বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যচর্চায় যে মানুষটির নাম অনন্য হয়ে আছে, তিনি স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তার নকশা করা প্রথম স্থাপনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভবনটি। আধুনিকতার চিন্তাটি যে মননে, চিন্তায় ও কাজে সর্বত্র ধারণ করার বিষয়, সেটি তিনি তার জীবনের প্রতটি পদে পদে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি যেমন আধুনিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। মাজহারুল ইসলাম তার সকল কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে দেশকে, সমাজকে রেখেছেন।
এই অসাধারণ মানুষটি ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মাজহারুল ইসলামের বাবা উমদাতুল ইসলাম কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৩৮ সালে মাজহারুল ইসলাম রাজশাহী সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পুরকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। এর মাঝে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে ক্লাস বন্ধ থাকায় তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং ১৯৪৬ এর মাঝে পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করেন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে থাকাকালেই সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার এই মতধারা অব্যাহত ছিল। রবীন্দ্রনাথের রেনেসাঁ মতবাদ থেকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা এবং সর্বশেষ মার্ক্স লেনিনের মতবাদ সবটুকু নিয়ে গড়ে উঠেছিল মাজহারুল ইসলামের চিন্তাধারা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মাজহারুল ইসলাম ঢাকাতে সি বি এন্ড আই মন্ত্রণালয়ে প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন, কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ তাঁকে স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য স্টাডি লিভ দিতে অপারগতা জানালে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অরিগন ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যবিদ্যায় ডিগ্রী নিতে চলে যান। অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই মাজহারুল ইসলামের একজন পুরকৌশলী থেকে স্থপতি হবার পথের যাত্রা শুরু হয়।
তাঁর জীবনে অধ্যাপক হেইডেন এবং অধ্যাপক রসের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। অধ্যাপক রসই তাঁকে প্রথম বোধ করতে শিখিয়েছিলেন নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করার গুরুত্ব। ১৯৫৩ সালে মাজহারুল ইসলাম দেশে ফিরে আসেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পরপরই এই সময়টাতে দেশের জন্য কিছু করার জন্য তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি সি বি এন্ড আই মন্ত্রণালয়ে নতুনভাবে যোগদান করেন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের ভবন, বর্তমান চারুকলা ভবন, ডিজাইন করার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। জীবনের প্রথম ডিজাইন করা এই ভবনটি নির্মাণে তিনি আধুনিকতার সাথে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। এরপর তাঁর করা প্রতিটি কাজেই ফুটে উঠেছে একই ভাবধারা, প্রকৃতির সাথে মিল রেখে নকশা করা হয়েছে তাঁর প্রতিটি কাজ।
১৯৬৪ সালে মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্যচর্চার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বাস্তুকলাবিদ গড়ে তোলেন এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে স্থাপত্যচর্চা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপা বিল্ডিং, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যান, দেশের পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে তিনিই ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ স্থপতি।
মাজহারুল ইসলাম তাঁর কাজের জন্য বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরষ্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশে তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে। এই মানুষটি আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ ভবন নকশার সুযোগ পেয়েও তা নিজে না করে মাস্টার আর্কিটেক্ট লুই আই কানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে দায়িত্ব দেবার জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি সারাটা জীবন নিজের আগে দেশের কথা ভেবেছেন, মানুষের কথা ভেবেছেন। তিনি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে ধনী-গরীবের ভেদাভেদ থাকবে না, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ২০১২ সালে চলে যান না ফেরার দেশে। কাজ এবং আদর্শের মাধ্যমে তিনি চিরদিন সরবে উপস্থিত থাকবেন পৃথিবীর স্থাপত্যজগতের ইতিহাসে।