প্রবাসী কর্মীদের মানবেতর জীবনকাহিনী

প্রবাসীরা দেশান্তরী কেন হন? 

সাতক্ষীরার নিজামউদ্দিন। পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। তিনি নিজে তো আছেনই, সাথে আরো আছেন তার মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি তিনিই। একসময় নিজের জমিতে খাদ্যশস্য ফলাতেন। কিন্তু পাশের জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ায়, নিজের জমিতে আর ফসল ফলাতে পারেন না তিনি। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় তার বসতবাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে তাকে আরো একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। সেটি হলো জলাবদ্ধতা। সব মিলিয়ে দিন দিন নিজামউদ্দিনের অবস্থা দুর্বিষহ হতে শুরু করেছিল। নিজ গ্রামের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে অন্য কিছু করার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন সময় ঢাকায় থাকা চাচাতো ভাই তাকে বুদ্ধি দিলেন, কাতারে যাওয়ার একটা সুযোগ আছে, কিন্তু সেজন্য লাখ তিনেক টাকা জোগাড় করতে হবে তাকে। শ্বশুরবাড়ি থেকে, কিছু আত্মীয়স্বজনের থেকে, এবং মহাজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রয়োজনীয় টাকার ব্যবস্থা করেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে পাড়ি জমান কাতারে।

ওদিকে টাঙ্গাইলের জমিলার কাহিনী ভিন্ন। দুই সন্তানের মা তিনি। স্বামী বেজায় বদমেজাজি। এই বদমেজাজের কারণে কোনো চাকরিতে বেশিদিন টিকতে পারেন না তিনি। তাই মামার সাহায্যে স্বামীকে নিয়ে গাজিপুর চলে আসেন জমিলা। বাচ্চারা টাঙ্গাইলেই রয়ে যায়। গাজিপুরে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেন তারা। কিন্তু এবারও সেই চাকরি খুইয়ে বসেন তার স্বামী। এবং একপর্যায়ে গ্রামেও ফিরে যান। জমিলা একাই গাজিপুরে তার সংগ্রাম অব্যহত রাখেন। কিছুদিন তার উপার্জিত অর্থেই সন্তানদের লেখাপড়া আর সংসার কোনোরকমে চলছিল। এভাবে কয়েক বছর কেটে যায়। তারপর একদিন জমিলা ও তার গার্মেন্টসের এক বান্ধবীর কাছে আসে মামার বন্ধু মজিদ দালাল। সে জিজ্ঞেস করে, জর্ডানের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে তারা ইচ্ছুক কি না। জমিলার স্বামী রাজি ছিলেন না, তবু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে যান জমিলা। জর্ডান যেতে তার খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা।

এদিকে শরীয়তপুরের ইন্তাস আলির বয়স বড়জোর ১৯। স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি সে। তার বাবা খুবই চিন্তিত ছিলেন তাকে নিয়ে, কেননা অসৎ সঙ্গে পড়ে বখে যাচ্ছিল সে। এদিকে ঈশ্বরদীর এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ইন্তাস। একপর্যায়ে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়েও যায় সে। কিন্তু মেয়েটির পরিবার ধরে ফেলে তাদেরকে। নিজেদের মেয়েকে তারা ফিরিয়ে নিয়ে যায়, আর পুলিশের কাছে মামলা করে দেয় ইন্তাসের নামে। অভিযোগ: অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ফুঁসলিয়ে অপহরণ করেছে সে। উপায়ন্তর না পেয়ে গা ঢাকা দিতে হয় তাকে। তার বাবাও যখন তাকে বাঁচানোর আর কোনো রাস্তা খুঁজে পেলেন না, তখন ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন ওমানে ভাইপোর কাছে। সেই ভাইপো ইন্তাসের জন্য ওয়ার্ক ভিসার ব্যবস্থা করে, আর ইন্তাসের বাবা দেশে বসে এক স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সেই ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করেন।

প্রিয়জনকে ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমান প্রবাসীরা; Image Source: The Daily Star

সাতক্ষীরার নিজামউদ্দিন, টাঙ্গাইলের জমিলা এবং শরীয়তপুরের ইন্তাস- তিনজনেরই এখন এক ও অভিন্ন পরিচয়: তারা মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসী। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাদের তিনজনের ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু একেবারেই আলাদা। কেবলমাত্র নিয়তি আজকে তাদেরকে একই সমান্তরালে এনে দাঁড় করিয়েছে।

কেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নিজ দেশ ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গিয়ে প্রবাসী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, তার উত্তর খুব সহজে দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশিদের দেশান্তরী হওয়ার পেছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। অনেকগুলো বিষয়ের উপর ব্যাপারটি নির্ভর করে। শুরু হয় একদম মাইক্রো লেভেল থেকে, অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কারণ, পারিবারিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি। এরপর আসে ম্যাক্রো লেভেল, অর্থাৎ অর্থনৈতিক, জনতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন বিষয়। এছাড়াও রয়েছে মেসো লেভেলের কারণসমূহ, অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন পলিসি ও প্রতিষ্ঠান, দেশান্তরী হওয়ার বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, দালাল ও নিয়োগ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ইত্যাদি।

নিজামউদ্দিনের উদাহরণের দিকে যদি তাকাই, ঘূর্ণিঝড় আইলা ছিল একটি পরিবেশগত প্রভাব, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা ছিল সরকারি পলিসির প্রভাব, কেননা সরকারই ওই অঞ্চলের কৃষকদেরকে চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এছাড়া নিজামউদ্দিনের জন্য কিছু ম্যাক্রো লেভেলের কার্যকারণও ছিল, যেমন তার একটি চাকরিলাভ ও স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা। তার চাচাতো ভাইয়ের ঢাকায় কাজ করা, শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা নেয়ার সুযোগ, এই সবকিছুও তার দেশান্তরী হওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।

জমিলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিল তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খরচ চালানোর জন্য উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা, সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার ব্যাপারে তার নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা, এবং মামার পরিচয়ের সূত্রে নির্ভরযোগ্য দালালের দেখা পাওয়া। ভুলে গেলে চলবে না, জর্ডানের মতো দেশে নারী কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও সেখানে বিদেশী কর্মী নিয়োগের শূন্যস্থানও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ইন্তাস আলির ক্ষেত্রে আবার দেশান্তরী হওয়া তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে উপায়ন্তর না দেখে তার পরিবার তার উপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। তার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার চেয়ে তার সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। দেশে থাকলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, জেলে না গেলেও বখাটেদের সাথে মিশে সে-ও গোল্লায় যাবে, বরং বিদেশে গেলে তার মধ্যে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবণতা আসতে পারে, এই সম্ভাবনাটিও তার পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

এভাবেই পৃথক পৃথক কারণে দেশান্তরী হয়ে, নিজেদের নামের পাশে ‘প্রবাসী’ ট্যাগ ঝুলিয়েছেন উপরের তিন ব্যক্তি। তাদের মতো মানুষ এখন প্রচুর আছে। শুধু ২০১৮ সালেই স্বল্পস্থায়ী চাকরি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরী হয়েছেন ৭,৩৪,০০০ জন। তাদের দেশান্তরী হওয়ার কারণগুলোকে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্নে ভাগ করা যাবে, কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় এই ৭,৩৪,০০০ জন মানুষের জীবনে আলাদা আলাদা ৭,৩৪,০০০টি কাহিনী রয়েছে। নিজেদের সুবিধার জন্য আমরা সেই কাহিনীগুলোর সাধারণীকরণ করি বটে, তবে কাহিনীগুলোর স্বাতন্ত্র্যকেও অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে সবার আগে যে বাস্তবতাটিকে আমাদের মেনে নিতে হবে, তা হলো বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব। বাংলাদেশকে বলা হয় শ্রম উদ্বৃত্তের দেশ। কেননা প্রতিবছর এদেশে ২০ লক্ষ তরুণ-তরুণী নতুন কর্মশক্তি হিসেবে যোগ হয়। কিন্তু তাদের জন্য এদেশের ফরমাল সেক্টরে (যেখানে সপ্তাহে নির্দিষ্ট কিছু দিন নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা কাজ করে নির্দিষ্ট বেতন লাভ করা যায়) চাকরির সুযোগ রয়েছে মাত্র ২ লক্ষ। বাকিরা কী করবে? কেউ কেউ ইনফরমাল সেক্টরে যোগ দেয়, অর্থাৎ যেখানে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কিংবা বেতন নির্দিষ্ট নয়। কেউ আবার নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করে, যাদেরকে আমরা বলি উদ্যোক্তা। আর কর্মশক্তির অন্তর্গত সিংহভাগ মানুষই বেকার থেকে যায়, কিংবা নিজ যোগ্যতার অনুরূপ চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে। সেজন্যই তাদেরকে নিজ দেশ ছেড়ে স্বল্প মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য, আরব, উপসাগরীয় এবং পশ্চিম-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পা বাড়াতে হয়। এরপরও ২০১০ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লক্ষ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লক্ষে। আরো ১ কোটি জনগণ, বিশেষত নারীরা, সংসারের কাজে দিন-রাত এক করে দিলেও, তা থেকে তাদের আয় শূন্য। তাদেরকেও গণনায় ধরলে দেশের বেকারের সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকত, ভাবতেই ভয় হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান প্রবাসীদের; Image Source: Kalerkantho

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান 

বাংলাদেশের জন্য শ্রমশক্তি রপ্তানি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কেননা এর মাধ্যমেই দেশের বেকারত্ব কিছুটা হলেও কমছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির চাকা সচল থাকছে, এবং দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হচ্ছে। ১৯৭৬ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কাজের জন্য গিয়েছিলেন মাত্র ৬,০৮৭ জন। কিন্তু এখন ১৫৫টি দেশে মোট বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৬.৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশে আগত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫.১১ বিলিয়ন ডলার। বলাই বাহুল্য, এই মুহূর্তে রেমিট্যান্সই বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আগমনের সর্ববৃহৎ একক উৎস। এটি বাংলাদেশের জিডিপির ১১.১৪%, এবং দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৫৩.৫%। সুতরাং বাংলাদেশ যে আজ অর্থনৈতিকভাবে এতটা এগিয়ে গেছে, এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো একটি সেক্টরের অবদানের কথা উল্লেখ করতে বলা হলে, সেটি হবে অবশ্যই বিদেশে কর্মশক্তি রপ্তানি।

বিদেশ যাওয়ার পথে যত বিড়ম্বনা

বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই, কিন্তু যারা নিজ দেশ, পরিবার, কাছের মানুষদের ছেড়ে দেশান্তরী হচ্ছেন, তাদের জন্য কি ভাগ্য ফেরানো এতই সহজ? একদমই নয়। বরং দেশান্তরী হতে যে মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটিই সবচেয়ে কঠিন কাজ। সবাই তো আর নিজামউদ্দিন, জমিলা বা ইন্তাস আলির মতো ভাগ্যবান নন। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেশন মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (আরএমএমআরইউ) ও প্রকাশের করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, যারা কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী, তাদের মধ্যে ১৯% মানুষ গড়ে ২ লক্ষ টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। তারা সকলেই প্রতারণার শিকার। কেউ প্রতিবেশীর, কেউ দালালের, আবার কেউ বা ভুয়া নিয়োগ সংস্থার।

এমন এক প্রতারণার শিকার ব্যক্তি টাঙ্গাইলের মজনু শিকদার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি মালেক মিয়াকে চিনতেন। তাই যখন তিনি মনস্থির করলেন কাজের উদ্দেশে দেশের বাইরে যাবেন, স্বভাবতই তিনি মালেক মিয়ার দ্বারস্থ হলেন। ২০১৬ সালে মজনু শিকদার প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র ও পাসপোর্ট তুলে দেন মালেক মিয়ার হাতে। ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকাও তাকে দেন। কথা ছিল, মালেক মিয়া তাকে মালয়েশিয়ায় কনস্ট্রাকশন সেক্টরে কাজ পাইয়ে দেবে।

মোট তিনবার মজনুকে ঢাকায় নিয়ে যায় মালেক মিয়া। একবার নিবন্ধন ও আঙ্গুলের ছাপ দেয়াতে, একবার নিয়োগ সংস্থায় ইন্টারভিউ দেয়াতে, এবং শেষবার মেডিকেল টেস্টের জন্য। এই তিনবার ঢাকায় যাওয়া-আসার সকল খরচও মজনুই বহন করেছিলেন। পরবর্তীতে মালেক মজনুকে জানায়, সকল ফরমালিটি শেষ করা হয়েছে, পরের সপ্তাহেই ফ্লাইট। মালেক মিয়ার মুখের কথা বিশ্বাস করেই ব্যাংকের মাধ্যমে তাকে মাইগ্রেশনের খরচ দিয়েছিলেন মজনু।

নির্ধারিত তারিখে পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হন মজনু। কিন্তু তিনি অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ তাকে প্লেনে উঠতে দিচ্ছে না। কারণ, তার কাছে যে ভিসা ছিল সেটি নাকি জাল! এই ঘটনার পর একেবারেই মুষড়ে পড়েন মজনু। সেই থেকে দালাল মালেক মিয়ারও আর কোনো হদিস পাননি তিনি।

আগ্রহীদের মধ্যে মাত্র ৪৯% সফলভাবে দেশের বাইরে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন; Image Credit: Nashirul Islam

আরএমএময়ারইউ ও প্রকাশের জরিপ থেকেই জানা যায়, আগ্রহীদের মধ্যে মাত্র ৪৯% সফলভাবে দেশের বাইরে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন ও সেখানে চাকরি পেয়ে থাকেন। অন্য এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সৌদি আরব বাংলাদেশি প্রবাসীদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য। ২৯% বাংলাদেশিই সৌদি আরবে যান। সৌদি আরবে যেতে একজন আগ্রহী ব্যক্তি ৫ লক্ষ থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করে থাকেন, যদিও সরকার পুরো মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার খরচ নির্ধারিত করে দিয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। একইভাবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৮ লক্ষ টাকা এবং সর্বনিম্ন আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করা লাগে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় কারণ মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপের ব্যাপক দুর্নীতি, এবং ঘুষ না দিয়ে কোনো ধাপই পার করা যায় না।

অন্য আরেকটি জরিপের প্রতিবেদন বলছে, মাত্র ১০% প্রবাসী কর্মী বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে যান। বাকিদেরকে অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে যেতে হয়, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা জানেনই না যে তারা যে চ্যানেলের মাধ্যমে যাচ্ছেন সেটি অবৈধ।

বিদেশের মাটিতে ভোগান্তি ও মানবেতর জীবনযাপন 

কোনো রকমে নির্দিষ্ট দেশে পৌঁছাতে পারলেও প্রবাসী কর্মীদের ভোগান্তির শেষ হয় না। বরং নতুন আরো অনেক ভোগান্তির সূচনা হয়। একে তো তারা ওই দেশের সংস্কৃতির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন, এমনকি তারা ওই দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাও জানেন না। খাদ্যাভ্যাস, থাকার জায়গা এবং কাজের পরিবেশ নিয়েও তাদেরকে বিপাকে পড়তে হয়। বেশিরভাগ প্রবাসী কর্মীই খুব বেশি শিক্ষিত হন না। এমন অনেকেও আছেন যাদের ন্যূনতম অক্ষরজ্ঞানটুকুও নেই। তাই কর্মস্থলে চাইলেই তাদেরকে ঠকিয়ে দেয়া যায়।

২০১৭ সালের এসডিসি ও আরএমএমআরিউ’র এক জরিপ মতে, ৩২% পুরুষ প্রবাসী কর্মীর চাকরি হয় সার্ভিস সেক্টরে, ২৪% পুরুষের কনস্ট্রাকশন সেক্টরে, ১১% পুরুষের প্ল্যান্টেশন ও কৃষিকাজে, এবং আরো ১০% পুরুষের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে। ১০% পুরুষ আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। তাদের বেশিরভাগই সৌদি আরবে ছোটখাট ব্যবসা দেন। অন্যদিকে নারী প্রবাসী কর্মীরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবেই কাজ করেন। ৮৭% নারীই বিদেশে গিয়ে মানুষের বাসায় কাজ করেন। এছাড়াও ৮.৩% নারী গার্মেন্টস কিংবা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে কাজ করেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে নার্স, চিকিৎসক কিংবা শিক্ষক হন মাত্র ২%। ২০১৭ সালে পুরুষ প্রবাসী কর্মীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন গড়ে ১ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা, আর নারীরা ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকা।

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা খুব কম ক্ষেত্রেই সুখকর হয়। বরং অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীই বিদেশে গিয়ে প্রাণ হারান কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, পেশাদারি ঝুঁকি, কাজের চাপ ও মানসিক অত্যাচারের কারণে। শুধু ২০১৭ সালেই বিদেশে অন্তত ৩,৪৮০ জন বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৬ ও ২০১৫ সালে মৃতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩,৩৭৫ ও ৩,৩৩৫। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে বিদেশের মাটিতে মারা গেছেন ৩৩,১১২ জন বাংলাদেশি কর্মী। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি। কেননা বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো কেবল বৈধ কর্মীদের মৃত্যুই লিপিবদ্ধ রাখে। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া কর্মীরা মারা গেলে অনেক সময় এমনকি সে খবর দেশে পৌঁছায়ও না।

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা খুব কম ক্ষেত্রেই সুখকর হয়; Image Source: Channel I Online

বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করা অধিকাংশই হয়তো পুরুষ, কিন্তু তাই বলে নারীদের অবস্থাও কোনোভাবেই শ্রেয়তর নয়। শুধু ২০১৮ সালেই অন্তত ৮০০ জন নারী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন, যাদের বেশিরভাগেরই কর্মস্থল ছিল সৌদি আরব। তাদের হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসার পেছনে কারণ কাঙ্ক্ষিত বেতন না পাওয়া, দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়া, দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ইত্যাদি। একটি পরিচিত প্যাটার্ন হলো, নারী গৃহস্থরা একটু ভুল পেলেই নারী গৃহকর্মীদের উপর চড়াও হতো, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করত। আর পুরুষ গৃহস্থরা নারী গৃহকর্মীদের সাথে জোরপূর্বক যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করত।

দেশের বাইরে যাওয়ার আগে সকল আগ্রহী ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট কিছু মেডিকেল টেস্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তাদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস বি, এইচসিভি, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, মানসিক সমস্যা, নিউরোলজিকাল ডিজঅর্ডার প্রভৃতি আছে কি না। বিভিন্ন জরিপের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদেশে যাওয়ার আগে একজন ব্যক্তি উপরিউক্ত কোনো রোগেই আক্রান্ত ছিলেন না, কিন্তু বিদেশে গিয়ে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে কাজ করা ও বসবাসের সুবাদে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা এক বা একাধিক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। তাদের মাথায় সবসময় দেশে টাকা পাঠানোর চিন্তা, বিদেশে আসতে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নেয়া ধার মেটানোর চিন্তা, সর্বোপরি বিদেশের মাটিতে নিজের হাতখরচের চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের এমন মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে চাকরিদাতারা কম টাকায় তাদের থেকে বেশি ওভারটাইম করিয়ে নেয়। এত শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য না করতে পেরেও অনেক সুস্থ-সবল মানসিক কর্মী অচিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় দেশ ছাড়েন প্রবাসীরা; Image Source: Banglanews24

শেষ কথা

আমরা বাংলাদেশে বসে, প্রবাসীদের স্থানীয় পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখে মনে করি, বিদেশে প্রবাসীরা বুঝি আরো কত সুখের জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু তারা যে নিজেরা বিদেশের মাটিতে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে, রাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘুমিয়ে আর দিনে আরো বাজে জায়গায় কাজ করে, দেশে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে মোটা অংকের টাকা পাঠাচ্ছেন, তা আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারি না। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকায় আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সেই টাকা যুক্ত হয় আমাদের বার্ষিক বাজেটে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে লাভের গুড় খাই আমরা সকলেই। এবং সুযোগ পেলেই আমরা প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করি। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। তারা বিদেশে সুইপারের চাকরি করছে, অন্যের বাসন-কোসন সাফ করছে, এমন নানা অপমানজনক কথা বলি। অথচ এটা চিন্তা করি না যে, প্রবাসী কর্মীদের রক্ত জল করা টাকাতে শুধু তাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজনরাই না, লাভবান হচ্ছি আমরা সকলেই।

তাই অবিলম্বে আমাদের উচিৎ প্রবাসীদের আত্মত্যাগকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া, তাদের দুরাবস্থার ব্যাপারে সচেতন হয়ে তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রবাসীরা যদি ভিনদেশে গিয়ে ন্যূনতম সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ না পায়, তাতে শুধু তাদের একার ক্ষতি নয়, ক্ষতি দেশের প্রতিটি জনগণেরই। সরকারেরও উচিৎ বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা যাতে বৈধ চ্যানেলে, নির্ধারিত টাকাতেই বিদেশে যেতে পারেন, এবং বিদেশে গিয়ে ন্যায্য অধিকারসমূহ লাভ করেন, সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about the Bangladeshi migrant workers and their miseries. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Bonikbarta

Related Articles

Exit mobile version