। তাহলে চলুন, সেসব প্রতিবেদনের আলোকে জেনে নিই, কেমন হতে চলেছে ২০৫০ সালের বাংলাদেশ।
প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্স (পিডব্লিউসি) তাদের “The long view: how will the global economic order change by 2050?” শীর্ষক প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পরিণত হব বিশ্বের ২৮ তম বৃহত্তম অর্থনীতি (২০১৬ সালে ছিল ৩১ তম)। বাংলাদেশের সামনে আরো সম্ভাবনা রয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৩ তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার। ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০১৬ সালে ছিল ৬২৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ১,৩২৪ বিলিয়ন ডলারে, এবং ২০৫০ সালের ভেতর হবে ৩,০৬৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার খাতে রপ্তানী করেছিল প্রায় ২৮.১৫ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০১৭ সালে রেমিট্যান্স খাত থেকে এসেছিল ১৩.৫৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আপাতদৃষ্টিতে এই সংখ্যাগুলোকে বেশ সম্ভাবনাময় মনে হলেও, মুদ্রার অপর পিঠের নেতিবাচক দিকগুলোকেও উড়িয়ে দেয়ার জো নেই।
একদিকে উপর্যুক্ত পরিসংখ্যানগুলো যেমন নির্দেশ করে বাংলাদেশের অসাধারণ জাতীয় আয়, ক্রমবর্ধমান রপ্তানী খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের দারুণ চিত্র। কিন্তু অন্যদিকে এসব পরিসংখ্যান কিন্তু জানান দেয় না বাংলাদেশের অন্যান্য বিভিন্ন সেক্টরের দৈন্যদশা—ধারণক্ষমতার অধিক নগরায়ন, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, অপর্যাপ্ত পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে নাজুক অবস্থা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, অসামাজিক কর্মকান্ডের উত্থান, গ্রামীণ ও শহুরে আয়ের মধ্যকার ব্যবধান বৃদ্ধি, ভঙ্গুর অবকাঠামো ইত্যাদি।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৩৫.৭ শতাংশ জনসংখ্যা (৫.৯ কোটি) শহরে বাস করে। ১৯৬০-৭০’র দিকে বাংলাদেশের সামগ্রিক জনসংখ্যাই ছিল ৭ কোটি, আর তার মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করত। নগরায়নই যে মানবসভ্যতার চরম নিয়তি, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নগরায়নের ফলে বিকশিত শহরগুলো টেকসই হওয়া জরুরি, যা বাংলাদেশের বেলায় ঘটেনি। কোনো রকম স্থিতিশীল পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে এ দেশের প্রায় সকল বড় শহর। পার্ক, খোলা মাঠ, নদী, খালসহ অন্যান্য জলাশয়গুলো সবই ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। নদী ও নদীপ্রবাহ প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে প্রধান কারণ নদীতে একাধারে পলি জমা, অন্যদিকে কলকারখানার বর্জ্য পদার্থের শেষ ঠিকানা এসব নদীর পানিই হওয়া।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের করা এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৩১০টি নদী রয়েছে, যার মধ্যে ১৭৫টির অবস্থাই নিদারুণ শোচনীয়। আর ৬৫টি নদী তো মৃতপ্রায়। ৮০ শতাংশ নদীরই যথাযথ গভীরতা নেই। বাংলাদেশের সরকার যদি দেশের নদীগুলোকে দূষণ ও ভূমি দখলের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারে, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ অধিকাংশ নদীই খালে পরিণত হবে, আর বাংলাদেশ হয়ে উঠবে মরুভূমি।
জাতিসংঘ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-র এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২৩ থেকে ২৫ কোটি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লক্ষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সেজন্য প্রতিবছর দেশে ১ শতাংশ করে ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশে সব মিলিয়ে ৮.৭৭৪ মিলিয়ন হেক্টরের মতো জমি চাষের উপযোগী রয়েছে, যার মধ্যে ৮৮ শতাংশ জমিতেই চাষাবাদ হচ্ছে। সুতরাং ফসলি জমির পরিমাণ বিস্তৃত করার সুযোগ খুবই সীমিত।
একদিকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ন, সব মিলিয়ে দেশের অধিকাংশ বড় শহরেই যানজট সমস্যা আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতিদিন যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টার অপেক্ষা করতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে, যার ফলে প্রতিদিন নষ্ট হয় হাজার হাজার কর্মঘণ্টা। এক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী বাংলাদেশের শহুরে অবকাঠামো। যেকোনো শহরের যাতায়াত অবকাঠামো ঠিক রাখার জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে সড়ক মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারেরও কম আয়তনের এই দেশ ১৬ কোটি মানুষের বসবাসের জন্যই উপযোগী নয়। সেখানে ২০৫০ সাল নাগাদ যদি জনসংখ্যা ২৩ থেকে ২৫ কোটিতে দাঁড়ায়, তখন দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার অবস্থা কেমন হবে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-র করা “Assessing the costs of climate change and adaptation in South Asia” শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ুর যদি কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি ২ শতাংশ হ্রাস পাবে। যেহেতু দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাই রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটেরও কম উচ্চতায়, তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর তিন ফুট বৃদ্ধি পেলেই বাংলাদেশের অন্তত ২০ শতাংশ পানির নিচে ডুবে যাবে। এর ফলে একাধারে যেমন ফসলি জমি আরো কমে যাবে, তেমনই ২০৫০ সালের মধ্যে ৩.৫ কোটি মানুষ বাধ্য হবে তাদের বাসস্থান পরিবর্তন করতেও। এই প্রতিবেদনে আরো আশঙ্কা করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বড় প্রভাব পড়বে দেশের কৃষি ও জলীয় উৎসের উপর। ধান উৎপাদন ৮ শতাংশ, এবং গম উৎপাদন ৩২ শতাংশ কমে যাবে, ফলে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সূচক ২০১৮ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৩। দুর্বল অবকাঠামো ব্যবস্থার কারণে, এ দেশের উদ্যোক্তাদেরকে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পেতে, যার ফলে তাদের নতুন শিল্পক্ষেত্র গড়ে তোলা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপারে পরিণত হয়। দুর্বল অবকাঠামোর প্রভাব পড়ে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। এই মুহূর্তে বিনিয়োগ খাতে বাংলাদেশ খুবই খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির অংশ হিসেবে বিনিয়োগ ছিল ৩০.৫ শতাংশ, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২৯ শতাংশের চেয়ে খানিকটা বেশি ছিল। কিন্তু এই বৃদ্ধি যথেষ্ট না হওয়ায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা এখনো কাঙ্ক্ষিত সচলতা লাভ করছে না। পাশাপাশি নতুন চাকরির বাজারও বিস্তৃত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্সের (বিবিএস) করা সাম্প্রতিক শ্রম শক্তি জরিপ অনুযায়ী, যে শিল্পক্ষেত্র ছিল ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা খাত, সেটিই ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আগপর্যন্ত সর্বশেষ সাত বছরে চাকরি দিয়েছে মাত্র ৩ লক্ষ মানুষকে। গড়ে প্রতিবছর ৪২,৮৫৭টি নতুন চাকরি সৃষ্টি করেছে এই খাত। এই জরিপ থেকে আরো জানা যাচ্ছে যে, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ সময়কালের মধ্যেই দেশের শ্রম শক্তিতে ১৪ লক্ষ নতুন মুখ যোগদান করেছে, যার ফলে মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ কোটি। চাকরি না পেয়ে, এবং অন্যান্য কোনো সুযোগ না থাকার ফলে, বর্তমানে বাংলাদেশের বেকারদের মধ্যে নতুন একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে: দেশ ছেড়ে যাওয়া। তারা ভাগ্যের সন্ধানে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার মাধ্যমে (যেমন- নৌকায় করে মালয়েশিয়া) বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমাচ্ছে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪.৭৬ কোটি কিংবা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই কিশোর ও তরুণ (১০-২৪ বছর বয়সী), এবং তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশই, অর্থাৎ ১.১ কোটি, এখন নিষ্ক্রিয়—মানে তারা পড়াশোনাও করছে না আবার অর্থ উপার্জনের মতো অন্য কোনো কাজও করছে না। এভাবেই দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি ছোবল হানছে।
দারিদ্র্য সমস্যার কথাও ভুলে গেলে চলবে না। এখনো প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশীই (মোট জনসংখ্যার ২৪.৩ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আর ১২.৯ শতাংশ তো চরম দারিদ্র্য অবস্থায় রয়েছে। এভাবেই সমাজে অসাম্য, সমাজবিরোধী কর্মকান্ড, দুর্নীতি প্রভৃতির উত্থান ঘটছে। ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
সবশেষে একটি প্রশ্নই আবারো করতে হয়: ২০৫০ সাল নাগাদ এসব সমস্যার কোনোটি কি কমবে? অবস্থার কি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে? সম্ভাব্য অনেকগুলো ভবিষ্যতই আমাদের সামনে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোনটি বাস্তবে ঘটবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সেগুলো আজকের উপরই নির্ভর করছে। আজ আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, সেই অনুযায়ীই ভবিষ্যৎ রচিত হবে। আর তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত হবে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়া, সঠিক কাজটি করা। নতুবা ২০৫০ সাল নাগাদ যখন একটি নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটবে, তাদেরকে আমরা একটি বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ উপহার দিতে পারব না। বাংলা রচনায় তারা আর লিখতে পারবে না, “সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ…”।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/