ঈদে বাড়ি ফিরতে হবে। এই একটি শব্দের টানে, নাড়ির টানে পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র ছেড়ে পাড়ি জমান। কেউ বাসে, কেউ লঞ্চে কিংবা ট্রেনে। কম হলেও অনেকেই বাড়িতে যান আকাশপথে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাজধানী ঢাকায় উন্নয়ন হয়েছে আর দশটা শহরের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে। শিল্পায়নের কেন্দ্র হয়ে ওঠায় সারা দেশ থেকে মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকা পাড়ি জমিয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ একসাথে আবারো প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানী ছেড়ে বাড়ির দিকে পাড়ি জমানোর এমন ঘটনা বিশ্বে প্রায় দূর্লভ।
আর বাড়ির দিকে রওনা হওয়া মানুষের সংখ্যাও পিলে চমকে উঠার মতো। ২০১৭ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক হিসেবানুযায়ী প্রায় ষাট লাখ মানুষ ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছেড়েছে। প্রতিবছর শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা ভাগ্য বদলের তাড়নায় ঢাকায় আসা মানুষের স্রোত যখন একসাথে রাজধানী ছাড়ে তখন সৃষ্টি হয় ভোগান্তির। প্রতিবছর ঈদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার যাত্রায় জন্ম নেয় অনেক মানবিক বিপর্যয়ের। বিপুল মানুষের চাপ নিতে পারে না আমাদের সড়ক আর মহাসড়কগুলো। মাইলের পর মাইল যানজটে বসেও বাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এই মানুষেরা। লঞ্চ কিংবা ট্রেনে ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে চলাচল জন্ম দেয় অনেক দুর্ঘটনার। জীবনের দোহাই দিয়ে ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চে উঠা কিংবা ট্রেনের ছাদে যাত্রা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না মানুষকে। স্বপ্ন এবং জীবন দুটোকেই হাতের মুঠোয় নিয়ে বাড়ি ফিরেন এই সংগ্রামী মানুষেরা।
ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া এই জনস্রোতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যে শ্রমজীবী মানুষ সেই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এই মানুষেরা ঢাকায় আসেন তাদের কর্মসংস্থানের জন্য। উপার্জনের টাকায় ঈদবস্ত্র কিনে সময়ের আগে বাড়ি ফিরতে হয় এদের। আত্মীয় পরিজনদের অপেক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারেন এমন সাধ্য এই মানুষগুলোর নেই। এই স্রোতে মধ্যবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্ত অনেকেই আছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়া অনেকটা নিয়মের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সমাজে। শহরে থাকা নতুন প্রজন্মের সাথে গ্রামে থাকা প্রবীণের মেলবন্ধনের অপূর্ব সুযোগ করে দেয় এই ‘ঈদে বাড়ি ফেরা’।
কিন্তু এই বাড়ি ফেরার বিশাল যাত্রা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু সমস্যাকে দেখিয়ে দেয়। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের অভাব, সারাদেশে সমভাবে কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে না পারা এবং সর্বোপরি দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় রাজধানীতে অসম উন্নয়ন। রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমস্যাগুলো প্রতিবছর আরো ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিবছর ঈদকে কেন্দ্র করে যে ভোগান্তি, মানবিক বিপর্যয় এবং প্রাণহানি হয় তা সমাধান করতে এই সমস্যাগুলোকেই মোকাবেলা করতে হবে প্রথমে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং যাতায়াত খাতে টেকসই উন্নয়নের অভাব
স্বাধীনতার অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও রাজধানী ঢাকার সাথে অনেক জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরের যোগাযোগের ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। সারা বছর টের না পাওয়া গেলেও ঈদের সময় বাড়ি ফিরতে মহাসড়কেই মানুষকে পোহাতে হয় দীর্ঘ যানজট। ফেরীঘাটগুলোতে ভীড় থাকে চোখে পড়ার মতো। ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় অনেকেই। ঈদ যাত্রা কিংবা এ সময়ের চাপের কথা মাথায় রেখে সাময়িকভাবে ঠিকঠাক করা হলেও লম্বা দৌড়ে এই রাস্তাগুলোর বেশিরভাগেই টেকসই উন্নয়ন হয়নি।
২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের চালানো এক জরিপ অনুযায়ী, একশো আঠারটি এশিয়ান দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপের দিক থেকে দ্বিতীয়। হিমালয়ের কোল ঘেষে থাকা পাহাড়ি দেশ নেপালের সামনে থাকতে পারাটাই যৎসামান্য পাওয়া। এদিক থেকে ভারত, পাকিস্তান তো বটেই, ভুটানও বাংলাদেশ থেকে অনেক দূর এগিয়ে।
বরাবরই ঢাকা থেকে ঈদে বাড়ি ফিরে যাওয়া মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে ট্রেন। সড়কপথে জ্যাম আর নানা ধরনের ভোগান্তির কারণে অনেকেই ট্রেনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। পাশাপাশি রেলওয়ের ললাটে দ্রুতগতির পরিবহন হিসেবে থাকা খ্যাতিটা ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে যেন খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে রেললাইন সংস্কার এবং আধুনিকায়ন না হওয়ায় যাত্রাপথে ট্রেনগুলোকে মুখোমুখি হতে হয় ‘ক্রসিং’ নামক অগ্নিপরীক্ষার। ২০১৭ সালের এক হিসেবানুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীবাহী কোচ রয়েছে এক হাজার ছয়শত ছাপ্পান্নটি, এর মধ্যে প্রায় সাড়ে সাতশত কোচ মেয়াদোত্তীর্ণ। ইঞ্জিনগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশও মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে ঈদের চাপ সামাল দিতে এই মেয়াদোত্তীর্ণ কোচ কিংবা ইঞ্জিনকেও নামতে হয় যাত্রী পরিবহনে। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে হিমশিম খেয়ে চলা এই কোচগুলো একবার বিকল হয়ে পড়লেই রেল যোগাযোগের সময়সূচীতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। একটি ট্রেনের সময়সূচী প্রভাব ফেলে ঐ রুটে চলা বাকি সবগুলো ট্রেনকেই। এভাবে ঈদযাত্রায় বিপুল সংখ্যক যাত্রীর চাপ বহন করতে গিয়ে বরাবরই নাকানিচুবানি খেতে হয় রেল কর্তৃপক্ষকে। ছাদে, ইঞ্জিনে, দুই বগির মাঝে করে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া সাধারণ মানুষেরা শিকার হয় দুর্ঘটনার।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌ যোগাযোগও তেমন নিরাপদ হয়ে উঠতে পারেনি। নৌপথে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম লঞ্চ। ঈদের সময় বিপুল সংখ্যক মানুষের একসাথে বাড়ি ফেরাকে সামনে রেখে ‘ফিটনেসবিহীন লঞ্চ’ হয়ে উঠে কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। ২০১৬ সালের এক হিসেবানুযায়ী নৌপথে যাত্রীসেবা দিয়ে যাওয়া লঞ্চের ১৭ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। পাশাপাশি ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চ হয়ে উঠতে পারে বড় দুর্ঘটনার কারণ।
সারাদেশে সুষমভাবে কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে না পারা
যোগাযোগ খাতে টেকসই উন্নয়ন না হওয়ার কারণে এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য খাতেও। উন্নত অবকাঠামোর অভাবে রাজধানীর বাইরে দেশীয় কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার যে প্রয়োজনীয়তা ছিলো তা হয়ে ওঠেনি। ফলে শিল্পজাত কৃষিপণ্যকে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ঢাকা পাঠাতে হচ্ছে। ঢাকায় কর্মসংস্থান গড়ে উঠছে, গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প। এই খাতের শ্রমিকের সিংহভাগই গ্রাম থেকে শহরে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমায়। ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের তালিকায় এই শ্রেণীর নাম উঠে আসে সবার প্রথমে। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে কিংবা ট্রেনের ছাদে ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাড়িতে পৌঁছাতে হয় এই মানুষগুলোর।
স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে সব অবকাঠামো। ফলশ্রুতিতে সারা দেশের তুলনায় এখানে তৈরি হতে থাকে কর্মসংস্থানও। দেশের মোট জিডিপির ৩৫ শতাংশ এই শহরের অবদান। ফলে দেশি কিংবা বিদেশি উদ্যোক্তারা বরাবরই এই শহর কিংবা এর আশপাশে বিনিয়োগে আগ্রহী। ফলে গ্রাম থেকে শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্য হলেও ছুটে আসছেন বিপুল পরিমাণ মানুষ। তাই ঢাকায় বসবাস করা ৯০ শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘুরপাক খায়। এই মানুষের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রতিবার ঈদে বাড়িতে পাড়ি জমান। একসাথে এত মানুষের রাজধানী ত্যাগের ফলে তৈরি হয় অনাকাংখিত জটিলতা।
প্রতিবছর ঢাকা নগরীতে মানুষ বাড়ার সাথে সাথে সমস্যা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। রাজধানী ত্যাগে তৈরি হচ্ছে জটিলতা। নগর পরিকল্পনাবিদ আর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে রাজধানী ঢাকার বিক্রেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্ককে করতে হবে আরো টেকসই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের রাজধানীর বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় বিনিয়োগের অবকাঠামো তৈরি করে দিতে পারলে সারাদেশে সুষম কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত হবে। এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই রাজধানী ঢাকার উপর একদিকে চাপ কমবে অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ি ফেরার সৃষ্ট জটিলতার অবসান হবে।
Feature image source: cairoscene.com