বাংলাদেশের ইতিহাসে কিংবা বর্তমান বাংলাদেশে যশোর জেলাকে অন্য যেকোনো জেলার তুলনায় একটু আলাদাভাবেই মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। কেননা এই জেলার মধ্য দিয়েই ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্কের অধিকাংশ পণ্য আসা-যাওয়া করে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম জেলা হিসেবেও যশোর স্বীকৃত। পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে সরাসরি সংযোগ সৃষ্টিকারী সড়ক হিসেবে ‘যশোর রোড’ সকলের কাছেই পূর্ব পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এদেশে হামলা করলে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী জনগণ অস্থায়ী শরণার্থী হিসেবে ভারতে গমন করে। সে সময় নিরাপদে ভারতের ভূখণ্ডে অস্থায়ীভাবে প্রবেশের পথ হিসেবে শরণার্থীরা বেছে নেয় এই যশোর রোডকে। এই রাস্তা ধরে হেঁটে ভারতের পথে চলা অনেকেই রেখে এসেছিলেন তার দুর্বল সঙ্গী বা প্রবীণ প্রিয় মানুষটিকে, যিনি কিনা তার সাথে পাল্লা দিয়ে হেঁটে ওপারে যেতে পারবেন না। অনেকে এ পথ ধরে হেঁটে চলার মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হারিয়েছেন প্রাণ, বাকিরা ফেলেছেন এক রাশ দীর্ঘশ্বাস। পশ্চিমবঙ্গের দিকে চলে যাওয়া যশোর রোডের দু’পাশে সারিবদ্ধ হাজারো গাছ এসব ঘটনার সাক্ষী হিসেবে আজও দণ্ডায়মান হয়ে আছে। এই বৃক্ষরাজি ছায়া দিয়েছিল ঘর-বাড়িহীন লাখো মানুষকে, আশ্রয় দিয়েছিল অনেক পঙ্গু যুবক-বৃদ্ধকে, অসহায় নারী-শিশুদের।
একাত্তরের সেপ্টেম্বরে যশোর রোডের এরূপ মর্মান্তিক অবস্থা চলাকালীন রোডের দু’ধার প্লাবিত হয়েছিল মৌসুমী জলবায়ুর প্রকোপে। ভাসমান মানুষকে যেন আরও একবার ভাসিয়ে দিতেই এই মহাপ্লাবনের আগমন। এই বন্যা এবং যশোর রোডের সার্বিক অবস্থা বিশ্ব গণমাধ্যমের নজরে আসে। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং কবিরা এগিয়ে আসেন তাদের সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে। এভাবে যশোর রোড এবং শরণার্থীরা সমগ্র বিশ্বের আলোচনার মূল বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়। যশোর রোড নিয়ে বৈদেশিক সাংবাদিকেরা এবং ত্রাণকর্মীরা রিপোর্ট করতে শুরু করেন, গায়কেরা গান এবং কবিরা লেখেন বিখ্যাত সব কবিতা। ঘরবাড়ি ছেলে পলায়নরত এসব মানুষের দুর্দশার চিত্র কাঁদিয়ে তোলে সকল মানুষের হৃদয়কে।
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে যশোর রোডকে আন্তর্জাতিকীকরণের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। একাত্তরে তিনি এসেছিলেন কলকাতা সফরে। উঠেছিলেন আরেক বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। কলকাতা থেকে যশোর রোড কাছে হবার ফলে দেখতে চেয়েছিলেন শরণার্থী ক্যাম্পগুলো। সেপ্টেম্বরে রওনা দেন সীমান্তের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অতিবর্ষণের ফলে যশোর রোড তখন সম্পূর্ণ ভাসমান। নৌকা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না তার হাতে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পিছু হটেননি কবি। নৌকাযোগে পৌঁছান যশোর সীমান্তে। এ প্রসঙ্গে কবিতা ও গানের খবরাখবর নিয়ে বব ডিলানের প্রকাশনা ‘ডিলান ১০’ এর বসন্ত সংখ্যায় গিন্সবার্গ লিখেন,
“আমার ইচ্ছা ছিল, বব ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড-আইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর মতো লম্বা কোনো গান, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানবিক আকুতি জাগাবে, যা ডিলানকে ভাবাবে, কাঁদাবে। আমি তা-ই লিখতে চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট দেখে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা-ই লিখলাম। কলকাতার ভাষা আর সংগীতের মিশ্রণে সেটিকে গানে রূপ দিলাম ভারতীয় হারমোনিয়াম সহযোগে। সে সময়ে দেখা মানুষগুলোর অন্তহীন যাতনা আমাকে নির্বাক করেছিল। সব বয়সের মানুষের বেঁচে থাকার কষ্ট আমার বুকে চেপে বসে ছিল। সেই যাতনা হৃদয়ে নিয়েই আমি লিখেছিলাম ‘যশোর রোড’ কবিতা”।
“Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan
Taxi September along Jessore Road
Oxcart skeletons drag charcoal load
past watery fields thru rain flood ruts
Dung cakes on treetrunks, plastic-roof huts
Wet processions Families walk
Stunted boys big heads don’t talk
Look bony skulls & silent round eyes
Starving black angels in human disguise.”
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটির লাইনগুলো নিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমনের পর পপ সঙ্গীতের কিংবদন্তী বব ডিলান তার কাছ থেকে কবিতাটি নিয়ে যান পড়ে দেখবার জন্যে। ফেরত দেবার সময় লেখাটি পড়ে নিজের অশ্রু বিসর্জনের কথাও উল্লেখ করেন বব। এরপর শুরু হয় এর সংগীত প্রযোজনা করে গিটারের সুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা। হারমোনিয়ামের সুর থেকে গানটিকে গিটারের সুরে নিয়ে আসতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল বব ডিলানকে। সকল ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে একপর্যায়ে গানটি পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়। মার্কিন কবি ও সাংবাদিক জন সিনক্লেয়ারের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত এক শোভাযাত্রায় গানটি করেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। সেখান থেকে গানটি শুনে মুগ্ধ হন আরেক কিংবদন্তী জন লেনন। আর এভাবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যশোর রোড আরও একবার পরিচিত হয়, হতে থাকে ইতিহাসের নির্মাতা।
নিউইয়র্কে যশোর রোড
গত বছরের (২০১৭) অক্টোবরে নিউইয়র্কের কুইন্সে একটি প্রদর্শনীতে ‘যশোর রোড’ নামে একটি ভাস্কর্য প্রদর্শন করা হয়। প্রায় ৮০টি ভাস্কর্যের মধ্যে ‘যশোর রোড’ সহজেই সবার নজর কাড়ে। ভাস্কর আখতার আহমেদ রাশা তার ভাস্কর্যের মাধ্যমে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটিকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেবার পাশাপাশি যশোর রোডের ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেন।
বর্তমানে যশোর রোড
বর্তমানেও যশোর রোড বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ সড়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত সড়কটির প্রায় ৩৮ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশে পড়েছে। পেট্রাপোল থেকে কালীঘাট পর্যন্ত পড়েছে ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে। উভয় দেশের সড়কের সম্মিলিত অংশকে একত্রে বলা হয় যশোর রোড।
সড়কের দু’ধারের প্রায় আড়াই শত বছরের পুরনো আড়াই হাজারেরও বেশি বৃক্ষরাজি এখনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে তিন শতাধিক মেঘ শিরীষ গাছও রয়েছে। ধারণা করা হয় প্রায়, ১৭৪ বছর আগে যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দার মেঘ শিরীষ গাছগুলো রোপণ করেন।
শুধুমাত্র এই গাছগুলোর জন্যেই যশোর রোড অন্যরকম এক স্নিগ্ধতা বহন করে চলছে জনম জনম ধরে। একদিকে যেমন সবুজের সমারোহ অন্যদিকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব; সবমিলিয়ে এ পথে ভ্রমণকারী এমন একজন ব্যক্তিও হয়তো নেই, যিনি এই গাছগুলোর প্রেমে পড়েননি।
অতিসম্প্রতি যশোর রোডের এই গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করার লক্ষ্যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তবে এ সিদ্ধান্তের সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। যশোর রোডের সৌন্দর্য এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে গাছগুলো কর্তন না করে বিকল্প চিন্তা করার কথাও ভাবছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন প্রথম আলোর বরাতে বলেন,
“মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত যশোর রোডের প্রায় আড়াই হাজার শতবর্ষী বৃক্ষ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যশোর জেলা প্রশাসন। এই যশোর রোডেরই ভারতীয় অংশে ঘটেছে উল্টোটা। তারা গাছগুলি মাঝখানে রেখে সড়ক সম্প্রসারণ করেছে। এতদিন চোরাগোপ্তাভাবে বৃক্ষ নিধনের পর এখন প্রকাশ্যেই এত প্রাণ ধ্বংসের লুটপাটের আয়োজন?”
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে জনমত। ভারতের মতো করে গাছগুলো মাঝে অক্ষত রেখে দিয়ে দু’পাশ দিয়ে লেন করার প্রস্তাব রাখছেন অনেকে।
শেষ করছি কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের বাংলা সংস্করণ মৌসুমি ভৌমিকের গাওয়া গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে –
“কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল
তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা
জননীর কোলে আধপেটা শিশু
এ কেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দল
তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া
গুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটি
ঘর ছেড়েছ তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে
যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ
এতো এতো লোক শুধু কেন মরে”।
ফিচার ইমেজ: News Fourth End