চারদিকে শুধু একটি বাক্য শোনা যাচ্ছে, “বাসায় থাকুন, নিরাপদ থাকুন”। কিন্তু একদল মানুষ আছে, যারা বাসায় থাকছে না। তাদের এই বাসায় না থাকা আমাদের নিরাপদ রাখার জন্য। তারা ভোর ৬ টায় কর্মযজ্ঞ শুরু করেন, যা থামে না গভীর রাতেও। রাতের আঁধারে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তাদের অনেকেই জেগে থাকেন, যাতে নিশ্চিত থাকে আমাদের নিরাপদ ও সুস্থ জীবন। এই বাক্যগুলো পড়ে কাদের কথা মনে পড়ছে আপনার? নিশ্চয়ই সবার প্রথমে ডাক্তার, নার্স কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা। মনে পড়ারই কথা, কারণ তাদেরকে সবাই কোভিড-১৯ যুদ্ধে ‘হিরো’ হিসেবেই জানে। কিন্তু এই লেখাটিতো ‘আনসাং হিরো’কে নিয়ে। তাহলে, এই আনসাং হিরো কে? একটু ভাবুন। মনে করতে পারছেন না?
তবুও তারা নীরবে কাজ করে যান সবার জীবন রক্ষার্থে। আর এই আনসাং হিরো হলেন ফার্মাসিস্টরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে দেশের অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ, সেখানে চালু আছে দেশের সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যদি ডাক্তার আর নার্সরা সম্মুখযোদ্ধা হন, তাহলে তাদের হাতিয়ার হলো ওষুধ। দেশে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধের এই হাতিয়ারস্বরূপ ওষুধের স্বাভাবিক সরবরাহ বজায় রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন ফার্মাসিস্টরা।
একসময় ওষুধের চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হতো আমদানি এবং বহুজাতিক কোম্পানির উপর। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতে, সমসাময়িক কালে বাংলাদেশে ২৭৩টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৬,২০০ নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধের ৯৮ ভাগ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদিত হয়। এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিশ্বের ১৪৭টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ওষুধ রপ্তানি করেছে, যা বিগত বছরের তুলনায় ২৫.৬০ শতাংশ বেশি।
বর্তমানে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক স্বীকৃত কোনো ওষুধ নেই। তবে বসে নেই বিশ্বের গবেষকরাও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কিছু ওষুধের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ওষুধের জন্য বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। কারণ, ইতোমধ্যে আমাদের দেশের কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, যেমন- বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস প্রভৃতি ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে এসব ওষুধের উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, যাতে কেউ নিজে এসব পরীক্ষামূলক ওষুধ সেবন না করে। তবে যখনই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে কোনো ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ হবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন যেসব ওষুধকে স্বীকৃতি দেবে, তখনই এসব ওষুধ সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে দেশের জনগণের জন্য সরবরাহ করা যাবে। এমনকি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যাবে। এই উৎপাদন প্রক্রিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন ফার্মাসিস্টরাই।
বর্তমানে একটি বহুল আলোচিত শব্দ ‘পিপিই’। পিপিই এর পূর্ণরূপ হলো পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুয়েপমেন্ট, যা একজন ব্যক্তিকে ক্ষতিকর জীবাণু কিংবা বস্তুকণা থেকে রক্ষা করে। পিপিই-এর মধ্যে রয়েছে সুরক্ষা বস্ত্র, চশমা, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, শু কভার ইত্যাদি। বর্তমানে গণমাধ্যম জুড়ে ডাক্তারদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই সংক্রান্ত খবর প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। তবে আপনারা অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হবেন, পিপিই শুধুমাত্র ডাক্তারদের নয়, ফার্মাসিস্টদেরও প্রয়োজন হয়।
কারণ, পিপিই ছাড়া ফার্মাসিস্টদেরও মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। যেসব ফার্মাসিস্ট অ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদনের সাথে জড়িত, তারা পিপিই ব্যবহার না করলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যেতে পারেন। যারা ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনের সাথে জড়িত, তারা পিপিই ব্যবহার না করলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন।
শুধু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতেই নয়, হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা। বিভিন্ন দেশে যেখানে প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের সরব পদচারণা রয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে খুব কম সংখ্যক হাসপাতালেই ফার্মাসিস্টদের উপস্থিতি রয়েছে। যদি আমাদের দেশেও প্রতিটি হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেওয়া হতো, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চলা এ যুদ্ধে ডাক্তার-নার্সদের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমত। তবুও যেসব ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত আছেন, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন রোগীর জীবন রক্ষার্থে। জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কর্মরত একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্তও হয়েছেন।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাইকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে বলেছে। তবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কর্মরত ফার্মাসিস্টদের নতুন করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করার প্রয়োজন নেই। কারণ, যেসব ফার্মাসিস্ট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করেন, তাদেরকে ম্যানুফ্যাকচারিং এরিয়াতে প্রবেশ করার পূর্বে এবং বের হওয়ার পূর্বে অবশ্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়।
এভাবে নিভৃতে দেশের মানুষকে ভালো রাখতে কাজ করে যাচ্ছে ফার্মাসিস্টরা। দিনশেষে হয়তো অনেকেই তাদের এই অবদানের কথা স্মরণ করবে না। কিন্তু তা নিয়ে ফার্মাসিস্টদের আফসোস করলে চলবে না, কারণ তারা এই দেশের ‘আনসাং হিরো’।