আনন্দমোহন বসু: বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বুদ্ধিজীবী

‘র‍্যাংলার’ শব্দটির সাথে কি আমরা পরিচিত?

র‍্যাংলার হলো গণিতশাস্ত্রের ওপর প্রদত্ত সর্বোচ্চ উপাধি, যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হয়। আর এই র‍্যাংলার উপাধি পান কিশোরগঞ্জের আনন্দমোহন বসু। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ‘র‍্যাংলার’ উপাধি পাওয়া একজন ভারতীয়।

১৮৭৪ সাল এমন একটি সময়, যখন এদেশে ব্রিটিশদের ধরা হতো ‘রাজা বা প্রভু’ হিসেবে, আর ভারতীয়দের ধরা হতো তাদের অনুগত দাস। সেরকম একটি সময়ে সকলকে অবাক করে দিয়ে খোদ ইংল্যান্ড থেকেই আনন্দমোহনের খবরটি আসে। তা তখন ইংল্যান্ড এবং ভারতীয় উপমহাদেশ, দু’অঞ্চলেই সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিল তুমুলভাবে। দীর্ঘ ২০০ বছর যারা এই ভূখণ্ড চুষে খেয়েছে, সে ভূখণ্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেয়া এই আনন্দমোহন বসু কি না তাদের দেশ থেকেই গণিতের দেয়া সর্বোচ্চ উপাধি নিয়ে এলো! অবাক ব্রিটিশরাও।

বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বুদ্ধিজীবী আনন্দমোহন বসু; Image Source: Wikimedia Commons

ক্যামব্রিজের মতো বিশ্বের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে পড়া প্রথম ভারতীয় আনন্দমোহন বসু। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধাবী। ১৮৬২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন তিনি। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৭০ সালে তিনি লাভ করেন প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি। সেই বৃত্তির টাকায় ১৮৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে পাড়ি জমান এবং দেশের জন্য বয়ে আনেন অফুরন্ত সম্মান ও সুখ্যাতি। উপমহাদেশের মানুষদের প্রতি ব্রিটিশদের দেখার চোখই বদলে দিয়েছেন হাওরের ধুলো মেখে শৈশব কাটানো এই ব্যক্তিটি।

আনন্দমোহন বসুর পরিচয় শুধু মেধাবী হওয়াই নয়; তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা।

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান

কলকাতাই ছিল তৎকালীন সমাজের পাশ্চাত্য শিক্ষার কেন্দ্রমুখ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আলোকশিখা যদি মফস্বলগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব না হতো তাহলে কি এই উপমহাদেশ আজ শিক্ষিত হতে পারত? আমরা পারতাম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অধিকার-স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে?   

না, পারতাম না। এই গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতে যেসব মনীষী তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাদের কথা আমরা জানি না, নামও হয়তো শুনিনি সবাই। এরকম একজন হারিয়ে যাওয়া মনীষী কিশোরগঞ্জের আনন্দমোহন বসু। তিনি ময়মনসিংহে নিজের বাড়িতে কলকাতা সিটি কলেজের একটি শাখা নির্মাণ করেন। ১৯০১ সালে এর নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ কলেজিয়েট স্কুল হিসেবে। ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট তার মৃত্যুর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলেও দু’বছর পর তা পুনরায় চালু করা হয়। তখন এর নাম দেয়া হয় ‘আনন্দমোহন কলেজ’, যা আজ ময়মনসিংহ জেলার নামকরা বিখ্যাত কলেজ হিসেবে সগর্বে উদ্ভাসিত। একইসাথে তিনি কলকাতা সিটি স্কুল ও কলেজেরও প্রতিষ্ঠাতা।

ময়মনসিংহের গর্ব- আনন্দমোহন কলেজ; Image Source: kishorganjnews.com

শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ, ত্যাগ ও সাধনার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে হান্টার কমিশনের সদস্য নিযুক্ত করেন। পরে ক্রমান্বয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন সদস্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনেট সদস্য এবং একজন ‘ফেলো’ হিসেবে মনোনীত হন। তার চেষ্টায় ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অভ ইনকর্পোরেশন’ সংশোধন করা হয়। এ সংশোধনের পর থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শিক্ষা গ্রহণকারী সংস্থাই নয়, শিক্ষা দানকারী সংস্থাও হয়ে ওঠে।  

এরপর ১৮৯২ সালে ভারত আইন যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বঙ্গীয় আইন পরিষদের একজন সদস্য নির্বাচন করবার অধিকার দেয়, তখন আনন্দমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের প্রথম প্রতিনিধি হন। নারীদের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন। ১৮৭৬ সালে কলকাতায় তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে তিনি আরো ভালো ফল লাভের আশায় বেথুন কলেজের সাথে যুক্ত করে দেন।

বঙ্গীয় রেনেসাঁর স্থপতি হিসেবে যাদের নাম শোনা যায়, তাদের মধ্যে কোথাও তার নামটি সেভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায় না। অথচ তার অবদান সেই জাগরণকে দিয়েছিল নতুন এক মাত্রা।

রাজনৈতিক ভূমিকা

রাজনীতি অঙ্গনের জন্য তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। বিলেত থেকে ফেরত এসে তিনি যখন দেখলেন, উপমহাদেশের ছাত্র সমাজ তাদের অবসর সময়ে দেশসেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে; তারা নারীজাতির শিক্ষা, জনহিতকর কাজে নিয়োজিত- তখন তার মনে আশার দানা বাঁধল। তিনি উপলব্ধি করলেন, উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে অবদান রাখতে হবে এই ছাত্র সমাজেরই। তারাই পারবে এদেশ থেকে বিদেশীদের শাসন দূর করতে, তারাই পারবে নারীদের জাগিয়ে তুলতে। তাই এ দেশের উন্নয়ন, বিকাশ, স্বাধীনতার বীজ রোপণ করতে হবে তাদেরই হাত ধরে। আর তাই ১৮৭৫ সালে তিনি ‘ক্যালকাটা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে ছাত্রদের জন্য একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে এর সভাপতি হন।

তার অন্যতম এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। এর উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করা। ১৮৭৬ সালে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। পরে এর নাম হয় ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে অসামান্য অবদান রাখেন আনন্দমোহন বসু। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ছিলেন তার অন্যতম পরামর্শদাতা।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন; Image Source: qph.fs.quoracdn.net

তিনি দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব পান। ১৮৮৪, ১৮৯০ এবং ১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন আনন্দমোহন। 

ধর্ম এবং নৈতিকতার পাঠ

তার অন্য একটি বড় পরিচয়, তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রবণ। বিলেত যাওয়ার পূর্বেই তিনি সস্ত্রীক ধর্মমত গ্রহণ করেন এবং দেশে ফিরে এসে তিনি তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজ পরিচালিত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনগুলোতে যোগ দেন। কিন্তু ১৮৭৮ সালে কিছু তরুণ সদস্যদের মাঝে ভিন্নমত দেখা দিলে ব্রাহ্ম সমাজের ভাঙন ধরে। পরে তিনি নতুন করে আবার ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার সভাপতি হন তিনি নিজেই।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রদের জন্য তিনি  ‘স্টুডেন্ট উইকলি সার্ভিস’ নামে একটি নৈতিক শিক্ষা কোর্স চালু করেন। দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়েই কাজ করেন। আর তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, শিবচন্দ্র দেব, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ।

বিস্মৃতি

১৯৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পদ্মলোচন বসু এবং ওমা কিশোরী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন আনন্দমোহন। তিনি বিয়ে করেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা দেবীকে। কর্মজীবনে অবিভক্ত বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দলের সভাপতি হয়েই তিনি থেমে থাকেননি। আজীবন কাজ করে গেছেন গণমানুষের জন্য। রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজ সংস্কার সবদিকেই তিনি আমাদের জন্য জায়গা তৈরি করে দিয়ে গেছেন।

কিন্তু তাকে ঘিরে আমাদের কোনো সভা-সমাবেশ নেই, নেই তার রেখে যাওয়া অবদানের স্মৃতিচারণ কিংবা চর্চার যথেষ্ট সুযোগ। কিশোরগঞ্জে ইটনা জেলায়, সিদ্ধিরগঞ্জ গ্রামে তার পৈতৃক ভিটেটি পর্যন্ত আজ অসাধুদের দখলে। অথচ এটি হতে পারত একটি জাদুঘর। সম্প্রতি হাওরাঞ্চলে পর্যটকদের ভিড় জমে গেছে, আনন্দমোহনের বাড়িটি যদি সংরক্ষণে থাকত, তবে পর্যটকদের জন্য হতে তা পারত একটি ভ্রমণস্থল। ঘুরে দেখে আসা যেত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতার বাড়ি, জানা যেত ভারতের প্রথম ও একমাত্র র‍্যাংলার এবং তার অসামান্য অবদান সম্পর্কে। কিন্তু এই বাড়িটিও আজ অন্যায়ভাবে দখলে রাখা।

আনন্দমোহন বসুর বাড়ি; Image Source: kishorganj.govt.bd 

ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সামনে এগোনো কখনো সম্ভব না। কারণ তারাই আমাদের জন্য বর্তমান তৈরি করে দিয়ে গেছেন, আর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের তৈরি করে যেতে হবে। আর তাই এরকম অসংখ্য আনন্দমোহন বসু, যারা আজ হারিয়ে যাওয়ার দলে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের কর্মের প্রেরণার মাঝে।

অনলাইনে কিনুন- আনন্দমোহন বসু

Related Articles

Exit mobile version