হার্ডিঞ্জ ব্রিজ: তিন শাসনের সাক্ষী

ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। শতবর্ষের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বীরদর্পে। যুগের পর যুগ চলে গেছে, কত মানুষ এসেছে, আবার হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে, কত শাসক-শোষক আর প্রজন্মের সাক্ষী এই ব্রিজটি।

প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। তখন পদ্মার ভরা যৌবন ছিল, ছিল খরস্রোতা উত্তাল ঢেউ আর জলরাশি। এখন পদ্মার সেই যৌবন ফুরিয়ে গেছে। সেই উত্তাল ঢেউ নেই, কুলকুল রব তুলে ছুটে চলা পদ্মা এখন যেন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে। কিন্তু ঠিকই পদ্মার বুকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেন যৌবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যেন এই ব্রিজের যৌবন শেষই হচ্ছে না।

এই ব্রিজটি এককভাবে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইস্পাত নির্মিত ডুয়েল গেজ রেলওয়ে ব্রিজ। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১,৭৯৮.৩২ মিটার বা ৫,৮৯৪ ফুট (১.৮ কি.মি)। সর্বমোট ১৫টি গার্ডার বা স্প্যান রয়েছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ মিটার করে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে এই ব্রিজটির নামকরণ করা হয়।

একদিকে যেমন সৌন্দর্য, অপরদিকে ইতিহাসের সাক্ষী- সবমিলিয়ে এই ব্রিজটি বাংলার ঐতিহ্য এবং তাৎপর্য বহন করছে। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে এই ব্রিজের অবস্থান। পাকশী স্টেশনের দক্ষিণে প্রমত্ত পদ্মা নদীর উপর লালরঙা এই ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে। এর অপরপ্রান্তে রয়েছে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা।

কয়েক দশক পূর্বে প্রস্তাব করা হলেও ব্রিজটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯১০ সালে। ১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সাথে আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও উত্তরবঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এজন্য সর্বপ্রথম ১৮৮৯ সালে ব্রিজটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।

পরবর্তীতে দীর্ঘ ১৯ বছর পর ব্রিজটি নির্মাণের জন্য মঞ্জুরী লাভ করে। ব্রিজটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে। ব্রিটিশ সরকার তাকে এই ব্রিজ নির্মাণের স্বীকৃতিস্বরুপ ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে।

বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল ব্রিজটির নকশা প্রণয়ন করেন; image soure: npg.org.uk

ব্রিজটির নকশা প্রণয়ন করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল। ব্রেথওয়েইট অ্যান্ড কার্ক নামক ব্রিটিশ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ব্রিজটির নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

১৯০৯ সালে ব্রিজ নির্মাণের জন্য সার্ভে শুরু হয়। তখন পদ্মা ছিল ভরা যৌবনা। রবার্ট উইলিয়াম গেইলস বুঝতে পারেন- ব্রিজের নির্মাণ তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। এজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন মূল ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু করাই আগেই নদী-রক্ষা বাঁধ তৈরি করতে হবে। ১৯১০-১১ সালের পুরোটা সময় জুড়ে শুধু বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

এক্ষেত্রে গেইলস এক অসাধারণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি বৃহদাকৃতির পাথর আর মাটি একত্রে মিশিয়ে নদীর পাড়ে ফেলতে থাকেন। দুই পাড়ে প্রায় পনের কিলোমিটার জুড়ে এভাবে বাঁধ দেন।

ধারণা করা হয়, নদী বাধতে যে পাথর ব্যবহার হয়েছে তা দিয়ে আরো কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। গেইলসের সেই পদ্ধতি সত্যিই কাজে লেগেছিল। একশ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই বাঁধ এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। যেন একটা পাথরও এখনও খসে পড়েনি।

১৯১২ সালে ব্রিজটির মূল অংশের কাজ শুরু হয়। এ সময় ব্রিজটির গাইড ব্যাংক নির্মাণের পাশাপাশি গার্ডার নির্মাণের কাজও শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা তৎকালীন সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করে।

ব্রিজটি নির্মাণে ২৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেন; image source: wikimedia commons

ব্রিজটি নির্মাণের জন্য প্রায় ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিক অক্লান্ত প্ররিশ্রম করেন। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই ছিল বাঙালী। সেসময় অনেক ব্রিটিশ নাগরিকের জন্য পাকশীতে গড়ে তোলা হয় বাংলো বাড়ি ও কটেজ। পাকশীতে তখন ব্রিটিশদের অবাধ চলাচল ছিল।

রবার্ট উইলিয়াম গেইলসের একটি বড় বাংলো ছিল, যা এখনও টিকে আছে। বলা হয়ে থাকে, প্রায় এক কিলোমিটার দূরের এই বাংলো থেকে তিনি দূরবীন দিয়ে নির্মাণকাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন।

নির্মাণকাজের সময় পাকশী ও এর আশপাশে ছোটখাট অনেক কলকারখানা, দোকানপাট ও বাজারঘাট গড়ে ওঠে। জনজীবনে প্রভাব পড়েছিল ব্রিটিশ অধিপত্যের। স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছিল।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচলকারী প্রথম ট্রেন; image source: wikimedia commons

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলে। অবশেষে ১৯১৫ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। ব্রিজটির নির্মাণকাজে তৎকালীন হিসেবে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৩২ হাজার ১ ‘শ ৬৪ ভারতীয় রুপি।

১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম পরীক্ষামুলকভাবে ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে খুলনা অভিমুখে যাত্রা করে। এরপর একই বছর ৪ঠা মার্চ লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জ নিজে ফিতা কেটে ব্রিজটি উদ্বোধন করেন।

৪ঠা মার্চ,  ১৯১৫ সালে লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি উদ্বোধন করেন; image source: wikimedia commons

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এই ব্রিজের উপর দিয়ে ট্যাংক, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও সৈন্য পারাপার করত। সেজন্য ১৪ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে ব্রিজটির উপর বোমা ফেলা হয়। এতে ১২ নম্বর স্প্যান সম্পূর্ণ ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। এছাড়া ১৫ এবং ৯ নম্বর স্প্যানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে পুনরায় ব্রিজটি মেরামত করা হয়। ১৯৭২ সালে ১২ অক্টোবর ব্রিজটির উপর দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ১২ নম্বর স্প্যানটি ভেঙে পানিতে পড়ে যায়; image source: busy.org

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মূলত একটি রেলওয়ে ব্রিজ। এর উপর দিয়ে দুটি ব্রডগেজ রেল লাইন রয়েছে। পাশাপাশি পায়ে হাঁটার পথও রাখা হয়েছে। শত বছর পার হয়ে গেলেও ব্রিজটিতে এখনও গতিসীমা ৫০ কি.মি. নির্দেশ করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।

২০১৫ সালের ৪ঠা মার্চ ব্রিজটির শতবর্ষপূর্তি পালন করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই শতবর্ষপূর্তি উৎসব পালন করে।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশ দিয়ে সমান্তরালে ২০০৪ সালে একটি সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। এ অঞ্চলের বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে সেতুটির নাম রাখা হয় লালন শাহ সেতু। এই সড়ক সেতু নির্মাণের ফলে নতুন ও পুরাতনের মধ্যে এক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে ।

ব্রিজটি উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক হওয়ায় প্রতিদিন অগণিত দর্শনার্থী এখানে ভিড় জমায়। নির্মাণের পর থেকেই এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। সেসময় প্রমত্ত পদ্মার বুক চিরে নৌকা যোগে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ ব্রিজটি দেখতে আসত। মানুষের সেই কৌতূহল যেন আজও শেষ হয়নি।

This is a bengali article detailing the history of Hardinge Bridge in Bangladesh. Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Feature Image: Walkalone/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version